ট্রাম্প যে কোন মূল্যে ফিলিস্তিনে তার উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে চান
২০২৫ সালের জুলাই মাসে আইওয়ার ডেস ময়েনে একটি সমাবেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প এক চমকপ্রদ শব্দচয়ন ব্যবহার করেছিলেন। সদ্য পাস হওয়া তার কর এবং ব্যয় সংক্রান্ত বিলের সুবিধাগুলি প্রচার করার সময় তিনি বলেন: “কোনো মৃত্যু কর নেই, কোনো এস্টেট ট্যাক্স নেই, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে না—কিছু ক্ষেত্রে ভালো ব্যাংকারদের থেকে, আর কিছু ক্ষেত্রে শাইলকস ও খারাপ লোকদের কাছ থেকে।”
“শাইলক” শব্দটি আসলে শেক্সপিয়ারের দ্য মারচেন্ট অব ভেনিস নাটকের এক ইহুদি মহাজনের চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত, যা বহুলভাবে একটি ইহুদি–বিদ্বেষী প্রতীক হিসেবে পরিচিত। অ্যান্টি–ডিফেমেশন লিগ ট্রাম্পকে এ মন্তব্যের জন্য সমালোচনা করে। ট্রাম্প অবশ্য পরে দাবি করেন, তিনি শব্দটির ইহুদি–বিরোধী অর্থ জানতেন না।
এটিকে নিছক একবারের ভুল বলা যেত, কিন্তু বাস্তবে এটি ট্রাম্প ও তার “মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন” (মাগা) আন্দোলনের সাথে যুক্ত ইহুদি–বিদ্বেষের বড় একটি ধারার অংশ। এনপিআর ২০২৫ সালের মে মাসে জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা প্রকাশ্য বা গোপনে ইহুদি–বিদ্বেষী চরমপন্থীদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
একই সময়ে, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মাস্কও তার গ্রক এআই–বটের মাধ্যমে হিটলারকে প্রশংসা করে ইহুদি–বিদ্বেষী বক্তব্য দেওয়ায় বিতর্কে জড়ান।
এমনকি, ট্রাম্প প্রশাসনের প্রকাশ্য নীতি “ইহুদি–বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই” হলেও, তা প্রায়ই ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। ২৯ জানুয়ারি ২০২৫–এ ট্রাম্প “অ্যাডিশনাল মেজারস টু কমব্যাট অ্যান্টি–সেমিটিজম” শিরোনামে এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন, যা ব্যবহার করে প্রো–প্যালেস্টাইন ছাত্র আন্দোলনকারীদের (যেমন মাহমুদ খালিল) বহিষ্কারের পথ তৈরি হয়।
তারও আগে, ট্রাম্প ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইরানে বোমাবর্ষণ করেন এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনাও ভেঙে দেন।
মাস্কও বাধ্য হন ইসরায়েলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে—তিনি ২০২৩ সালের নভেম্বরে হামাস আক্রমণের স্থানগুলোতে গিয়ে প্রচারমাধ্যমে বড়সড় সফর করেন।
অদ্ভুত জোট: মাগা আন্দোলন ও ইসরায়েল:
এই আপাতবিরোধী সম্পর্ক কীভাবে বোঝা যায়? বিশ্লেষকরা সাধারণত দুটি কারণের দিকে ইঙ্গিত করেন। (১) প্রভাবশালী ইসরায়েলপন্থী লবি, দাতা, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা।(২) মাগা আন্দোলনের খ্রিস্টান জায়নিস্টরা, যেমন বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি।
হাকাবি প্রকাশ্যে বলেছেন, তার ইসরায়েলপন্থী অবস্থান ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এসেছে—তিনি মনে করেন শেষ বিচার (র্যাপচার) নিকটবর্তী, আর ইসরায়েল সেই বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণীর কেন্দ্র।
তবে শুধু লবি বা ধর্ম নয়, আরও গভীর কিছু কাজ করছে। মাগা–ইসরায়েল জোট আসলে ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রকল্প। তারা উপনিবেশবাদের অপরাধগুলো চাপা দিতে ও ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়।
