বাংলাভাষার অনবদ্য প্রকাশ ‘মাকাসিদ আশ্ শরী‘আহ্ ও ইসলামের সৌন্দর্য’

Maqasidএ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলা একটি সমৃদ্ধশালী ভাষা। নোবেল বিজয়ী এ ভাষার রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলা কাব্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ ভাষার ভান্ডার সমৃদ্ধ। একইভাবে এ ভাষায় ইসলামী সাহিত্যও বিকাশ লাভ করেছে নান্দনিকভাবে। ইসলাম যেমন একটি বিশ্বজনীন আদর্শ তেমনি এ ভাষায় ইসলামী সাহিত্যও একটি বিশ্বজনীন সাহিত্যে রূপ লাভ করেছে। ত্রয়োদশ শতকে বঙ্গীয় মুসলমানরা যখন প্রথম ইসলামী সমাজের গোড়া পত্তন করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই কুরআনের আদর্শকেই তারা গ্রহণ করেছিলেন। এই আদর্শের ভিত্তিতে তারা সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য রচনায় সাহিত্যিক ও লেখকগণ মনোনিবেশ করেন। সাহিত্যে ইসলামী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া এদেশে পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলা সম্ভব নয়। ইসলামী জীবনব্যবস্থা যেমন সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণের বার্তাবাহক তেমনি ইসলামী সাহিত্যও মানবতার আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের যথার্থ ধারক। অন্যান্য ভাষার ন্যায় বাংলা ভাষায় বড় বড় মুসলিম সাহিত্যিকের সৃষ্ট সাহিত্য-কর্ম ইসলামী সাহিত্যের জন্য বিপুল প্রেরণার উৎস।  সম্প্রতি মাকাসিদ আশ্ শরী‘আহ বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত একটি বিষয়ের নাম। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এর আলোচনা সকল যুগে সকল সময়ে কমবেশি আলোচিত। মানবজীবনে শরী‘আহ্র গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ খন্দকার তার সুনিপুণ লেখনী, সুদীপ্ত মননশীলতা, প্রাজ্ঞতা, বিচক্ষণতা ও সুচিন্তিত জ্ঞানের বিচ্ছুরণ দ্বারা আলোচ্য সৃজনশীল গ্রন্থখানি রচনায় তার অভূতপূর্ব বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বলে আমি মনে করি। ইসলামী শরী‘আহ্র সম্যক ধারণা না থাকলে শরী‘আহ্র আসল উদ্দেশ্য মানবসমাজে ব্যাহত হয়। মানুষ শরী‘আহ্র অপব্যাখ্যা করে এবং ভুল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পুরো জাতিকে বিভ্রান্ত করে। ঘুণে ধরা এ সমাজে মানুষ শরী‘আহ্ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে অপব্যাখ্যার দ্বারা ইসলামের যে ক্ষতি করছে তা প্রতিনিয়ত পীড়া দেয় সুবিজ্ঞ লেখককে। তিনি বারবার মর্মাহত হন এবং তার ভাবুক ও উর্বর মস্তিষ্ক চিন্তা করে শরী‘আহ্র গুঢ় রহস্য ও এর উদ্দেশ্যাবলি নিয়ে। তার চিন্তাজগতের এক মহাবিপ্লব হলো এ গ্রন্থখানি। আমার বিশ্বাস যার মাধ্যমে পথহারা মুসলিম জাতি সঠিক পথের দিশা পাবে। তার এ গ্রন্থখানি ‘সিরাজুম মুনিরা’ বা আলোকবর্তিকা হিসেবে হতাশাগ্রস্ত মুসলিম সমাজ আলোকের সন্ধান দিতে সহায়তা করবে। বিভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে তারা বের হয়ে আসতে পারবে।
ইসলামী শরী‘আহ্র প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধন করা। ইসলামে মানুষের কল্যাণকে সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করা হয়। এতে ধর্ম-বিজ্ঞান ও আইন-বিজ্ঞানকে আলাদা করে দেখা হয় না। এটি শুধু পারলৌকিক কল্যাণের পথই দেখায় না, দেখায় কীভাবে ইহলোকেও শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ অর্জন করা যায়। আর ইসলামী শরী‘আহ্র এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ফিকহি পরিভাষায় বলা হয় ‘মাকাসিদ আশ্ শরী‘আহ্্’। এটি ইসলামী আইন-দর্শনের সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে এটিকে ইসলামী আইনের উৎস হিসেবেও গণ্য করা হয়।
