ইসির প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা বহাল থাকছে

ব্যাপক সমালোচনার মুখে অবশেষে প্রার্থিতা বাতিল সম্পর্কিত গণপ্রতিনিধত্ব অধ্যাদেশের ৯১/ই ধারা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের জানান, ৯১/ই ধারা বাতিলের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজসহ নানা মহল থেকে আসা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ধারাটি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে কমিশন এখনো মনে করে যে, নির্বাচন কমিশন যেসব যুক্তিতে ৯১/ই ধারা বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা সঠিক। কিন্তু যেহেতু সাধারণ মানুষ মনে করছে এই বিধান বাতিল হলে নির্বাচন কমিশন ক্ষমতা হারাবে, তাই মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এই বিধানটি আগের মতোই রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
সমপ্রতি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এই বিধানটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি। অবশ্য গত ২৬ আগস্ট নির্বাচন কমিশন এক বিবৃতিতে দাবি করে, আরপিও’র ৯১/ই ধারা বাতিল হলেও অসদাচরণের দায়ে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ইসির থাকবে। কেননা, ৯১/এ ধারায় কমিশনকে সেই ক্ষমতা দেয়া আছে।
বিবৃতে বলা হয়, ৯১/ই ধারায় কেবল অসদাচরণকারী প্রার্থীর প্রর্থতা বাতিলের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে কমিশনকে। কিন্তু আরপিও’র ৯১/এ অনুচ্ছেদে প্রাক নির্বাচন পর্যায়ে কোনো প্রার্থী অসদাচরণ করলে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বা প্রার্থীকে এমনকি রাজনৈতিক দলকেও নির্দেশ দিতে পারবে। আর নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অমান্যের ক্ষেত্রে অনধিক এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে এবং প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। সুতরাং ৯১/ই বাতিল হলেও কমিশনের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করার ক্ষমতা ৯১/এ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সংরক্ষিত ছিল এবং থাকবে।
কমিশনের পক্ষ থেকে এও বলা হয় যে,ক্ষমতা থাকা অপরিহার্য। তবে ক্ষমতা থাকাটাই পর্যাপ্ত নয়। যথাযথ ক্ষেত্রে তা প্রয়োগও করতে হয়। কিন্তু ৯১/ই এর ক্ষমতা ২০০৮ এর ২৯ শে ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রয়োগ করা হয়নি। কোনো কোনো আসনের নির্বাচনের ব্যাপারে দায়েরকৃত মামলার রায়ে দেখা যাচ্ছে যে,প্রাক নির্বাচন পর্যায়ে অসদাচরণ সংঘটিত হয়েছিল,অথচ সেই ক্ষেত্রে ৯১/ই প্রয়োগ করা হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালত অসদাচরণকারীর সদস্য পদ বাতিল করে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্বাচিত ঘোষণা করার জন্য আদেশও দিয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে,২০০৮ এর ৪২ নং অধ্যাদেশমূলে আরপিওতে ৯১/ই অনুচ্ছেদ সন্নিবেশ করা হয়। এই অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনপূর্ব অসদাচরণের প্রমাণ পাওয়া গেলে কমিশন সেই প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে। বাতিল প্রার্থী ছাড়া অবশিষ্ট প্রার্থীদের প্রতিদ্বনি্দ্বতায় নির্বাচন হবে। তবে প্রার্থিতা বাতিলের ফলে একজন মাত্র প্রার্থী অবশিষ্ট থাকলে অনুচ্ছেদ ১৭ অনুযায়ী ওই আসনের নির্বাচন কার্যক্রম বাতিল করে নতুন তফসিল দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন মনে করে,৯১/ই ধারাটি ১৯ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা,অনুচ্ছেদ ১৯ এর বিধান হলো বাছাইকালে কোনো মনোনয়নপত্র বাতিলের ফলে অবশিষ্ট প্রার্থী একজন থাকলে তাকে বিনা প্রতিদ্বনি্দ্বতায় নির্বাচিত বলে ঘোষণা করতে হবে। প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের বিধান রয়েছে। কিন্ত ৯১/ই এর বিধান তার বিপরীত। ৯১/ই মোতাবেক অসদাচরণকারী প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করে অবশিষ্ট একজন প্রার্থীর ক্ষেত্রে নির্বাচনী কার্যক্রম বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণা করা হলে অবশিষ্ট একক প্রার্থী নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রার্থিতা বাতিল করা। এভাবে অপরাধীর দোষের কারণে নির্দোষকে শাস্তি প্রদান যুক্তিসঙ্গত নয় বলে কমিশন মনে করে।
দ্বিতীয়ত,অবশিষ্ট একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে চলমান নির্বাচনী কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করে নতুন তফসিল ঘোষণা করলে আগের দোষী প্রার্থীসহ অনেক নতুন প্রার্থীর প্রতিদ্বনি্দ্বতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ পাবেন। সেক্ষেত্রে ওই অবশিষ্ট একক প্রার্থীর জন্য আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে না।
তৃতীয়ত,অসদাচরণের দায়ে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করায় অবশিষ্ট প্রার্থী দুই বা ততোধিক থাকলে তখন সেই সীমিত সংখ্যক প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বনি্দ্বতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ৯১/ই-তে রাখা হয়েছে । এক্ষেত্রে নতুন তফসিল নয় এবং নতুন কেউ প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পাবে না। এতে দেখা যায় যে,৯১/ই অনুচ্ছেদ মোতাবেক অসদাচরণের জন্য কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পর অবশিষ্ট প্রার্থীর সংখ্যা এক ও একাধিক হওয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধান পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া ৯১ই অনুচ্ছেদের (১) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, প্রার্থী যদি এমন কোনো গুরুতর বেআইনী কাজ বা “আরপিও” বা বিধিমালা বা আচরণ বিধিমালার কোনো বিধান লংঘন করেন, তাহলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন। কিন্তু সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ এবং “আরপিও”র অনুচ্ছেদ ১২ এর (১) উপ-অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্যতার যে বিধান দেয়া আছে, তাতে ঢালাওভাবে আরপিও বা বিধিমালা বা আচরণ বিধিমালার বিধান লংঘনের উল্লেখ নেই।
এসব কারণে নির্বাচন কমিশন মনে করে,প্রায়োগিক দিক হতে ৯১/ই আদৌ প্রয়োগযোগ্য নয় এবং অর্থহীন। তাই অনুচ্ছেদ ১৯ এর অনুরূপ অবশিষ্ট প্রার্থী একজন হলে তাকে বিনা প্রতিদ্বনি্দ্বতায় নির্বাচিত ঘোষণা করার বিধান রেখে অনুচ্ছেদ ৯১/ই সংশোধনের প্রস্তাব করে কমিশন। তবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে এবার তারা সরেও এলো।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button