বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে পৃথিবীর প্রথম সোলার হেলিকপ্টার উদ্ভাবন

Solar
সোলারকপ্টারের ফ্রেম পর্যবেক্ষণ করছেন ড. হাসান শহীদ; সোলারকপ্টারের প্রথম ভার্সন আকাশে উড়ছে; সোলারকপ্টারের অপারেশন পর্যবেক্ষণ করছেন ড. হাসান শহীদ

তামিম হাসান: বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. হাসান শহীদের তত্ত্বাবধানে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের মাস্টার্সের ছাত্ররা শুধু সূর্যের আলো থেকে প্রাপ্ত শক্তি দিয়ে চলতে পারবে এমন হেলিকপ্টার উদ্ভাবন করেছেন। সুইজারল্যান্ডের সোলার ইমপালস এবং নাসার সান সিকার, পাথফাইন্ডার ও হেলিওসসহ সোলার প্লেনের অনেক প্রজেক্ট থাকলেও সোলার হেলিকপ্টার এটাই বিশ্বে প্রথম। হেলিকপ্টারটি মূলত চারটি প্রপেলারযুক্ত (মোটর চালিত পাখা) একটি কোয়াডরোটর, যা আকাশে উড়তে ব্যাটারি বা অন্য কোনো রকম জ্বালানির প্রয়োজন হয় না। এটি এ মুহূর্তে টেইক অফ করে কিছু সময় সময় উড়তে পারে, তবে শিগগিরই গবেষণার মাধ্যমে আরো কিছু কাজ সম্পন্ন হলে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকা পর্যন্ত সোলারকপ্টারটি আকাশে থাকতে পারবে এমন কথাই জানালেন ড. হাসান শহীদ। ডিসকভারি চ্যানেল এবং টেকনোলজিবিষয়ক ম্যাগাজিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় এ সোলার হেলিকপ্টারের খবর প্রচারিত হয়েছে। সোলার হেলিকপ্টারটির উদ্ভাবনী দলে একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ছাত্র রয়েছেন, যার নাম শাকির আহমেদ। কুইন মেরিতে ১০০ বছরেরও আগে ইউকের প্রথম ‘অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগ চালু হয়েছিল। এখানে শিকরা শুরু থেকে ড. হাসান শহীদ হেলিকপ্টার নিয়ে গবেষণা করছেন। এ বিষয়ে তার অধীনে একজন ছাত্র পিএইচডি এবং অনেক ছাত্রছাত্রী অনার্স এবং মাস্টার্স প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছেন। এ বিশেষ গবেষণাটি তিনি ২০১১ সালে একটি অনার্স প্রজেক্ট হিসেবে শুরু করেন ইরাকি ছাত্র আলী আবিদ আলীর মাধ্যমে। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে তৈরি মডেল সোলার হেলিকপ্টারটি কোনো সমস্যা ছাড়া আকাশে উড়তে সম হয়। সহজে এর গতি নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হয়। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। শুধু সৌরশক্তির মাধ্যমে চলতে পারত না এটি, ব্যাটারির সহায়তা নিতে হতো। হেলিকপ্টারে যুক্ত সোলার প্যানেলের মাধ্যমে চার্জ করা হতো ব্যাটারি। এ সীমাবদ্ধতা থেকে শুরু হয়েছিল পরবর্তী চ্যালেঞ্জ- ব্যাটারি বা অন্য কোনো জ্বালানি ছাড়া শুধু সৌরশক্তির দিয়ে হেলিকপ্টার চালানো। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রজেক্টটি মাস্টার্স পর্যায়ে নিয়ে নেয়া হয়, আলী আবিদ আলীর সাথে যোগ দেয় আরো ছয়জন ছাত্র, আর ড. হাসান শহীদের সাথে সহতত্ত্বাবধায়ক হিসেবে থাকেন কম্পিউটেশনাল মেকানিক্সের অধ্যাপক অ্যান্টোনিও মুনজিযা। গবেষণা আর কম্পিউটারে ডিজাইন চলতে থাকে একসাথে। এটি সম্ভব হলে তা হবে বিশ্বে প্রথম, অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য সম্পূর্ণ নতুন কিছুÑ এ ছিল কাজের অনুপ্রেরণা। সাপ্তাহিক নির্ধারিত মিটিংয়ে আলোচনা করা হয় কাজের অগ্রগতি, সমস্যার খুঁটিনাটি এবং তা উত্তরণের উপায়। হালকা, মজবুত আর কম শক্তি ব্যয় এ তিন ল্যকে সামনে রেখে প্রস্তাব করা হয় অনেক ডিজাইন। কম্পিউটারে বিশ্লেষণ করে বেছে নেয়া হয় উপযুক্ত ডিজাইনটি। