সৌদি আরবের ৯০তম জাতীয় দিবস আজ

আজ ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের ৯০তম জাতীয় দিবস। দিবসটি মূলত সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠা দিবস। ইতিহাস বলছে, আয়তনের দিক থেকে এশিয়া মহাদেশের ৫ম এবং আরব বিশ্বের ২য় বৃহত্তম দেশ সৌদি আরব। সৌদি আরব শুধু তার আয়তনের দিক থেকে নয় বরং বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও প্রভাবের দিক থেকেও অন্যতম বৃহৎ শক্তি। বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলিমদের সেবা, উন্নয়ন ও স্বার্থ সংরক্ষণে সৌদি আরবের অবদান অনস্বীকার্য ও অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বেশি। কিন্তু আজকের এই সৌদি আরব একদিনে গড়ে ওঠেনি। পৌনে তিন শতাব্দী পূর্বে ১৭৪৪ সালে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহ্হাব (রহ.)-এর যৌথ প্রচেষ্টায় প্রথম সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৮১৮ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো। পরবর্তীতে প্রথম সৌদী রাষ্ট্র কিছু বছরের জন্য ধ্বংস হলেও ১৮২৪ সালে নাজ্দ কেন্দ্রিক ছোট আকারে দ্বিতীয় সৌদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিংশ শতাব্দির শুরুতে “ইবনে সউদ” নামে খ্যাত বাদশাহ আব্দুল আযীয বিন আব্দুর রহমান আলে সউদ (রহ.)-এর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় তৃতীয় বা আধুনিক সৌদি আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পূর্ণতা লাভ করে ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। সেই থেকেই ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জাতীয় দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
এক নজরে সৌদি আরব
সরকারি নাম: আল মামলাকাতুল আরাবিয়্যাতুস সাউদিয়া (রাজকীয় সৌদি আরব)
আয়তন: প্রায় ২২,৪৮,০০০ বর্গ কিলোমিটার বা ৮,২৯,৯৯৬ বর্গ মাইল। যার ব্যাস উত্তর থেকে দক্ষিণে ১৮৪৩ কিলোমিটার ও পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২০৭৬ কিলোমিটার। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ইহার উচ্চতা ৩১৩৩ মিটার। সর্বোচচ স্থান আবহা প্রদেশের আসীর অঞ্চল।
ভৌগোলিক সীমারেখা:
উত্তরে জর্দান ও ইরাক, দক্ষিণে ওমান ও ইয়েমেন, পূর্বে কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও আরব সাগর, পশ্চিমে লোহিত সাগর।
ভূমিরূপ: প্রধানত: চারভাগ। তন্মধ্যে (১) হিজায ও আছির এলাকার পাহাড়ী অঞ্চল, (২) নজদ এলাকার উঁচু ভূমি, (৩) বালুময় মরুভূমি এবং (৪) পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় সমতল ভূমি।
রাজধানী: রিয়াদ
সাউদী আরবে ১৩টি প্রাদেশিক প্রশাসনিক রাজধানী ও ১১৮টি জিলা রয়েছে। প্রশাসনিক রাজধানী গুলো:
(১) রিয়াদ, (২) পবিত্র মক্কা, (৩) মদিনা আল মুনাওয়ারা, (৪) কাসিম, (৫) পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় সমতল, (৬) আছার, (৭) তাবুক, (৮) হাইল, (৯) উত্তর সীমান্তবর্তী অঞ্চল, (১০) জিজান, (১১) নাজরান, (১২) আল-বাহা ও (১৩) আল-জাউফ।
২. মক্কা মুকাররমা:
প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৬৪ ঈসায়ী, জিলা সংখ্যা-১২। (১) মক্কা মুকাররমা, (২) জেদ্দা, (৩) তায়েফ (১৩৯৭/১৯৭৭), (৪) কনফুজা, (৫) লাইছি, (৬) রাবিগ, (৭) জুমুম, (৮) খলীছ, (৯) কামিল, (১০) খরমা, (১১) রনীহ ও (১২) তুরবাহ।
মদীনা মুনাওয়ারা:
প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৩ ঈসায়ী, জিলা সংখ্যা-৭। মদীনা মুনাওয়ারা (২) ইয়াম্বুল বাহর (৩) উলা (৪) মাহদ (৫) বদর (৬) খায়বার (৭) হানাকিয়া। ৪. উত্তর সীমান্তবর্তী অঞ্চল।
