করোনার হানা: সাহায্যের নামে প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন

করোনা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে অনেকেই চীনকে মোড়ল হিসেবে স্বীকৃতি দেবে

চীন থেকে বিশ্বজুড়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। নিজ দেশের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এনে সেই চীনই এখন পশ্চিমা দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোকে সাহায্য করছে। ইউরোপ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে তারা। একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে চীন নিজেদের প্রভাব বিস্তার করছে বলে মনে করছেন পশ্চিমা সমালোচকরা। ধারণা করা হচ্ছে, করোনা যুদ্ধোত্তর বিশ্বে অনেকেই চীনকে মোড়ল হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।

এরই মধ্যে চাপের মুখে পড়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে লাখ লাখ মাস্ক নিয়েছে। করোনার রোগীদের চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরও দিচ্ছে বেইজিং। এ ছাড়া তাদের চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের বেশ কয়েকটি দলও করোনা আক্রান্তদের সেবা দিতে ওই সব দেশে গেছেন। বিশ্নেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে মহামারি মোকাবিলায় সমালোচনা এড়াতে চাচ্ছে চীন। একইসঙ্গে পাশ্চাত্য ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তির প্রতিযোগিতা দেখানোর একটি সুযোগ পেয়েছে চীন।
গত বছরের শেষ দিকে চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণীর বাজার থেকে কোভিড-১৯-এর উৎপত্তি হয়। চীনের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দেশটিতে অভ্যন্তরীণ আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে এসেছে। তবে বিদেশফেরত চীনাদের মধ্যে এখনো সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। এ বিষয়েও তারা কাঠোর অবস্থান নিয়ে নতুন সংক্রমণ রোধে কাজ করে যাচ্ছে।
পশ্চিমের বেশিরভাগ অঞ্চল এখন করোনার হটস্পট হয়ে উঠেছে। ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভারসাম্য রাখতে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো নাস্তানাবুদ হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ইইউসহ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে চীন মাস্ক, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও বিশেষজ্ঞ পাঠিয়ে সাহায্য করছে। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও স্পেন চীনের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছে।
প্যারিসের ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের (এফআরএস) রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ এন্টোইন বন্ডাজের বলেন, জানুয়ারি মাসে ইইউ সাহায্য পাঠালেও চীন নিজেদের বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছে। তখন দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের সামরিক অবস্থান ও প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ের সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে চীনের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তির মধ্যে তীব্র উত্তেজনা চলছিল। তবে কোভিড-১৯ এখন চীনের সঙ্গে ওই সব দেশের আদর্শিক লড়াইয়ে জ্বালানি জোগাচ্ছে।
ইইউ ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ অ্যালিস একমন বলেন, বেইজিং তাদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ দেখাতে আন্তর্জাতিক সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। করোনা মোকাবিলায় সাহায্য করায় ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরজুলা ফন দেয়ার লায়েন ১৮ মার্চ বেইজিংয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তবে উষ্ণ সে সুরটি এখন তেতো হয়ে গেছে। ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল গত সপ্তাহে ইউরোপকে ‘আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ইউরোপের সৌজন্যের রাজনীতির বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারন করোনা যুদ্ধের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক উপাদান পেঁচিয়ে রয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, চীন প্রথমেই নিজ দেশের করোনা মহামারিকে ধামাচাপা দিয়ে ফেলেছে। বিষয়টি তাদের দ্রম্নত বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে এবং বিশ্বব্যাপী নিজেদের অবস্থান জানান দিতে সাহায্য করেছে। বোরেলের সুরেই কথা বলেছেন ফ্রান্সের ইউরোপিয়ান অ্যাফেয়ার্স প্রতিমন্ত্রী অ্যামেলি ডি মৎচালি।
চীনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কখনো কখনো ভুয়া তথ্য ও মেকি ভাব প্রচার এবং প্রকৃত ঘটনা আড়াল করা খুব সহজ হয়ে যায়।’ তবে মঙ্গলবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ চীন থেকে অতিপ্রয়োজনীয় মাস্ক আমদানির কথা জানান। করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল নিয়েও পশ্চিমাদের সঙ্গে একমত নয় চীন। গত ১২ মার্চ চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিজান ঝাও টুইটে অভিযোগ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী উহানে এই মহামারি ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে আমাদের একটি ব্যাখ্যা দিক।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী বিশ্বে রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, আলজেরিয়ার মতো অনেক দেশ চীনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করবে না। সার্বিয়ায় এরই মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে চীন। করোনা মহামারি মোকাবিলা নিয়ে শুরুতে সার্ব প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিস ইউরোপের ঐক্যের পক্ষে কথা বললেও পরে তিনি বলেন, একটি দেশই (চীন) আছে, যারা আমাদের সাহায্য করতে পারে। চীন সাহায্য পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর শি জিনপিংকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন ভুসিস। এ থেকে স্পষ্ট হয়, চীন করোনা যুদ্ধে নিজের প্রভাব বিস্তারের বিরাট সুযোগ লুফে নিয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button