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয় সঠিক নির্মাণ উপাদান। দলের পাঁচ মাসের পরিশ্রমে তৈরি হয়ে যায় সোলার হেলিকপ্টার, নাম দেয়া হয়ে সোলারকপ্টার। পুরো সিস্টেমের ওজন দাঁড়ায় এক কেজিরও কম। ল্যাবে সোলারকপ্টারটি উড়ার মতা যাচাইয়ের জন্য তৈরি করা হয় হ্যালোজেন ল্যাম্পের সমন্বয়ে সান সিমিউলেটর। সিমিউলেটর অন করে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে অপারেশন শুরু করতেই ঘুরতে শুরু করে চারটি প্রপেলার, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বেইজ প্লাটফর্ম থেকে ওপরে উঠে আসে সোলার সোলারকপ্টার, বিশ্বের প্রথম সোলার হেলিকপ্টার। এ বছরের (২০১৩) ৬ মার্চ ডিপার্টমেন্টের ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিয়াজোন ফোরাম ডে তে ইউকের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিদের সামনে মাস্টার্সের ১৭ টি প্রজেক্ট উপস্থাপন করা হয় আর তাতে ন্যাশনাল ফিজিক্স ল্যাবরেটরির শ্রেষ্ঠ পুরস্কার জিতে নেয় সোলারকপ্টার। এর মধ্যে সোলারকপ্টারের খবর পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ফেসবুক আর ব্লগে লিংক দিয়েছেন উৎসাহীরা। ছয় হাজারের বেশি লোক ফেসবুকে অনুসরণ করছেন সোলারকপ্টার প্রজেক্ট। এদের কমেন্ট গ্রুপকে অনেক উৎসাহ যোগাচ্ছে। একইভাবে সোলারকপ্টারের ইউটিউব ভিডিও ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে উৎসাহীদের মধ্যে, এর দর্শক সংখ্যা এখন ১০ হাজার অতিক্রম করেছে। গিজম্যাগ, ফাস্ট কম্পানি, ডিজাইনবুম সহ বিশ্বের কয়েকটি নামকরা টেকনোলজি বিষয়ক ম্যাগাজিন সোলারকপ্টারের ওপর আর্টিকেল ছেপেছে। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিষয়ক অনুষ্ঠান ডিসকভারি চ্যানেলের ‘ডেইলি প্লানেট শো’ সোলারকপ্টারের ওপর একটি বিশেষ প্রতিবেদন সম্প্রচার করেছে। এ গবেষণাকে প্রয়োগ বা অ্যাপলিকেশন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এখন ড. হাসান শহীদের মূল ল্য। ইতোমধ্যে পরের ব্যাচের মাস্টার্সের ছাত্রছাত্রীদের জন্য নতুন কাজের তালিকা তৈরি করে প্রজেক্ট প্রস্তাব করেছেন। বর্তমান দলটিও তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষে গ্রীষ্মে আরো কিছু কাজ করতে পারবে বলে আশা করছেন তিনি। গ্রুপের কেউ কেউ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে তার অধীনে পিএইচডি গবেষণায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ক্যামেরা ও জিপিএস সিস্টেমের মতো পেলোড নিয়ে শুধু সূর্যের আলোর শক্তিতে মুক্ত আকাশে এ সোলারকপ্টার উড়ানো পরবর্তী চ্যালেঞ্জ। এটা সম্ভব হলে অপরাধ দমন, সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ (খোঁজা এবং উদ্ধার), গোয়েন্দাবিষয়ক পর্যবেণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, সুন্দরবনের মতো বড় জঙ্গল বা সাহারার মতো মরুভূমিতে জীবজন্তুর বিচরণ পর্যবেণ, আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য সংগ্রহ এমন অনেক কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়ে যাবে এ সোলারকপ্টার। নির্মাণ খরচ কম হওয়ায় অনেকে এ সিস্টেম ব্যবহারে উৎসাহী হবে। ভবিষ্যতে যাত্রী বা অতিরিক্ত ওজন বহনের সোলার হেলিকপ্টার উদ্ভাবনের ভিত্তি হিসেবে এ সিস্টেম কাজ করবে তাতে সন্দেহ নেইÑ এমনটাই মনে করছেন ড. হাসান শহীদ। ড. হাসান শহীদ আরো জানালেন, সোলারকপ্টারের মতো অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট রয়েছে তার। এটি হলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন ক্যাপসুল রোবট উদ্ভাবন। মানুষের শরীরের খাদ্যনালীতে (জিআই ট্রাক্ট) ক্যান্সার, রক্তরণ, আলসার ইত্যাদি রোগ নির্ণয়ে ব্যবহার করা হয় ক্যাপসুল রোবট। গিভেন ইমেজিং, অলিম্পাস, আর এফ সিস্টেমসহ বেশ কিছু বহুজাতিক কোম্পানির ক্যাপসুল রোবট বাজারে চালু রয়েছে। ক্যাপসুলের মতোই পানি দিয়ে গিলতে হয় এ রোবট এবং গেলার সাথে সাথে তা স্বাভাবিক খাবারের মতো নালীর ভেতর দিয়ে বাহিত হয়ে নির্দিষ্ট সময় পর শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এ সময়ে রোবটের ভেতরে সংযুক্ত ছোট ক্যামেরা প্রতি সেকেন্ডে কয়েকটি করে ছবি পাঠাতে থাকে শরীরের বাইরে। সে ছবি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার খাদ্যনালীর রোগ নির্ণয় করে থাকেন। পুরো সিস্টেমটি এন্ডোস্কোপির বিকল্প হিসেবে কাজ করে। তবে এ সিস্টেমের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। খাদ্যনালীর কোথাও কোনো রোগের লণ দেখা গেলে বিভিন্ন দিক থেকে ছবি তোলার জন্য এ রোবট সেখানে থামতে বা ঘুরতে পারে না। প্রয়োজনে এর গতিও বাড়ানো বা কমানো যায় না। