নিউইয়র্কে এলে নেতানিয়াহুকে কীভাবে গ্রেপ্তার করবেন জোহরান

নিউইয়র্কের মেয়র জোহরান মামদানী বারবার বলেছেন যে, তিনি এনওয়াইপিডি’কে নির্দেশ দেবেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করতে যদি তিনি নিউইয়র্কে পা রাখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কর্তৃক তার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার কথা উল্লেখ করেন। গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নেতানিয়াহুকে আইসিসি খুঁজছে, যার মধ্যে যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে অনাহারকে ব্যবহার এবং বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা অন্তর্ভুক্ত।
এই অভিযোগ সত্ত্বেও নেতানিয়াহু ২০২৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ঘোষণা করেন যে, তবুও তিনি নিউইয়র্ক সফর করবেন। তিনি মামদানীর আইসিসি পরোয়ানা কার্যকর করার বক্তব্যকে গুরুত্বহীন বলে মনে করছেন। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে: আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো শহরের মেয়রের কি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা আছে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রথমে আমাদের বুঝতে হবে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কি আইসিসিকে কেন্দ্র করে। ইসরায়েল কিংবা যুক্তরাষ্ট্র—কোনোটিই রোম স্ট্যাচুটের সদস্য নয়, যা আইসিসি প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসরায়েল প্রথমে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল কিন্তু পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়, আর যুক্তরাষ্ট্রও নিজের নাগরিক ও মিত্রদের ওপর আইসিসির এখতিয়ার প্রয়োগের বিরুদ্ধে সবসময় অবস্থান নিয়েছে।
রোম স্ট্যাচুটের ১২–১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইসিসি নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারে:
যখন অপরাধকারী কোনো সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিক বা অপরাধটি কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, যখন কোনো সদস্য রাষ্ট্র একটি পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করে তা আদালতে পাঠায়, যখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ অধ্যায় ৭-এর অধীনে কোনো পরিস্থিতি আদালতে প্রেরণ করে, যখন কোনো অ-সদস্য রাষ্ট্র আদালতের কাছে অ্যাড-হকভাবে এখতিয়ার গ্রহণ করে অথবা যখন প্রসিকিউটর যথাযথ ভিত্তিতে নিজের উদ্যোগে তদন্ত শুরু করেন।
ফিলিস্তিন ২০১৫ সালে রোম স্ট্যাচুটে যোগ দেয় এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার নিশ্চিত করে যে, দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘটিত অপরাধগুলোর ওপর আদালতের এখতিয়ার রয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আইসিসি নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ—যেমন অনাহার সৃষ্টি এবং বেসামরিক নিপীড়নের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
জোহরান মামদানী আমেরিকান রাজনীতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন : আইসিসির নিজস্ব কোনো আইন প্রয়োগকারী বাহিনী নেই। গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার জন্য এটি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভর করে। ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র আইসিসি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনে সংঘটিত অভিযোগের তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে এই সম্পদ জব্দকরণ ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
আইসিসি’র গ্রেফতার বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হলে, আন্তর্জাতিক আইন একটি বিকল্প ব্যবস্থা প্রদান করে, তা হচ্ছে সার্বজনীন বিচারিক এখতিয়ার (ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন)। এই নীতির আওতায় যে কোনো রাষ্ট্র ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক অপরাধ—যেমন গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার করতে পারে অপরাধ যেখানে ঘটুক বা অপরাধীর জাতীয়তা যাই হোক না কেন। সুইজারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো সফলভাবে এটি ব্যবহার করেছে—যেমন ২০২৪ সালে গাম্বিয়ার সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উসমান সংকোর মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ড এবং ফরাসি আদালত কর্তৃক সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি।
ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের একটি সুপরিচিত দৃষ্টান্ত হলো ‘অ্যাডলফ আইখমান মামলা’। আইখমান “হলোকাস্টের স্থপতি” হিসেবে পরিচিত। ১৯৬০ সালে মোসাদ তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে জেরুসালেমে নিয়ে যায় এবং ইসরায়েলি আদালত তাকে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। ১৯৬২ সালের ১ জুন তাকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ইসরায়েল কর্তৃক আইখমানকে অপহরণ এই যৌক্তিকতা প্রদর্শন করে যে, ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের ভিত্তিতে যে কোনো রাষ্ট্র ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পারে। এভাবে, একই নীতি ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে অর্থাৎ যে কোনো দেশ নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করতে পারে, আইসিসি সদস্য হোক বা না হোক।
ট্রায়াল ইন্টারন্যাশনাল বলেছে যে যারা ভয়ঙ্কর আন্তর্জাতিক অপরাধ করে, তারা রাজনৈতিক পদ বা কূটনৈতিক ইমিউনিটি দাবি করতে পারে না। তাই নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক ইমিউনিটি তাকে রক্ষা করতে পারে না—যেমন চিলির একনায়ক অগাস্টো পিনোচেটকে ১৯৯৮ সালে লন্ডনে স্প্যানিশ পরোয়ানার ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
একইভাবে, সুইস আদালত গাম্বিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উসমান সংকোকে মানবতাবিরোধী অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেয়—যা ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশনের আরেকটি শক্তিশালী উদাহরণ।
যদি আইখমানের ঘটনার সঙ্গে নিউইয়র্কে নেতানিয়াহুর সম্ভাব্য গ্রেফতারের তুলনা করা হয়, তাহলে অনেক মিল দেখা যায়। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন প্রয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েলের আইসিসি’র সদস্য হওয়া প্রয়োজন নেই। এটাই যথেষ্ট যে, তিনি এমন ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছেন যা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
কেউ কেউ যুক্তি দেবেন যে, এনওয়াইপিডি’র এমন ক্ষমতা নেই, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন প্রয়োগ মূলত ওয়ার ক্রাইমস্ অ্যাক্ট(১৮ইউএসসি # ২৪৪২)এর অধীনে পড়ে এবং এর প্রয়োগে ফেডারেল অনুমোদন লাগতে পারে। অন্যরা মনে করেন, নেতানিয়াহুকে লিয়েহি ল’ বা ১৮ ইউএস কোড # ১০৯১-জেনোসাইড অনুযায়ীও দায়ী করা যেতে পারে।
অনেকেই বলেন, ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন প্রয়োগ করতে পূর্বানুমতির দরকার নেই, কারণ এটি আন্তর্জাতিক প্রচলিত আইনের ভিত্তিতে স্বীকৃত—যেখানে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ জুস কগেন্স মানদণ্ডে পড়ে।আর তা অগ্রাহ্য করা যায় না।
আইসিসির বর্ণনা অনুযায়ী, আইনগতভাবে যুদ্ধাপরাধী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের সম্ভাবনা আছে এবং যখন রাষ্ট্রগুলো আইসিসির পরোয়ানা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক আইন বিকল্প ব্যবস্থার সুযোগ দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো সার্বজনীন বিচারিক এখতিয়ার।
অগাস্টো পিনোচেটের গ্রেফতার, আইখমানের আটক এবং গাম্বিয়ার সাবেক মন্ত্রী ও সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে পরোয়ানা স্পষ্ট করে যে, এটি যেকোন রাজনৈতিক বা সামরিক পদের কাউকেই দায়মুক্তি দেয় না।
ইউনিভার্সাল জুরিসডিকশন হলো আন্তর্জাতিক অপরাধীদের গ্রেফতার করার জন্য আইসিসির একটি অপরিহার্য ও পরিপূরক হাতিয়ার। নিউইয়র্কের মেয়রের পক্ষ থেকে নেতানিয়াহুকে গ্রেফতারের হুমকি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারকে শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আর এটা ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের রাজনৈতিক ও আর্থিক চাপে আইসিসির ম্যান্ডেট রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। -মোহাম্মদ ইউসুফ, আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি গবেষক।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button