ধর্ম: সৌদি আরবের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সৌদী পরিচয় বহনকারী প্রায় সকলেই মুসলমান। তাদের হার ৯৮.৮%। তাদের অধিকাংশই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারী। কিছু সংখ্যক বহিরাগত খ্রিস্টান রয়েছে যার হার ০.৮% ও অন্যন্য ধর্মাবলম্বীদের হার ০.৪%। সেখানে অবস্থানরত অমুসলিম জনগণও তাদের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার পুরোপুরিভাবে ভোগ করছে।
ভাষা: আরবী, তবে আরবীর পাশাপাশি বর্তমানে ব্যাপকহারে ইংরেজীর ব্যবহার লক্ষণীয়।
জনসংখ্যা: ২,৮৬,৮৬,৬৩৩ জন (২০১০ সাল) জন্ম বৃদ্ধির হার ১.৮% যার আন্তর্জাতিক হার ১৫.৭ (প্রতি হাজারে), জন্মের হার ২৮.৫ যা আন্তর্জাতিক হার ২৫ ও প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ১১.৫ যার আন্তর্জাতিক হার ৯.৩, গড় আয়ু পুরুষ : ৭৪ বছর, মহিলা: ৭৮ বছর, প্রতি বর্গমাইলে জন বসতির ঘনত্ব ২৯ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জন বসতির ঘনত্ব ১৪ জন (২০০৯)।
জনশক্তি: ৬০,৪৯,০০০ জন, তন্মধ্যে শতকরা ৩৫ জন বিদেশী। শিল্পক্ষেত্রে শতকরা ২৫ ভাগ, চাকরিক্ষেত্রে শতকরা ৬৩ ভাগ ও কৃষিক্ষেত্রে শতকরা ১২ ভাগ (২০০৫ সাল)।
জাতীয় সঙ্গীত: রাজকীয় সালাম যা ইসলামের মহানুভবতায় দেশপ্রেমকে উজ্জীবিত করণের ও দেশের উন্নতিকল্পে দায়িত্ববোধ জাগ্রতকরণের বিষয় সম্বলিত। তবে এর ঘনঘটা ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় না।
জাতীয় পরিচয়: সৌদী
স্থানীয় সময়: +৩ ঘন্টা অর্থাৎ বাংলাদেশের দুপুর ১২টায় সৌদিতে সকাল ৯টা।
জাতীয় পতাকা: পতাকার রং সবুজ। দৈর্ঘের দুই-তৃতীয়াংশ প্রস্থ। এর উপরের অংশে সাদা রঙে তাওহীদের মর্মবাণী- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ” (আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্যিকারের ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল) এ কালিমা আরবীতে উৎকীর্ণ রয়েছে। কালিমার নিচেই একটি কোষমুক্ত তরবারী অংকিত রয়েছে যা দ্বারা ন্যায় বিচারকে বুঝানো হয়েছে। তরবারি আকার হবে কালিমার তিন-চতুর্থাংশের সমান। এ কালিমা উৎকীর্ণ থাকায় সৌদি আরবের পতাকা কখনো অর্ধনমিত করা হয় না। সবুজ রং ইসলামের ঐতিহ্যের দিকে ইঙ্গিতবহ।
জাতীয় প্রতীক: গোল বৃত্তের মাঝে আড়াআড়ি দুইটি তরবারীর উপর একটি খেজুর গাছ হলো সৌদি আরবের জাতীয় প্রতীক। খেজুর গাছ দ্বারা বুঝানো হয়েছে সমৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি। আর তরবারী দ্বারা ন্যায় বিচার, শক্তি ও নিরাপত্তা বুঝানো হয়েছে।
জাতীয় পঞ্জিকা : মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণার্থে রচিত হিজরী সন অনুযায়ী সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। ৩৫৪ দিনে ও ১২ মাসে এক চন্দ্র হিজরী বর্ষ গণনা করা হয়। ঈদ ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি এই হিজরী তারিখ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বর্তমানে আরবীর পাশাপাশি ইংরেজী তারিখ অনুযায়ী করা হয়।
সরকারী ছুটি: সাপ্তাহিক ছুটি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার। এছাড়াও ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, হাজ্জ ও জাতীয় দিবসে সরকারী ছুটি রয়েছে।
আবহাওয়া: তাপমাত্রা ১২ থেকে ৫১ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠানামা করে। বৃষ্টিপাত বিক্ষিপ্ত ও অনিয়মিত। দীর্ঘস্থায়ী উষ্ণ ও শুষ্ক গ্রীষ্ম কাল। রাতে তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। শীতকালে হালকা তুষারপাত হয়।
