জাতীয় কবির ১১৫তম জন্মবার্ষিকী

Nazrul Islamসাদেকুর রহমান: রোববার ১১ জ্যৈষ্ঠ। বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিস্ময়, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের পাকা আম-কাঁঠালের গন্ধমাখা এমন এক তপ্তমধুর দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে জন্ম নেন এ কালোত্তীর্ণ ব্যক্তিত্ব। এদিনে নজরুল স্মরণে রুটিনমাফিক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে সরকার। এমনকি নজরুল জন্মোৎসবে উপস্থিত থাকছেন না প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কেউ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘নোবেল পুরস্কার’ পান তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। অনুজ নজরুলের ‘ধূমকেতু’ ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) প্রকাশিত হলে ১৯২২-এর ১১ আগস্ট (১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৪ শ্রাবণ) রবীন্দ্রনাথ এই পত্রিকার আশীর্বাণী লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপিতে প্রথম ৬টি সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় ৭ম সংখ্যা থেকে ৩য় পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপর তা ছাপা হয়- “আয় চলে আয়, রে, ধূমকেতু,/র্আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/জাগিয়ে দেরে চমক মেরে’/আছে যারা অর্ধচেতন!” রবি ঠাকুর তাঁর রচিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কাজী নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। সেটি ছিল রবীন্দ্র পরিবারের বাইরে প্রথম কাউকে একটি বই উৎসর্গ করার ঘটনা। অথচ এদেশে রবীন্দ্র-বন্দনার ভিড়ে নজরুল অনেকটাই উপেক্ষিত ও ¤্রয়িমান বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আব্দুল হাই সিকদার। এ কারণেই নজরুলের জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতায় সরকারের দায়সারা উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেন।
অনন্য সাহিত্যপুরুষ নজরুল দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, চির তারুণ্য, সকল ধর্ম ও সকল মানুষের কবি। তার এক হাতে ছিল বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আরেক হাতে রণতুর্য। তার সাহিত্য মানসের মর্মকথাÑ মানবতা। কবির জন্মদিন উপলক্ষে রেওয়াজ অনুযায়ী বাণী দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদ এডভোকেট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় কবির রুহের মাগফিরাত কামনা ও তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশেষ বাণী দিয়েছেন। এদিকে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও রাজধানী ঢাকাসহ সারা  দেশে নজরুল স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদিকে পূর্বনির্ধারিত চার দিনের সরকারি সফরে জাপানের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে গতরাতেই ঢাকা ত্যাগ করেছেন। সঙ্গত কারণেই জাতীয় কবির জন্মোৎসবে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, আগামী ২৯ মে তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
১৩০৬ বঙ্গাব্দ তথা ১৮৯৯ ঈসাব্দে এক বৈরী সময়ে পৃথিবীর মুখ দেখেন কাজী নজরুল ইসলাম। তার পিতা কাজী ফকির আহমদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃহারা হন তিনি। আজন্ম ‘দুখু মিয়া’ নানা প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং অবশেষে অনেকাংশে বিজয়ীও হয়েছেন। তবে তার সাহিত্য সৃষ্টির আশ্চর্য ক্ষমতা সমকালীন কোনো কোনো কবি-সাহিত্যিককেও ঈর্ষান্বিত করে  তোলে। নজরুলের আবির্ভব এমন এক সঙ্কটময় মুহূতে যখন ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে জীবন, সংস্কৃতি প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়। তখনি তিনি শক্ত হাতে কলম ধরেন অযাচিত আঁধার বিনাশ করতে। সাহিত্যের প্রায় সবক’টি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ লক্ষণীয়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, গায়ক, বাদক, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ছন্দের দ্যোতনা মানব হৃদয়ে বেশি ঝঙ্কার তুলেছে বলে ‘কবি’ হিসেবেই তিনি হয়ে ওঠেন সকল মানুষের।
সমাজের যত অসঙ্গতি, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে তার লেখনী ছিল বরাবরই সোচ্চার। তিনি সা¤্রাজ্যবাদ বা শোষকশ্রেণীর কাছে নতি স্বীকার না করে অসংকোচে বলতেন, ‘আপনি আপনারে ছাড়া কাহারে করি না কুর্নিশ’। সকল অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে সাবধান বাণী শুনিয়ে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, ‘যেথায় ভ-ামী ভাই/করবো সেথায় বিদ্রোহ/ ধামাধরা, জামাধরা মরণভীতু/ চুপ রহো’। বৈষম্যপূর্ণ সমাজের করুণ আর্তনাদই নজরুল রচনার মূল রসদ। রক্ষণশীল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে প্রচ- আঘাত হেনে তিনি মুক্তিপ্রার্থীদের প্রেরণা যুগিয়েছেন। কাব্যে তার প্রকাশ এভাবে ‘প্রার্থনা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস/ যেন লেখা হয় আমার রক্ত লেখায় তাদের সর্বনাশ’। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মাধ্যমেই আধিপত্যবাদ-ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধের’ ডাক দেন। এজন্য তাকে কারাবরণও করতে হয়েছে। সা¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার তার ‘বিষের বাঁশী’, ‘প্রলয় শিখা’সহ বেশ কয়টি বই বাজেয়াপ্তও করেছিল।