মাকাসিদ আশ্ শরী‘আহ্ ইসলামী আইন-দর্শনের সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। সময়ের আবর্তনে মানুষের জীবনে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়। এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে শরী‘আহ্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে মানদ- হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া আইনটি কেন প্রণয়ন করা হচ্ছে, এর উদ্দেশ্য কী, আইনটি দিয়ে মানুষের কী কল্যাণ সাধিত হবে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনা হয়। একইভাবে উক্ত আইনটির ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহ্তে যে নির্দেশনা রয়েছে তার উদ্দেশ্যও বিবেচনা করা হয়। তাই বলা যায়, যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলামী শরী‘আহ্র বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে সেগুলোকে নতুন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মানদ- হিসেবে বিবেচনা করাই মাকাসিদ আশ্ শরী‘আহ্র মূল আলোচ্য বিষয়।
‘ইসলামী শরী‘আহ্’ অধ্যায়ে লেখক শরী‘আহ্র পরিচিতি, পরিধি, বিস্তৃতি, মৌলিক বৈশিষ্ট্য, শরী‘আহ্ ও প্রচলিত আইনের মধ্যে পার্থক্য, আধুনিক আইনি প্রয়োজন পূরণে ইসলামী শরী‘আহ্র সক্ষমতা ইত্যাদি শর‘ঈ বিষয় অত্যন্ত চমৎকারভাবে আলোকপাত করেছেন। ‘ইসলামী শরী‘আহ্র উৎস’ অধ্যায়ে এর উৎসসমূহের বর্ণনা তার জ্ঞানের গভীরতা জানান দেয়। ‘মাকাসিদ আশ্ শরী‘আহ্’ অধ্যায়ের আলোচনা থেকে শরী‘আহ্র মাকাসিদ যুক্তিগ্রাহ্য ও দালিলিকভাবে তিনি আলোচনা করেছেন। এর দ্বারা পাঠকের সামনে সদাজাগ্রত অনেক প্রশ্নের মৌলিক উত্তর পাবে বলে আমার বিশ্বাস। ‘সাম্প্রতিক বিষয়ে বিধান নির্ণয় ও মাকাসিদ শরী‘আহ’ এবং ‘মাকাসিদ আশ শরী‘আহ্ ও অবারিত মানবকল্যাণ’ অধ্যায়ে তিনি মানবতার কল্যাণে ইসলামী শরী‘আহ্র বিভিন্ন বিষয়াবলি ফিকহি ধারায় আলোচনা করেছেন। এর দ্বারা লেখকের ফিকহি জ্ঞানের পান্ডিত্য সম্পর্কে তার সুবিশাল জ্ঞানের পরিধি জানা যায়। ‘ইসলামী শরী‘আহ্র কতিপয় উদ্দেশ্য’ নামক শেষ অধ্যায়ে তিনি তার সুগভীর জ্ঞান ও চিন্তাধারার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এতে তার বহুমুখী প্রতিভার পরিস্ফুটন ঘটেছে। এ অধ্যায়ের মাধ্যমে গ্রন্থখানি যেন সাফল্যমন্ডিত হয়েছে। কারণ এর প্রতিটি পরিচ্ছেদে মানব জীবনের সকল বিষয়ে শরী‘আহ্র প্রভাব ও ব্যাপকতা অত্যন্ত সাবলীলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এ আলোচনার মাধ্যমে ইসলামী শরী‘আহ্র শ্রেষ্ঠত্ব সুন্দরভাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। মানব জীবনের এমন কোনো দিক নেই যা শরী‘আহ্ ব্যতিরেকে চলতে পারে। আর তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন লেখক এ অধ্যায়ে। এখানে ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রশাসন সকল বিষয়ে তিনি তার সুগভীর জ্ঞান ও চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ইসলামী চিন্তাবিদ, মনীষী ও জ্ঞানী-গুণীজনদের সম্পর্কে তার অগাধ পান্ডিত্যের উজ্জ্বল নমুনা এখানে ফুটে উঠেছে। ইসলামী আইন ও শরী‘আহ্র অভীষ্ট লক্ষ্য নান্দনিক ভঙ্গিতে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। উক্ত গ্রন্থে লেখক প্রতিটি বিষয়ের আলোচনা নকলি ও আকলি দলিল দিয়ে প্রকাশ করার প্রয়াস চালিয়েছেন। যাতে গ্রন্থটি তথ্যবহুল হয়ে উঠেছে। মহান আল্লাহ্ লেখকের এ পরিশ্রম জাতির খেদমতে কবুল করুন। আমিন!
মুক্তদেশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থটি। নান্দনিক প্রচ্ছদ, সাদা কাগজে সুন্দর ও ঝকঝকে ছাপা ৩২০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির দাম রাখা হয়েছে মাত্র ৩৫০ টাকা। বোদ্ধা পাঠকের সংগ্রহে রাখার মতো গ্রন্থটি পাওয়া যাবে দেশের সম্ভ্রান্ত লাইব্রেরিসমূহে। -মুহাম্মদ নুরউদ্দিন কাউছার

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button