জাতিসত্ত্বা : আরব ৯০%, আফ্রিকা -এশীয় ১০%।
মুদ্রা: সাউদী রিয়াল। ১০০ হালালায় ১ রিয়াল।
ব্যাংক: সাউদী আরবে বর্তমানে ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে।
সংবিধান: ইসলামী আইন (শরীআ) মুতাবিক রচিত, ১৯৯৩ সালে এতে সরকারের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত ধারা ও উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে বাইয়াত কমিটি গঠন করা হয়।
কৃষি: কৃষি ক্ষেত্রে সউদী আরব অতি অল্প সময়েই দ্রুত উন্নয়ন সাধিত করেছে। বর্তমানে অন্যতম কৃষি পণ্য হলো পোল্ট্রি ফার্ম, খেজুর, তরমুজ ও দুধ। বর্তমানে অধিক হারে তরিতরকারী উৎপন্ন হচ্ছে। যদিও সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন- স্বল্প বৃষ্টি, ভূগর্ভস্থ পানির স্বল্পতা, সউদী জনগণের কৃষির প্রতি অনীহা, কৃষিযোগ্য ভূমিসমূহ অধিক বালুকাময় বা অনেক উঁচু ও অনেক নিচু। তবুও কৃষি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিনামূল্যে জমি বিতরণ করে দেয়ায় উহা চাষের আওতায় এসেছে। উপরন্ত বিনা সুদে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয় এবং উৎপাদিত ফসল সরকার অতি উচ্চ মূল্য দিয়েই সরাসরি কৃষক থেকেই ক্রয় করে নেয়। বাদশাহ আবদুল্লাহ সাম্প্রতিক এ বিষয়টির প্রতি খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। কাজেই কৃষি খাত সাউদী আরবে বর্তমানে একটি লাভজনক খাত। বর্তমানে সেখানে বিপুল পরিমাণ গম, আলু, ডিম, টাটকা দুধ ও মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। সাউদি আরবের প্রতিটি জনগণ প্রতি বছর ৫৪.৪ কেজি লাল গোশত ও মুরগির গোশত খাচ্ছে। ১৪৩২-১৪৩৩ হিজরী অর্থ বছরে দেখা যায় যে, কৃষি খাত জিডিপিতে ৬.১% অবদান রাখছে। আর ইহা অতৈল খাতে ৪.৪% ভাগ।
সউদী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও শাসকবৃন্দ: আব্দুল আযীয বিন আব্দুর রহমান বিন ফয়সাল আল সাউদ। যিনি ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ নবেম্বর পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৪ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। তিনি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে শাসক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন এবং তাঁর শাসনামলেই ১৯৩২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর সব গোত্র ও প্রদেশসমূহ একত্রিকরণ করা হয়। সে জন্য প্রতি বছর ২৩ সেপ্টেম্বরই সাউদি আরবের জাতীয় দিবস উদযাপন করা হয়। (২) তাঁর মৃত্যুর পর তার ছেলে সাউদ বিন আবদুল আযীয ০৯.১১.১৯৫৩ থেকে ০২.০১.১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১১ বছর শাসন করেন। (৩) তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই ফয়সাল বিন আবদুল আযীয ০২.০১.১৯৬৪ থেকে ২৫.০৩.১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১১ বছর শাসন করেন। (৪) তাঁর হত্যাকান্ডের পর তাঁর ভাই খালিদ বিন আবদুল আযীয ২৫.০৩.১৯৭৫ থেকে ১৩.০৬.১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৭ বছর শাসন করেন। (৫) ) তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই ফাহাদ বিন আবদুল আযীয ১৩.০৬.১৯৮২ থেকে ০১.০৮.২০০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ২৩ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। (৬) ) তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ভাই আবদুল্লাহ বিন আবদুল আযীয ২০০৫ সালের ১ আগস্ট থেকে অদ্যাবধি শাসনকার্য পরিচালনা করছেন।
