ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করা সাম্রাজ্য

কেন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যৎ হারাচ্ছে

ওয়াশিংটন ও তেল আবিবে উপনিবেশিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ায়, বিশ্ব শুধু ভূ-রাজনৈতিক পতনই দেখছে না—একটি নৈতিক ও সভ্যতা সম্পৃক্ত জাগরণও প্রত্যক্ষ করছে। ভবিষ্যৎ হাতছাড়া হচ্ছে শত্রুর শক্তির কারণে নয় বরং সাম্রাজ্য ন্যায়বিচারের মূল মানবিক সত্যটিকে ভুলে গেছে বলে।
সাম্রাজ্য খুব কমই এক আঘাতে পতিত হয়। তারা ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তারপর হঠাৎই ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল, যারা দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির সঙ্গে শক্তি প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত, এখন বাস্তব সময়েই সেই সত্যটি উপলব্ধি করছে। তাদের পতন শুধু সামরিক বা কূটনৈতিক নয় বরং এটি নৈতিক, জনমিতি, দার্শনিক এবং সভ্যতা সম্পর্কিত। আধিপত্যের ভিত্তিতে গড়া একটি প্রকল্প যুদ্ধ জিততে পারে, কিন্তু ইতিহাস হারায়। আজ বিশ্ব দুটি রাষ্ট্রকে দেখছে যারা বলপ্রয়োগ ও প্রচারণার মাধ্যমে আধিপত্য আঁকড়ে ধরতে চায়, অথচ তারা বৈধতা, জনশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে। তারা জিততে প্রতারণা করছে, আর সেই প্রক্রিয়াতেই হারাচ্ছে সেই সবকিছু যা একসময় তাদের শক্তিকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল।
সাম্প্রতিক ইসরায়েলি অভিবাসন তথ্য সংখ্যা ছাড়িয়ে আরও গভীর কিছু বলে। গত তিন বছরে ১,৬৮,০০০-এর বেশি ইসরায়েলি দেশ ছেড়েছে, যা ফিরে আসা মানুষের সংখ্যাকে অনেক ছাড়িয়ে গেছে। স্থায়ী বসবাস বাতিলের আবেদন তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। যারা আগে সুযোগের সন্ধানে বিদেশে যেতেন, তারা এখন পালাচ্ছেন নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, এবং ভিতর থেকে ভেঙে পড়া জায়নিস্ট প্রতিশ্রুতির কারণে। ৭ অক্টোবরের পর “আলিয়াহ” বৃদ্ধির কথা প্রচার করা হলেও তা লুকোতে পারেনি পশ্চিমা পাসপোর্টধারী ইসরায়েলিদের উদ্বিগ্ন প্রস্থান। তারা তাদের পা দিয়ে ভোট দিচ্ছে এবং সেই ভোট বলে: জায়নিস্ট প্রকল্প আর নিরাপদ, স্থিতিশীল বা নিশ্চিত নয়। এগুলো কেবল সংখ্যা নয়, এগুলো ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবসম্পদ ক্ষতির কঠিন সত্য প্রকাশ করে। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি নেসেটের অভিবাসন ও শোষণ কমিটিতে উপস্থাপিত হয়েছিল। স্বতন্ত্র জনমিতি ও রাজনৈতিক ঝুঁকি মূল্যায়ন এক নীরব কিন্তু অপরিবর্তনীয় বহির্গমন নির্দেশ করছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, নিরাপত্তাহীনতা, বিশ্বব্যাপী নিন্দা এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ভেঙে পড়ার কারণে বহির্গমন তীব্র হারে বাড়ছে। গ্যালাপ জরিপে ইসরায়েলিদের ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা ঐতিহাসিকভাবে নিম্নমুখী এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ স্থানান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করছে। ওইসিডি দক্ষ জনশক্তির অভিবাসন বৃদ্ধির সতর্কবার্তা দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইহুদি জনমিতি গবেষণা দেখাচ্ছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ইসরায়েলি-জন্ম জনগোষ্ঠী বাড়ছে। জাতিসংঘ এই প্রবণতাকে বলছে “ডি-জায়নাইজেশন অফ ডায়াসপোরা মুভমেন্ট প্যাটার্নস”—একটি ঐতিহাসিক উল্টো প্রবাহ যেখানে যারা ফিরে আসছে তার চেয়ে বেশি মানুষ দেশ ছাড়ছে, তাও অস্থায়ীভাবে নয় বরং নৈতিক, রাজনৈতিক, এবং মানবিকভাবে