ঔপনিবেশিক অতীত ও ট্রাম্পের নস্টালজিয়া:
ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট জেমস কে. পোলকের ছবি টানিয়েছিলেন—যিনি ১৮৪০-এর দশকে মেক্সিকো যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভূখণ্ড দখল করেন। মাগা দৃষ্টিতে সেই ঔপনিবেশিক যুগ “শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি” এনেছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী ডিকলোনাইজেশনের ঢেউ এই মানসিকতাকে উল্টে দেয়। জাতিসংঘ সনদে উপনিবেশবাদকে অন্যায় বলা হয় এবং নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো জন্ম নেয়।
মাগা আন্দোলন এই ইতিহাস মেনে নিতে চায় না। তারা আমেরিকার বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ভূমিকা ব্যবহার করে দাবি করে, উপনিবেশবাদ নিয়ে সমালোচনা তাদের প্রযোজ্য নয়।
হলোকাস্ট ও ইসরায়েলের প্রতীকী ভূমিকা:
হলোকাস্ট–পরবর্তী ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পশ্চিমা শক্তিগুলোকে একধরনের নৈতিক মুক্তি দেয়। তারা ভাবে, ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র গড়ে দিয়ে অতীতের অপরাধ তারা পুষিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এর ফলে আফ্রিকা, এশিয়া ও আমেরিকায় পশ্চিমাদের উপনিবেশিক গণহত্যা আড়ালে থেকে যায়। কঙ্গোতে ১ কোটি, ব্রিটিশ ভারতে ৩০ লাখ, আর আমেরিকার আদিবাসীদের কয়েক মিলিয়ন মৃত্যু—এসব কোনো বড় স্বীকৃতি পায় না।
আজকের দিনে ফিলিস্তিনই একমাত্র উপনিবেশ, যা কখনো পূর্ণ ডিকলোনাইজেশনের মধ্য দিয়ে যায়নি। এ কারণে ইসরায়েলকে “সেটলার–কোলোনিয়াল স্টেট” বলা হলে এত বিতর্ক হয়।
মাগা দৃষ্টিতে ইসরায়েল এক আদর্শ—যা উপনিবেশিক আধিপত্য বজায় রেখে স্থানীয় প্রতিরোধ দমন করে। তাই তারা ইসরায়েলকে সমর্থন করে, তার উপনিবেশবাদী চরিত্রের বিরুদ্ধেও নয়, বরং সেই কারণেই।
বিশ্ব রাজনীতি ও নতুন ঔপনিবেশিক নস্টালজিয়া
মাগা আন্দোলনের নস্টালজিয়া কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নয়। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করেছেন পুরনো সাম্রাজ্য পুনর্গঠনের মানসে।
ব্রাজিলে জাইর বোলসোনারো আমেরিকান উপনিবেশিক সেনাদের প্রশংসা করেছেন এবং আমাজনের আদিবাসীদের গণহত্যা অস্বীকার করেছেন। মার্কো রুবিও এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিশ্ব আবার “বহুমেরু সাম্রাজ্যিক প্রতিযোগিতার” যুগে ফিরবে।
এসব প্রবণতা একসাথে দেখায়—মাগা–ইসরায়েল জোট আসলে উপনিবেশবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা।
শেষ কথা:
ফিলিস্তিন কেবল বিতর্কিত ভূমি নয়; এটি পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক অতীতের শেষ আয়না। সেই আয়নায় মুখোমুখি হওয়া এড়াতে মাগা ও তাদের মিত্ররা আয়নাটাই ভেঙে দিতে চায়।
প্যালেস্টাইনপন্থী কণ্ঠস্বরকে নীরব করা হচ্ছে কারণ তারা ভুল বলছে বলে নয়, বরং তারা স্মরণ করিয়ে দেয় বলে। আর সেই স্মরণশক্তি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী কাহিনী ভেঙে দিতে পারে। -কাইল জে. অ্যান্ডারসন, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক (সানি) ওল্ড ওয়েস্টবারি-এর ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং The Egyptian Labor Corps: Race, Space, and Place in the First World War (ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস প্রেস, ২০২১) গ্রন্থের প্রণেতা।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