পবিত্র কাবা ও মাসজিদে নববীর মহামান্য ইমামগণ : হারামাইন শারীফাইনের ইমামগণ সাউদি আরবে মন্ত্রীর সমপর্যায়ের মর্যাদা লাভ করে থাকেন। সুতরাং সমাজে তাদেরকে খুবই সম্মান দেখানো হয়।
বৈদেশিক সম্পর্ক : সাউদী আরব তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বিভিন্ন দেশে তার দূতাবাস খুলেছে। বর্তমানে ৫৭টি দেশে সাউদী দূতাবাস আছে।
বর্তমানে সাউদি আরবে ১০১ টি দেশের দূতাবাস আছে।
বিচার ব্যবস্থা: ইসলামী আইন অনুযায়ী বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়।
শিক্ষা: শিক্ষার হার ৯৫%। তন্মধ্যে পুরুষ- ৮৪.৭%, মহিলা-৭০.৮%। সউদী আরব আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত সকল নাগরিকের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা। বর্তমানে সউদী আরবের বাজেটের ২৫% এ খাতের জন্য বরাদ্দ।
অর্থনীতি: সউদী অর্থনীতি মূলতঃ তেল কেন্দ্রিক। বিশ্বের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ সউদী আরবের ৯০% ভাগের বেশি আয় আসে তেল রপ্তানি থেকে এবং ৭৫% ভাগ আসে রাজস্ব থেকে। দাহরানে অবস্থিত আরামকো সৌদী তেল ব্যবস্থাপনার সরকারি কোম্পানী।
প্রাকৃতিক সম্পদ: তেল ও গ্যাস সউদি আরবের প্রাকৃতিক সম্পদ। বর্তমানে প্রতিদিন ১১ মিলিয়ন ব্যারেল করে তেল উৎপাদন হচ্ছে। বর্তমানে গ্যাসের মওজুদ ১৮০.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এছাড়াও সেখানে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, দস্তা, সীসা, লোহা, এলমুনিয়াম, ইউরেনিয়াম, শিল্পের কাঁচামাল, ফসফেট, কয়লা, পাথর ও নির্মাণ সামগ্রীর বিশাল মওজুদ মরুময় দেশটিতে আছে।
শিল্প: বর্তমানে সৌদি আরবে দুই ধরণের শিল্প আছে। (১) ভারী (২) মাঝারি। ভারী শিল্পের মধ্যে রয়েছে তৈল শোধনাগার যা বছরে ৬৫২ মিলিয়ন ব্যারেল তৈল পরিশোধন করে।
পাশাপাশি বিটুমিন শিল্প যা ১৯৯০ পর্যন্ত ১৪ মিলিয়ন টন উৎপাদন করেছে। মাঝারি শিল্পের মধ্যে রয়েছে খাদ্যদ্রব্য, নির্মাণ সামগ্রী, রাসায়নিক ও খনিজ দ্রব্য। যা দেশটিকে দ্রুত শিল্পায়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুদবিহীন শিল্পঋণ প্রদান, কারখানার জন্য জায়গা ভাড়া প্রদান, সকল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শিল্প এলাকায় শ্রমিকদের বাসস্থান নির্মাণ, নামমাত্র মূল্যে সমস্ত চাহিদা যোগান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রয়ের ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত দ্রব্যাদির অগ্রাধিকার দেয়া হয়। যাকাত ব্যতীত সকল প্রকার শুল্ক মাফ করা হয়। বর্তমানে মাঝারি আয়তনের শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ২৩০০টি। সেখানে বিনিয়োগ রয়েছে ২৬ বিলিয়ন ডলার। সেখানে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার।
বিদ্যুৎ: সৌদি আরবের সব আবাদী এলাকায় ইতোমধ্যেই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় এসেছে। ২০০৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৮১০৯৮ মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত বিদ্যুতের ৫৩% বাসা-বাড়ি, ১২% বাণিজ্যিক, ১১% সরকারী, ১৮% শিল্প, ২% কৃষি এবং ৪% অন্যান্য খাতে ব্যবহৃত হয়।
বহির্বাণিজ্য : সৌদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর ২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী সৌদি আরবের সাথে বর্তমানে বিশ্বের ১৪২ টি দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে।
