৩৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বিশ্ব পুঁজিবাজার

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ নেয়া নভেল করোনা ভাইরাস এক দিকে কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার প্রাণ; অন্যদিকে কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার দশা। নভেল করোনা ভাইরাসের মহামারীর মধ্যে ব্যাপক বিক্রির চাপের কারণে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজার ঐতিহাসিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ সূচক ও লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচকে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ১৯৮৭ সালের পর সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে। এই তিন মাসে বিশ্বের প্রধান সূচক দুটি ২৩ শতাঙ্ক ও ২৫ কমেছে। এসঅ্যান্ডপি ৫০০ এই ত্রৈমাসিকে ২০ শতাঙ্ক দর হারিয়েছে, যা ২০০৮ সালের পর থেকে সর্বোচ্চ দরপতন।
প্রাণঘাতী ভাইরাসটির বিস্তার কমাতে দেশে দেশে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যে শেয়ারবাজারের এই দরপতন হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে এবার বিশ্ব অর্থনীতিতে যে আঘাত আসবে তাতে বিগত ২০০৮ সালের মন্দার চেয়ে বড় আর্থিক সঙ্কট তৈরি হবে বলে অর্থনীতিবিদরা হুঁশিয়ার করেছেন।
বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মার্কিটের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৮ শতাঙ্ক হারে কমবে। আগের মন্দার পর ২০০৯ সালে প্রবৃদ্ধি কমেছিল ১ দশমিক ৭ শতাঙ্ক হরে কমেছিল।
কোনো দেশই অক্ষত নেই। সংস্থাটির হিসাবে, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবার ২ শতাঙ্ক হারে কমবে এবং যুক্তরাজ্য প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৪ শতাঙ্ক হ্রাস পেতে পারে। ইতালি ও স্বল্পোন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও খারাপ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সভাপতি ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা জানান, ২০২০ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রবণতায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন; বিশেষ করে মন্দা পরিস্থিতি উদীয়মান বাজার ও স্বল্প আয়ের দেশগুলিতে যে আঘাত হানবে তা নিয়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী তিন মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার ৩২ শতাংশের বেশি বেড়ে যেতে পারে, যেখানে চার কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারাবে।
বিশ্বজুড়ে অনেক মূল্য সূচি বছরের শুরুর চেয়ে ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। চাহিদা কমে যাওয়ায় ও উৎপাদকদের মধ্যে মূল্য যুদ্ধের তেলের দামে খাড়া দরপতন বিশ্ব অর্থবাবাজারের সমস্যাগুলিকে প্রকট করে তুলেছে। তবে এমন পরিস্থির মধ্যে দেশে দেশে সরকারগুলো অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় আকারের তহবিলের ঘোষণা দেয়ার সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজার কিছুটা চাঙা হয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা, করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধসিয়ে দেবে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে পারবে, তা এই ধস ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।

মঙ্গলবার লন্ডনের এফটিএসই প্রায় দুই শতাঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে জার্মানির ডিএএক্স এবং ফ্রান্সের সিএসি ৪০ সূচকও কিছুটা বেড়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রধান সূচক হোঁচট খেয়েছে। যেমন ডাউ জোন্স সূচকের এক দশমিক ৮ শতাঙ্ক, এসএন্ডপি ৫০০-এর এক দশমিক ৬ শতাঙ্ক ও নাসডাক সূচকের প্রায় ১ শতাঙ্ক দর হারিয়েছে।
এই প্রান্তিকে জ্বালানি ও আর্থিক খাতের কোম্পানিগুলোর ফলাফল সবচেয়ে খারাপ ছিল। দোকান বন্ধ থাকায় তলানিতে ঠেকা বিক্রি পরিস্থিতি নিয়ে খুচরা বিক্রেতা কোম্পানিগুলো মঙ্গলবার বড় ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। বেশিরভাগ কর্মীদের অবৈতনিক ছুটি দিয়ে দেয়ার ঘোষণার পর দিন রিটেইলার কোম্পানি ম্যাসি একদিনে প্রায় ৯ শতাঙ্ক দর হারিয়েছে।
ইউএস ব্যাঙ্ক ওয়েলথ ম্যানেজমেন্টের বিশ্লেষকরা লিখেছেন, মুদ্রানীতি ও আর্থিক খাতে প্রণোদনার ঘোষণার পরও যতক্ষণ পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর মেয়াদ ও প্রভাব অজানা থাকবে, তেলের দাম অবদমিত ও মুনাফার সম্ভাবনা মেঘাচ্ছন্ন থাকবে, ততদিন শেয়ারবাজারের অস্থিরতা বাড়তে থাকবে বলেই আমরা আশঙ্কা করছি।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশে দেশে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আর সেই ধাক্কা পেনশনভোগীদের সঞ্চয়ী হিসাবেও লাগতে পারে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পরপরই বড় ধরনের ধাক্কা লাগে এফটিএসই, ডাও জোন্স নিক্কেইর মত শেয়ার সূচকগুলোতে। ১৯৮৭ সালের পর এতটা খারাপ দশায় ডাও জোন্স আর এফটিএসই কখনও পড়েনি।
বিনিয়োগকারীদের শঙ্কা, করোনা ভাইরাসের বিস্তৃতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধসিয়ে দেবে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে পারবে, তা এই ধস ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নাও হতে পারে।
উল্লেখ্য, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনা ভাইরাস গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম চীনে দেখা দেয়। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে সাড়ে ৯ লাখের ওপরে মানুষ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণ দিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৫১ হাজারের বেশি মানুষ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button