আল্লাহতে অবিচল এক পিতা

UKআগুনে পুড়ে স্ত্রী ও তিন সন্তানের সবাই মারা গেছেন। দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে নিজ বাড়িতে তারা দগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৭ জন গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
তবে ইংল্যান্ডের লেকশায়ারের এ ঘটনাকে ওই পরিবারের অভিভাবক ডা. মাহমুদ তৌফিক আল সাত্তার আল্লাহর জীবন দেওয়া-নেওয়ার যে ‘ইচ্ছে’ তার অংশ বলেই মনে করছেন।
তিনি বলেছেন, ‘দুর্বৃত্তের আগুনে স্ত্রী-সন্তান মারা গেলেও আমি এ ঘটনায় মোটেও রাগান্বিত নই। আমি মনে করি তারা জান্নাতবাসী হয়েছে।’
উল্লেখ্য, লেকশায়ারে পাহাড়ের ওপর কাঠের তৈরি ঘরে আগুন দিলে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ডা. আল সাত্তারের স্ত্রী সেনিলা তৌফিক (৪৭), দুই ছেলে জামাল (১৫) ও বিলাল (১৭) এবং মেয়ে জয়নাব (১৯) মারা যায়।
এ ঘটনায় ওইদিনই পুলিশ একজনকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলার অভিযোগ দাখিল করেছে। আর হত্যার কারণ নিশ্চিত হতে পুলিশ মরদেহগুলোর দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের জন্য আগামী ৮ অক্টোবর তারিখ নির্ধারণ করেছে।
স্ত্রী-সন্তান লেকশায়ারে থাকলেও নিউরোসার্জন আল সাত্তার কর্মক্ষেত্রের কারণে আয়ারল্যান্ডে বসবাস করেন। তিনি ময়নাতদন্তের এই বর্ধিত সময়কে তার জন্য খুবই কষ্টের উল্লেখ করেছেন। ধর্মপ্রাণ ডা. আল সাত্তার বলেন, ‘মৃত্যুকে কিভাবে মেনে নিতে হয়, আল্লাহ আমাকে সে শক্তি দিয়েছেন।’
দুর্ঘটনা সম্পর্কে ডা. সাত্তারকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা এখন অতীত। আমার মনে হয়, সময়টা আমার জন্য সত্যিকার অর্থেই কঠিন। কিন্তু ভাগ্যকে তো মেনে নিতেই হবে- এ মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে।’
পেশায় চিকিৎসক সাত্তার বলেন, ‘একদনি মারা যাব, এটা আমরা সবাই জানি। সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসকারী অথবা নাস্তিক- সবার জন্যই এই একটি বিষয়ই কেবল শতভাগ নিশ্চিত। স্ত্রী-সন্তান হারানোয় আমি রাগান্বিত নই। কারণ জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত। আমি জানি আমার পরিবার জান্নাতবাসী হয়েছে।’
একদিন আগেই ওই বাড়ির অদূরে সড়কে একটি খুনের ঘটনা ঘটে। তারপরই ডা. সাত্তারের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। এতে পুলিশের ধারণা, হয়তো বা ওই বাড়ির কেউ এ খুনের ঘটনা দেখে ফেলে। সেজন্যই তাদের সরিয়ে দিতে ভোররাতে বাড়িতে আগুন দেয়া হয়। আর এ বিষয়টি সামনে রেখেই তদন্ত এগিয়ে নিচ্ছে পুলিশ।
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত যে সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের সবার বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে কেমো অ্যান্থনি পর্টার (১৮) নামে একজনের বিরুদ্ধে আদালতে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে। ছয়জনকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। আর ১৮ বছর বয়সী একজনকে ডাকামাত্র হাজির হওয়ার শর্তে জামিন দেওয়া হয়েছে।
ডা. আল সাত্তার দুর্ঘটনার খবর কিভাবে পান তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। ঘটনার দিন খুব সকালে তিনি তার এক বন্ধুর ফোন রিসিভ করেন, যিনি জানান, ‘তোমার ঘরে আগুন লেগেছে।’ সে সময়ে আল সাত্তার ডাবলিনে ছিলেন।
শুক্রবার বিবিসি রেডিও’র এক অনুষ্ঠানে ডা. সাত্তার জানান, ‘ভোর ৩টা ১০ মিনিটে লেকশায়ারে আমার এক বন্ধু ফোনে বলেন- তুমি কী কিছু শুনতে পেয়েছো? তোমার ঘর আগুনে পুড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বন্ধুর খবর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। এর বেশিকিছু সে জানাতে পারছিল না। কারণ ততক্ষণে পুলিশ ওই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধুরা খবর জানাতে বারবার অসহায়ত্ব প্রকাশ করছিল।’
‘এরপর প্রথমেই আমার মনে হলো- আল্লাহ বড় ধরনের বিপদ দিয়ে আমাকে পরীক্ষা করছেন। সুতরাং সত্যিকারের মুসলিম হিসেবে উচিত তার ইবাদত করা। এরপর বিমানবন্দরে যাওয়ার পর এক জ্যেষ্ঠ সার্জন হৃদয় ভেঙে যাওয়ার খবর দিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমি মানসিকভাবে শোক সইবার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি।’
ডা. সাত্তার বলেন, ‘কিছু একটা করে তো নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। হ্যাঁ, এ সময় আমি কান্না করি। কিন্তু আমি ভেঙে পড়েছিলাম না বলে আল্লাহকে এখন অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের কারণে এখন স্ত্রী ও সন্তানদের দাফনের জন্য ডা. সাত্তারকে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আর এটাই তাকে হতাশ করছে। তিনি বলেন, ‘প্যাথলজিস্টকে বলার পর তারা দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের জন্য ৮ অক্টোবর সময় দিয়েছে। এটা আমার জন্য খুবই কষ্টের।’
স্ত্রী ও বুকের ধন তিন সন্তানকে হারিয়ে আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থায় সান্ত্বনা পেয়েছেন ডা. আল সাত্তার। তবে তিনি বলেছেন, এরপর আর ওই শূন্য বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে তার নেই।
ডা. আল সাত্তারের ভাষায়, ‘আমি আমার বাড়ি আর দেখতে পাব না, এটা খুবই বেদনাদায়ক। আমি এই বাড়ি আর দেখতেও চাই না, ভেতরেও যেতে চাই না। কারণ এটা এখন কেবলই একটা বাড়ি। এটা আপনার ঘর নয়, যেখানে একটি পরিবার ছিল।’
অনুষ্ঠানে ডা. আল সাত্তার তার স্ত্রীর ২০ বছরের কর্মজীবন তুলে ধরেন। বলেন, ‘সে খুবই জ্ঞানী মহিলা ছিল। এখানে নিজ সম্প্রদায়ের জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে এবং সবকিছুর উপরে সে একজন যত্নশীল মা ছিল।’
‘আমি আনন্দিত এবং আমি নিশ্চিত আমার স্ত্রী এবং সন্তানরাও আনন্দিত। কারণ তাদের মৃত্যুর পর লেকশায়ার এবং লেকশায়ারের বাইরে কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। সবকিছুই শান্ত রয়েছে।’ যোগ করেন সব হারিয়ে আল্লাহর প্রতি আস্থা রাখা ডা. মাহমুদ তৌফিক আল সাত্তার।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button