রপ্তানি: ২০১০ সালে ২৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। সৌদি আরব তার রপ্তানি আয়ের ৯০% তৈল ও তৈলজাত দ্রব্য থেকে অর্জন করে, যা জাতীয় বাজেটের ৭৫%। এ ছাড়াও পেট্রোরসায়ন, সার, ধাতব পদার্থ, গম, খেজুর, ডিম, মুরগির গোশত, দুধ, শাক-সবজি, সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রী। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, সৌদি আরব এশীয় দেশের নিকট ৪৯.৯%, উত্তর আমেরিকা ১৫.৮% পশ্চিম ইউরোপ ১৩.৩%, জিসিসিভুক্ত দেশসমূহে ৭.৪% ও আরবলীগের দেশসমূহে ৫.৩% দ্রব্যাদি রপ্তানি করে। সৌদি আরব বাংলাদেশে তেল ও সার রপ্তানি করে থাকে।
আমদানি: ২০১০ সালে ৯৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্রব্যাদি আমদানি করা হয়। এর মধ্যে আমদানি দ্রব্যের অন্যতম হলো- নির্মাণ সামগ্রী, যানবাহন, গৃহস্থালী আসবাব-পত্র, বস্ত্র ও তৈরি পোশাক, তৈরি খাদ্য সামগ্রী ও মসলা, অলংকার আমদানি করে।
আকাশ পথ : সৌদী জাতীয় বিমান সংস্থার নাম:
সৌদী এয়ার লাইন্স বিমান বন্দর মোট ২৭ টি। তন্মধ্যে ৪ টি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। যথা- (১) বাদশাহ আব্দুল আযীয বিমান বন্দর, জিদ্দা (২) বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আযীয বিমান বন্দর, রিয়াদ (৩) বাদশাহ ফাহাদ বিমান বন্দর, দাম্মাম (৪) আমীর মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয বিমান বন্দর, মাদীনা মুনাওয়ারা।
আঞ্চলিক বিমান বন্দর ৬ টি।
অভ্যন্তরীণ বিমান বন্দর ১৭ টি।
স্থলপথ: মহাসড়ক- ১,৫২,০৪৪ কি.মি.। তন্মধ্যে পাকা সড়ক- ৪৫,৪৬১ কি.মি., কাঁচা সড়ক- ১,০৬,৮৭৮ কি.মি. (২০০২ সাল)। ইতোমধ্যেই দেশটির মাঝখান দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম অঞ্চলের মাঝে সড়ক যোগাযোগের কাজ দ্রুত বেগে এগিয়ে চলছে। যা বাস্তবায়ন হলে এর দৈর্ঘ্য প্রায় তিনগুণে দাঁড়াবে। যানবাহন চলার ধারা: রাস্তার বাম দিক দিয়ে।
রেলপথ: সৌদি আরবে বর্তমানে রেল লাইনে যোগাযোগ খুবই বৃদ্ধি পেয়েছে। হজ্জ যাত্রীদের জন্য বিশেষ মনোরেল স্থাপন করা হয়েছে, যা তাদের নির্বিঘ্নে চলাচল করতে খুবই সহায়ক হয়েছে। এছাড়া রেল যোগাযোগের আওতায় দাম্মামের বাদশাহ আব্দুল আযীয বন্দর থেকে রিয়াদ, আল আহসা, বাকী, দাহরান, হারস এলাকা ইতোমধ্যেই সংযুক্ত হয়েছে। এছাড়া মনোরেল সার্ভিস মক্কা-মদীনার মাঝে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। সম্প্রতি সাউদী রেল কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেটে টিকেট বুকিং দেয়া ও রিজার্ভেশনের ব্যবস্থা রয়েছে।
জলপথ: বাণিজ্যিক বন্দর : (১) বাদশাহ আব্দুল আযীয বন্দর, দাম্মাম (২) জিদ্দাহ ইসলামী বন্দর (৩) বাদশাহ ফাহদ বন্দর, আল-জুবাইল (৪) বাদশাহ ফাহদ বন্দর, ইয়াম্বু (৫) জাযান বন্দর।
শিল্প বন্দর: (১) বাদশাহ ফাহদ শিল্প বন্দর, আল জুবাইল (২) বাদশাহ ফাহদ শিল্প বন্দর। ইয়াম্বু তেল বন্দর : (১) রাসে তান্নুরা বন্দর (২) জাঈমা বন্দর (৩) রাস আল কাফজী বন্দর (৪) রাবিগ বন্দর (৫) বাদশাহ ফাহদ শিল্প বন্দর।
ইয়ানবু যাত্রী পরিবহণ বন্দর: (১) জিদ্দাহ ইসলামী বন্দর (২) দবা বন্দর।
মাছ শিকারের বন্দর: (১) আল কুতাইফ (২) আল কনফুজা (৩) আল লাইস (৪) রাস তান্নুরা (৫) তারূত (৬) দারাইন (৭) ইয়ানবু।
গণমাধ্যম: প্রিন্ট মিডিয়া: সৌদি আরবের সমস্ত পত্র-পত্রিকা রাষ্ট্রীয় ফরমানের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সাউদী সংবাদ সংস্থার সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে ও প্রকাশিতব্য বিষয়াদির নিবিড় পর্যবেক্ষণের পরে প্রকাশিত হয়।