ভিন্ন ভবিষ্যতের সন্ধানে প্রকৃত অভিবাসী হিসেবে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ইসরায়েলী সাংবাদিক গিদিওন লেভির মতে, বর্তমান পরিস্থিতি অস্থিতিশীল এবং এই রাষ্ট্র যদি সামরিক শক্তি, দখলদারিত্ব এবং ফিলিস্তিনিদের সমান অধিকার অস্বীকারের ওপর নির্ভর করা চালিয়ে যায়, তবে এর বর্তমান রূপ টিকে থাকতে পারে না। তিনি মৌলিক নীতিগত পরিবর্তনের পক্ষে, যার মধ্যে রয়েছে একটি একক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে ইহুদি ও আরবদের সমান অধিকার থাকবে। কারণ দুই-রাষ্ট্র সমাধান আর বাস্তবসম্মত নয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিন্ন এক অস্থিরতার মধ্যে ডুবে আছে। যে দেশ একসময় বিশ্বের মেধাকে স্বাগত জানিয়ে গর্ব করত, এখন সেই দেশ অভিবাসীদের শত্রুতে পরিণত করছে। অভিবাসীদের দ্বারা নির্মিত একটি সমাজ এখন তাদের বিরুদ্ধেই দেয়াল তুলতে চাইছে।
ব্যঙ্গাত্মক ইতিহাস:
যে দেশ বিশ্বকে স্বাগত জানিয়ে সুপারপাওয়ার হয়েছিল, সেটিই এখন ভেঙে পড়ছে সন্দেহ, বর্জন এবং শ্বেত-জাতীয়তাবাদী নস্টালজিয়ায়। মুসলিম প্রগতিশীল কোনো নেতার নির্বাচন একসময় আমেরিকার আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হতো, গণ্য হতো বৈচিত্র্য ও মতবিরোধকে ধারণ করার ক্ষমতা হিসেবে।এখন এটি হুমকি, ভীতি সঞ্চার এবং রাষ্ট্রীয় বৈরিতার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যা দেখায়, তারা গণতন্ত্রের যে মূল্যবোধ প্রচার করে, তা সহ্য করার মতো শক্তি তাদের নেই। এটি শুধু ইসলামবিদ্বেষ নয় বরং এটি সভ্যতা সম্পর্কিত আতঙ্ক। যখন একটি দেশ ভিন্নতার সঙ্গে ভাগাভাগি ভবিষ্যৎ কল্পনা করার ক্ষমতা হারায়, তখন তার আসল শক্তি ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে যায়—যদিও সামরিক বাহিনী অটুট দেখায়। ওয়াশিংটন ও তেল আবিবকে গ্রাস করা এই সংকট আকস্মিক নয়। এটি উপনিবেশবাদী প্রকল্পগুলোর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি, যা জোরজবরদস্তির সীমায় এসে ধাক্কা খায়। আধুনিক ইতিহাস নিষ্ঠুরভাবে সঙ্গতিপূর্ণ: যারা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে, তারা শেষমেষ পরাজিত হয় সেই মানবতার কাছে যাকে তারা মুছতে চায়। স্পেন থেকে ইহুদি ও মুসলিমদের বহিষ্কার থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ, বর্জন ক্ষমতাকে ভঙ্গুর করে। এটি অশেষ প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। এটি অভ্যন্তরীণ পচন জন্ম দেয়: দুর্নীতি, সামরিকীকরণ, নজরদারি, উগ্রতা এবং ভয়ের রাজনীতি। উপনিবেশবাদী প্রকল্প দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে, কিন্তু যখন বৈশ্বিক নৈতিক চেতনা বদলায় এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ একতা ক্ষয় করে, তখন তাদের মুখোমুখি হতে হয় পতনের।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল বলে নয়, ভুল বলে পতিত হচ্ছে। ফ্রান্তজ ফ্যানন আগেই বলেছিলেন: উপনিবেশিক শক্তি শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজের কারাগারে পরিণত হয়, কারণ তাকে নিয়মিত অন্যায়কে রক্ষা করতে হয়। যে সহিংসতা অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, তা অবশেষে নিজের আত্মাকে ক্ষয় করে। অত্যাচারীর আত্মা ঠিক ততটাই দখল হয়ে যায়, যতটা দখলীকৃত ভূমি হয়। আজ ইসরায়েলি সমাজ বিভক্ত ধর্মীয় উগ্রতা ও সামরিক ভাগ্যনির্ভর ফাটলে। যুক্তরাষ্ট্র ডুবে আছে প্রতিক্রিয়াশীল অজ্ঞতায়, যেখানে অস্ত্রের আগে বই নিষিদ্ধ করা হয়। এগুলো শক্তির নয়, ভয়ের লক্ষণ।
ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে দুর্বলতা দৃশ্যমান। অগাধ শক্তি সত্ত্বেও গাজায় ইসরায়েল তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। এটি সামরিকভাবে ক্লান্ত, রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন, এবং নৈতিকভাবে কলঙ্কিত। যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ক্রমাগত নিষ্ঠুরতা বাড়াতে বাধ্য হয় তা নিরাপদ নয়, নৈরাশ্যগ্রস্ত। আর যুক্তরাষ্ট্র আবিষ্কার করছে নিষেধাজ্ঞা, প্রক্সি যুদ্ধ ও আর্থিক জবরদস্তির সীমা। গ্লোবাল সাউথ তৈরি করছে নতুন সার্বভৌমত্বের পথ, পশ্চিমা তত্ত্বাবধানের বাইরে। আমেরিকান শতাব্দী শেষ হয়েছে, এর বিভ্রম কেবল ওয়াশিংটনের বক্তৃতায় টিকে আছে। বিশ্ব আর পশ্চিমা আধিপত্যকে গ্লোবাল অর্ডারের সমান বলে মেনে নিতে রাজি নয়। ফিলিস্তিন এখন আমাদের যুগের নৈতিক সূচক এবং এই রায় পশ্চিমাদের ভণ্ডামিকে নগ্ন করে দেয়। এটি শুধু ভূ-রাজনীতি নয়, বরং এটি নৈতিক ট্র্যাজেডি। যুক্তরাষ্ট্র বহুত্ববাদ গ্রহণ করতে পারত, ইসরায়েল সহাবস্থান বেছে নিতে পারত। বদলে তারা বেছে নিয়েছে আধিপত্যকে। তারা নিজেদের বন্ধ করে ফেলছে দুর্গের মতো, ভয় পাচ্ছে শত্রুর নয়, সমতার। যত বেশি তারা শক্তি আঁকড়ে ধরে, তত দ্রুত তারা ভেঙে পড়ে। যে বর্বরতাকে তারা প্রতিরোধ করার দাবি করে, তা বাহির থেকে নয়—ভেতর থেকেই উত্থিত হয়েছে। ইতিহাস শেখায়, পতন শুধু শেষ নয়, এটি উন্মোচন। সাম্রাজ্যের পতন মানবতার উত্থানের জায়গা তৈরি করে।
যখন শক্তি পবিত্রতাকে ভুলে যায়:
ইতিহাস শুধু জয়ের বিবরণ নয়, এটি নৈতিক মঞ্চ, যেখানে সভ্যতাগুলো তাদের মর্যাদা প্রমাণ করে। সমাজ পরাজয়ে নয়—নৈতিক ভিত্তি হারালে ধ্বংস হয়। ইহুদি ধর্ম সতর্ক করে খুরবান—অন্যায় থেকে জন্ম নেওয়া ধ্বংসের বিরুদ্ধে। খ্রিষ্টান ধর্ম বলে, অহংকারের পরে আসে পতন। ইসলাম বলে জুলুম প্রথমে অত্যাচারীকেই গ্রাস করে। এই তিন ঐতিহ্য একটি সত্যে একত্রিত: যে শক্তি মানবিক মর্যাদা লঙ্ঘন করে, তা নিজের বোঝায় ভেঙে পড়ে।
ইসরায়েল ও আমেরিকার এই পথ বেছে নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল না। তাদের পবিত্র গ্রন্থগুলো ডেকেছিল ন্যায়, দয়া, বিনয় ও পরদেশীর খেয়াল রাখার দিকে। কিন্তু তারা শক্তিকে পবিত্র বানিয়েছে এবং ভয়কে মতবাদের রূপ দিয়েছে। তাই তাদের পতন কেবল রাজনৈতিক নয়, আধ্যাত্মিক। প্রতিটি সাম্রাজ্যের জীবনে এক মুহূর্ত আসে, যখন অস্ত্র তাকে রক্ষা করতে পারে না এবং বলপ্রয়োগে বৈধত সৃষ্টি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই মুহূর্তে শক্তি ইতিহাসের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায় এবং সেই নীরবতায়—খুব দেরি করে বুঝে যে, ন্যায়বিচার ছাড়া আধিপত্য নিরাপত্তা নয়, আত্মহত্যা।
ভবিষ্যৎ তাদেরই, যারা সহাবস্থান বেছে নেয়। তাদের নয় যারা ভয়ে শাসন করে। তাদের নয় যারা ক্ষমতা জমায় বরং তাদের যারা ক্ষমতাকে মানবিক করে।
এলিয়ে উইজেলের ভাষায়: “এমন কোন সময় আসা উচিত নয় যখন আমরা প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হই।” কারণ প্রতিবাদ শুধু প্রতিরোধ নয়—এটি সেই পবিত্র সত্যের স্মরণ, যা সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখে। বিশ্ব টিকে থাকে শক্তিতে নয়, বিবেকে এবং সেই ভিত্তির ওপর একটি নতুন বিশ্ব ইতিমধ্যেই জন্ম নিচ্ছে। -রঞ্জন সলোমন, ভারতের গোয়া থেকে। তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং মানবাধিকারকর্মী, দীর্ঘদিন ধরে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ করছেন। বিভিন্ন দেশের জনগণ যেন আধিপত্যবাদী বর্ণনার বাইরে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারে—এই অধিকারের বিষয়েও তিনি কাজ করেন।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button