মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক তৎপরতার লক্ষ্য

USA in Asiaইয়াজিদি সম্প্রদায়ের নাম এর আগে খুব কমই শোনা গেছে। ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাদের বসবাস সম্বন্ধে মার্কিনী এমনকি ইউরোপীয়দের খুব কমই ধারণা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইরাকে মার্কিন সেনাবাহিনীর হামলা চালানোর মোক্ষম কারণে পরিণত হয়ে উঠেছে ঐ ইয়াজিদিদের জীবনে নেমে আসা কথিত ধ্বংস ও দুর্দশা। পশ্চিমা ও মার্কিন সংবাদ মাধ্যম খবর ছড়িয়েছে যে, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ৪০ হাজার ইয়াজিদি সানজর পর্বতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বলা হয়, যে কোনো সময় আইএসের হাতে  সমূলে নির্মুল হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলো ঐ খবর সমর্থন করে। ইয়াজিদিদের বাঁচাতে তৎপর মার্কিন নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের নির্দেশে মার্কিন সেনাবাহিনী।
আইএস’র ঠিকানায় বোমাবর্ষণ মার্কিন বিমানবাহিনী শুরু করে জুনের মাঝামাঝি। তিন বছর আগে লিবিয়াতেও এভাবেই বোমা হামলা শুরু করেছিল মার্কিনীরা। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বেনগাজী শহরের লোকজন মুয়াম্মার গাদ্দাফির বাহিনীর হাতে সবংশে ধ্বংস হতে যাচ্ছে এই পশ্চিমা প্রচারণার ভিত্তিতে মার্কিন ও পশ্চিমা বাহিনী লিবিয়ায় সশস্ত্র হস্তক্ষেপে তৎপর হয়। যার পরিণামে বেশুমার লিবিয়ান নিহত হন এবং ব্যাপক ধ্বংস চালিয়ে যাওয়া হয় দেশটিতে। সংঘর্ষ-সংঘাত, খুন ও বিপর্যয় তখন থেকে লিবিয়ানদের জীবনসঙ্গী হয়ে রয়েছে।
বর্তমানে লিবিয়ায় শাসন কর্তত্বে রয়েছে দু’টো সরকার এবং দু’টো পার্লামেন্ট। মিলিশিয়া বাহিনীর সংখ্যা কয়েক শ’।
এক পর্যায়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনী সনজর পর্বতের চূড়ায় গিয়ে হাজির হয়। তারা দেখে মাত্র ৫ হাজার ইয়াজিদি সেখানে উপস্থিত রয়েছে- যাদের অর্ধেক হলো শরণার্থী। খবরটি মার্কিন ও পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না- বিধায় এর প্রচারে তারা বিরত থাকে। আইএস-এর হাতে ইয়াজিদিদের নির্মূল হওয়ার আশঙ্কা এবং ঐ বাহানায় ইরাকে মার্কিন হামলার যৌক্তিকতা সাব্যস্ত করার মতো খবর দরকার ছিল মার্কিন ও পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর। সে সংবাদ ইতোমধ্যেই তাদের যোগাড় হয়েছে।
ইরাকে প্রথম মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের কথা প্রসঙ্গত স্মরণ করতে হয়। একই সঙ্গে উল্লেøখ করতে হয়, ইরাকে প্রথম গণসংহার ১৯৯০-৯১-এ শুরু করে মার্কিনীরা। তখন ইরাকে আরোপিত দশকব্যাপী মার্কিন অবরোধে ইরাকী অর্থনীতিতে ও জনজীবনে কী পরিণাম দুর্দশা নেমে আসে, তা সবাই জানেন।
এর পর পর ইরাকে চাপানো হয় মারাত্মক যুদ্ধ ২০০৩ সালে। ইরাকে সর্বাত্মক ও সশস্ত্র মার্কিন আগ্রাসনে গণনিধন সংঘটিত হওয়ার ঘটনা লক্ষ্যণীয়ভাবে তখন কোনো মার্কিন বা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে বর্ণিত হতে দেখা যায়নি। লাখো বেসামরিক ইরাকী তখন অকারণে মৃত্যুবরণ করেন। কতো লাখ ইরাকী জখম ও পঙ্গু হন তার ইয়ত্তা থাকেনি। বস্তুত বর্তমান ইরাকে আইএস-এর তৎপরতার পেছনে ২০০৩-এর ঐ মার্কিন বর্বর আগ্রাসনই কাজ করে ইন্ধন হিসেবে এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয় মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় ইরাকী শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শিয়া প্রশাসনের বছর বছরব্যাপী সুন্নিদের ওপর অন্যায় ও নিপীড়ন। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় সুন্নি যোদ্ধাদের যা আইএসয়ের চলমান তৎপরতার পেছনের ঐ পরিস্থিতিটিকেও মার্কিন ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো পুরোপুরি আড়াল করে গেছে। তিন বছর ধরে যুদ্ধ চলছে সিরিয়ায়। যুদ্ধের কারণ খুঁজে দেখার অথবা যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ মার্কিনীদের তরফে এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। আলেপ্পো বা ইয়ারমুকে ব্যাপক নরসংহারের খবর সারা বিশ্ব জেনেছে। কিন্তু ঐ হত্যকাণ্ড গুলো মার্কিন নেতৃত্বের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে গৃহীত হয়নি। হত্যাকারীদের শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে মার্কিনীদের এগিয়ে আসতেও দেখা যায়নি। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার ১৩তম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ভাষণে আইএসয়ের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধযাত্রা করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন ওবামা। অর্থাৎ ইরাক পরিস্থিতিতে আবার সরাসরি হস্তক্ষেপে উদ্যত হচ্ছে মার্কিন প্রশাসন। ওবামার ভাষায় আইএসকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানেই গিয়ে সমর তৎপরতা চালাবে মার্কিনীরা। এর আগে আল কায়েদাকেও এভাবেই নির্মূল করতে তৎপর হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আল কায়েদা বিরোধী যুদ্ধকে “সন্ত্রাস দমন যুদ্ধ” আখ্যা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আল কায়েদা ধ্বংস হয়নি। হয়নি যে তার জ্বলন্ত প্রমাণ ইরাকে ও সিরিয়ায় ‘আইএসআইএলয়ের চলমান তৎপরতা।
আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী বিষয়ক ভাষ্যকারদের একটি অংশের অভিমত হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের তোলা সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ খণ্ডনের উদ্দেশ্য এবং নবেম্বরে সিনেট নির্বাচনে দলীয় বিপর্যয় রোধের উদ্দেশ্যে ইরাকে আইএস দমনের সাড়ম্বর যুদ্ধায়োজনে তৎপর হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ভাষ্যকাররা এই প্রশ্নও তুলেছেন, আইএস যোদ্ধাদের হাতে ইয়াজিদিদের সর্বাংশে নির্মূল হয়ে যাবার আশঙ্কায় যে মার্কিনী ও পশ্চিমারা এতো গভীরভাবে আকুল হয়ে উঠতে পারেন, ইসরাইলের হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনীর প্রাণহানিতে তারাই এতো নির্বিকার থাকতে পারেন কীভাবে? ২১৫০ য়ের বেশি যাদের ৮০ শতাংশ নির্দোষ বেসামরিক মানুষ- ফিলিস্তিনী ইসরাইলী হামলায় নিহত হন। আহত হন ১১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনী-যাদের অধিকাংশই শিশু। পাঁচ লাখ বিশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
মার্কিনী ও পশ্চিমাদের চোখে গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসন গণনির্মূূলীকরণ অভিযান হিসেবে দেখা দেয়নি। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটন, লণ্ডন, প্যারিস ও রোম সমস্ত স্থান থেকে গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসনকে গাজা থেকে রকেট ছোড়ার অজুহাতে যুক্তিযুক্ত দেখানো হয় এবং ইসরাইলকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে উৎসাহিত করা হয়।
কাল, পাত্র ও ক্ষেত্রের ভিত্তিতে গণসংহারের এক একটি ঘটনা একএক অর্থ-তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয় মার্কিনী ও পশ্চিমাদের সামনে। ২০০৩ ও পরবর্তী কয়েক বছর ইরাকে মার্কিন সংঘটিত গণনিধন তাদের দৃষ্টিতে গণসংহার ছিল না। মার্কিনীদের ভাষায় ইরাকে সে সময়ের মার্কিন সামরিক তৎপরতা ছিল- ইরাকীদের মুক্ত স্বাধীন জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং ইরাকীদের গণতন্ত্র চর্চা শেখানোর জন্য। ইরাকে ও সিরিয়ায় আইএসআইএলয়ের তৎপরতাই হচ্ছে তাদের চোখে আসল গণসংহার। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্র সীমানাগুলোকে সমকালীন মার্কিন পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক ও রণনৈতিক স্বার্থের অনুকূলে নতুনভাবে আর একবার অংকন- বণ্টনের লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ তৎপরতায় সম্পৃক্ত হয়েছে এবার মার্কিন ও পশ্চিমা যুদ্ধ প্রভুরা। তাদের এই প্রয়োজন পূরণের নিরিখেই এবার আবার গণনিধনের স্বরূপ একবার চিহ্নিত হতে হবে এবং তদনুযায়ী সমর তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া হবে- নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের এই মূল্যায়ন খণ্ডন খুব সহজ হবে না। -আরব নিউজ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button