ক্ষণজন্মা প্রতিভা কাজী নজরুল শত অভাবের মধ্যেও কাব্য সাধানায় ছিলেন অটল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ যেখানে ছিলেন স্বাজাত্যবাদী, সেখানে নজরুলের সাহিত্যচিন্তা ছিল উদারপন্থী, সার্বজনীন। তার অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যভাবনা সর্বজনবিদিত। সাম্যের গান গেয়ে তিনি ধর্ম-বর্ণ-পেশা নির্বিশেষে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন করে নেন। পরিণত হন মুকুটহীন স¤্রাটে। পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করলেও নানা আনুকূল্যে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে ‘দ্বিতীয়’ জন্মভূমি। এখানকার আলো-বাতাস তাকে শুধু দৈহিকভাবেই বৃদ্ধি করেনি, মেধা-মনীষার উৎকর্ষ সাধনেও নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে তাকে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়ে বাংলাদেশে এনে নাগরিকত্ব ও জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। তার আবেগদীপ্ত ‘চল্ চল্ চল্’ কবিতাটি আমাদের রণসঙ্গীত। দীর্ঘদিন অসুস্থ ও বাকরুদ্ধ থাকার পর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১১ ভাদ্র সকাল ১০টা ১০ মিনিটে এই জ্যোতির্ময় সাহিত্যপুরুষ রাজধানীর বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী কবি নজরুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। কিন্তু ‘আমি চির তরে দূরে চলে যাব/তবু আমারে দেব না ভুলিতে’ কবির এমন আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে জাতীয় প্রচেষ্টার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যদিও ময়মনসিংহে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়’। জাতীয় কবির মাযার ঘিরে জাদুঘর স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়েও হচ্ছে না। জাতীয় কবি হিসেবে তাঁর সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি ৩৭ বছরেও। চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নজরুল চেয়ার’ স্থাপন করা হলেও কোন কার্যক্রম নেই। নজরুল ইনস্টিটিউটও চলছে গঁৎবাঁধা ছকে। জাতীয় কবির এত অবজ্ঞা, এত অবহেলা কেন? নজরুলভক্তসহ সুধীমহল এর অবসান চান।
কর্মসূচি : সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ বছর জাতীয় পর্যায়ের মূল অনুষ্ঠান হবে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার দরিরামপুর হাইস্কুল মাঠে। সকাল ১১টায় অনুষ্ঠান শুরু হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি থাকবেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন। নজরুল স্মারক বক্তৃতা করবেন কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। এর আগে সকাল ৬.৪৫ টায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। শিল্পকলা একাডেমিতে কবির জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল ইন্সটিটিউট। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি গতকাল বিকেলে একাডেমির নজরুল মঞ্চে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। নজরুল ইন্সটিটিউট ২৫-২৮ মে তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। মূল অনুষ্ঠানের সাথে সঙ্গতি রেখে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত কুমিল্লার দৌলতপুর এবং চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করা হবে।
এবার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৫তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপনের থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নজরুল ও অসাম্প্রদায়িকতা’। নজরুল ইন্সটিটিউট ও বাংলা একাডেমি জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণিকা ও পোস্টার মুদ্রণ করবে। নজরুল ইন্সটিটিউট কাজী নজরুল ইসলামকে বর্তমান প্রজন্মের সাথে পরিচিত করার লক্ষ্যে কবির ছবি, পোস্টার ও বই প্রদর্শনীর আয়োজন করবে এবং গণগ্রন্থাগার অধিদফতর বই প্রদর্শনী, পাঠ প্রতিযোগিতা ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করবে। ঢাকাসহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিবসটি যথাযোগ্যভাবে উদ্যাপন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহ এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণ করবে। জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানমালা বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি চ্যানেলসমূহ ব্যাপকভাবে সম্প্রচার করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও নজরুল জন্মোৎসব পালনে কর্মসূচি নিয়েছে। সকাল সোয়া ৬টায় ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিকের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ জাতীয় কবির মাযারে ফাতেহা পাঠ ও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর কবির মাযারের পাশেই ভিসির সভাপতিত্বে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনসমূহ সকাল ৭টায় কবির মাযারে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমি সকাল ৭টায় মাযারে শ্রদ্ধা নিবেদন ও বিকেল সাড়ে ৫টায় পদক বিতরণ করা হবে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল আই এবারও নজরুল মেলার আয়োজন করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি কয়েকটি রেডিও-টিভি নজরুল স্মরণে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকসমূহ ছাড়াও সারা দেশের পত্রপত্রিকায় কবির জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করা হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button