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন ক্যাপসুল রোবট প্রয়োজন। এ কারণে থাকা চাই ক্যাপসুলের নিজস্ব চলার ব্যবস্থা। ক্যাপসুলে পা, চাকা বা ম্যাগনেট যুক্ত করে এমন চলার ব্যবস্থা অর্জনের গবেষণা করে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন রিসার্চ গ্রুপ। ড. হাসান শহীদের অধীনে এ গবেষণা চলছে অনেক দিন ধরে। সোলারকপ্টার গ্রুপের মতো এ বিষয়ে তার অন্য একটি মাস্টার্স প্রজেক্ট রয়েছে। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে এর মধ্যে খাদ্যনালীতে ক্যাপসুল রোবট চলার দু’টি বিশেষ পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এ নতুন উদ্ভাবনের ওপর ভিত্তি করে তিনি কুইন মেরির ইনোভেশস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। এ গবেষণাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অ্যাওয়ার্ড হিসেবে প্রাথমিক অনুদান ১০ হাজার পাউন্ড দেয়া হয়েছে। প্যাটেন্ট অ্যাপলিকেশনের জন্য কুইন মেরির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গবেষণার পাশাপাশি শিকতায় হাসান শহীদের বিশেষ কৃতিত্ব রয়েছে। কুইন মেরির ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ‘ইলেকট্রিক্যাল টেকনোলজি’ কোর্সে ‘প্রবলেম বেইজড লার্নিং’ বা ‘পিবিএল’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করে তিনি ২০১১ সালে কুইন মেরির ‘ড্রেপার্স প্রাইজ ফর ডেভেলপমেন্ট ইন লার্নিং অ্যান্ড টিচিং’ পুরস্কার পান। ইউনিভার্সিটির ‘ড্রেপার্স অ্যাওয়ার্ড ফর অ্যাক্সিলেন্স ইন টিচিং’-এর জন্যও তিনি কয়েকবার নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া কুইন মেরিতে তার তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন এ পর্যন্ত চারটি অনার্স প্রজেক্ট ‘ইনস্টিটিউশন অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর পুরস্কার পেয়েছেন। ড. হাসান শহীদ তার গবেষণা এবং সমাজসেবমূলক কাজের জন্য লন্ডনের বাংলা কমিউনিটিতে বেশ সুপরিচিত। তার জন্ম বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানার হানুয়া গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ ইসমাইল সিকদার এবং মা বেগম সাইদুন্নেছা। পারিবারিক জীবনে তিনি এক মেয়ে ও এক ছেলের জনক। স্ত্রী মোহসিনা মাহমুদা ফেরদৌস লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে এমএসসি সম্পন্ন করে এখন ব্রুনেল ইউনিভার্সিটিতে বায়োইনফর্মেটিক্স বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গ্লাক্সোস্মিথকাইন এ গবেষণার স্পন্সর। ড. হাসান শহীদ বরিশাল ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীায় যশোর বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যাবিদ্যালয়ের ‘অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স, ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বিএসসি (অনার্স) ও এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। রোবটের হাত নিয়ন্ত্রণের ওপর গবেষণা করে তিনি শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। বিজ্ঞান ও সমসাময়িক বিষয়ে তিনি লেখালেখি করে থাকেন। সময় প্রকাশনী থেকে ২০০৭ সালে তার বই এলিয়েন : সম্ভাবনা ও সন্ধান এবং ২০০৮ সালে মহাবিস্ময়ের মহাকাশ প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় তিনি মাসিক কম্পিউটার জগৎ পত্রিকার কন্ট্রিবিউটিং এডিটর ছিলেন। এ সময়ে প্রকাশিত কম্পিউটার বিজ্ঞান (প্রশ্ন-উত্তরে) এবং মাধ্যমিক কম্পিউটার শিা বই দুটির তিনি সহলেখক। লন্ডনের স্প্রিংগ্রার প্রকাশিত প্যারালাল কম্পিউটিং ফর রিয়েল-টাইম সিগনাল প্রসেসিং অ্যান্ড কন্ট্রোল বইটিরও তিনি সহলেখক। ড. হাসান শহীদ ১৯৬৯ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেছেন। ১৯৯৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তিনি ব্রিটেন গেছেন। শেফিল্ড ইউনিভার্সিটিতে রোবটের হাত নিয়ন্ত্রণের ওপর পিএইচডি গবেষণা করেছেন। ২০০১ সাল থেকে কুইন মেরিতে শিক্ষকতা করছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button