গণযোগাযোগ: বর্তমানে সৌদি আরবে টেলিযোগের বিপ্লবী ধারা শুরু হয়েছে। ফিল্ড টেলিফোন : ৪০ লক্ষ (২০০২) আন্তর্জাতিক ডায়ালিং কোড: ৯৬৬+, মোবাইল ফোন : এক কোটি (২০০৮)। বর্তমানে সৌদি আরবে পাঁচটি টেলিফোন সংস্থা কাজ করছে।
ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া: টিভি ও রেডিও- সৌদী রেডিও সংস্থা প্রচারিত সকল কিছুর জন্য সরকারের কাছে দায়বদ্ধ ও সরাসরি তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ।
রেডিও স্টেশন: এ.এম ৪৩, এফএম ৩১, সর্টওয়েভ-২। বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন ভাষায় সুন্দর সুন্দর অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। তন্মধ্যে জিদ্দা রেডিও স্টেশন থেকে দৈনিক ৩ ঘন্টার বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র-১১৭। বর্তমানে সেখানে সবকিছু ৯টি টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তার মধ্যে ১ম টি আরবী ভাষায়, ২য় টি ইংরেজী ভাষায়, ৩য়টি খেলাধুলা সম্পর্কিত, ৪র্থটি সংবাদ পরিবেশন, ৫মটি শিশুদের নিয়ে, ৬ষ্ঠটি কুরআনুল কারীম সম্পর্কিত, ৭মটি মহানবী (সা.) এর হাদীস সম্পর্কিত, ৮মটি অর্থনীতি বিষয়ক এবং ৯মটি সাংস্কৃতিক বিষয়ক। উহা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মাধ্যম। নিকট অতীতে সেখানে সিনেমাও শুরু হয়েছে। যা মাঝে মাঝে সাহিত্যের অংশ হিসাবে প্রদর্শিত হয়।
ইন্টারনেট: ১৯৮৫ সাল থেকেই সৌদি আরবে ইন্টারনেটের ব্যবহার হয়ে আসছে। সৌদী টেলিফোন কোম্পানীর সর্বশেষ তথ্য মতে জানা যায় যে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটি পঁচাশি লক্ষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৪% ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র: প্রত্নতত্ত্ব সমৃদ্ধ এলাকা : ইসলামের প্রাণকেন্দ্র সৌদি আরবে বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কুরআন, হাদীস ও নবী-রসূলের ভূমি হিসাবে খ্যাত সৌদি আরবে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে- তায়েফ, আল শিফা, আলহাদা, আলবাহা, আবহা, খামিস মুশাইয়াত, আল নামছা, আল আহসা। এছাড়াও পূর্বাঞ্চলে রয়েছে আকর্ষণীয় হাফ মুন বীচ যা অর্ধচন্দ্রাকৃতির সমুদ্র সৈকত এবং বন্দর নগরী জেদ্দার অভূতপূর্ব প্রবাল প্রাচীর ও দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত।
সাথে সাথে ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও প্রত্নতত্ত্ব সমৃদ্ধ এলাকা হিসাবে মদীনা মুনাওয়ারা, আল-উলা, মাদায়েন সালেহ ও নাজরান প্রসিদ্ধ। পর্যটন স্থানসমূহে ইসলামী ঐতিহ্য ও ভাবধারা বিদ্যমান।
দুই মসজিদের উন্নয়ন: সৌদি আরব হারামাইনের দেশ। তাই খাদিমুল হারামাইন এই পবিত্র দুই মসজিদের উন্নয়নের জন্য অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন। হজ্জযাত্রী, উমরাকারী ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমণকারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির নিমিত্তে বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন।
মানবিক সাহায্য: জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, ২০০৮ সাল থেকে অদ্যাবধি মানবিক সাহায্য ফান্ডে বিশ্বের সর্বোচ্চ ২০ টি দাতা দেশসমূহের মধ্যে সৌদি আরব শীর্ষস্থান অধিকার করেছে। যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। প্রতি বছর রমজান মাসে সৌদী সরকার বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শুভেচ্ছা উপহার স্বরূপ উন্নতমানের খেঁজুর প্রেরণ করে থাকে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button