ফারুকী নিজ বাসায় খুন : ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ

Farukiচ্যানেল আইর জনপ্রিয় ইসলামি অনুষ্ঠান ‘কাফেলা’ ও ‘শান্তির পথে’র উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে (৫৫) গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার রাত সোয়া ৯টার দিকে রাজধানীর পূর্বরাজাবাজারের ১৭৪ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। পরিবারের লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফারুকীকে অন্য কক্ষে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। তবে তাকে কে বা কারা গলা কেটে হত্যা করেছে তাৎণিক তা জানাতে পারেনি পুলিশ। রাতে এ খবর বিভিন্ন ইলেট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রচারিত হলে নগরীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ করেন ফারুকীর অনুসারী ও ভক্তরা। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পরপরই মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর বাসার সামনে জড়ো হন কয়েক শ’ অনুসারী ও ভক্ত। এ সময় তারা খুনের ঘটনার বিচার দাবি করে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ দিকে ঘটনার রহস্য উন্মোচন করে খুনিদের গ্রেফতারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত। এ ছাড়া মাওলানা ফারুকী হত্যার বিচারের দাবিতে আগামী রোববার ঢাকায় হরতালের ডাক দিয়েছে ইসলামী ছাত্রসেনা এবং চট্টগ্রামে হরতালের ডাক দিয়েছে ইসলামী ফ্রন্ট।
মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী সুপ্রিম কোর্ট জামে মসজিদের খতিব ছিলেন। চ্যানেল আইয়ের পাশাপাশি মাই টিভিতেও ইসলামবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করতেন।
ফারুকীর হত্যার খবর পেয়ে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল ও র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানসহ র‌্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। রাত ১১টা ২০ মিনিটে সিআইডি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে ফরেনসিক রিপোর্ট সংগ্রহ করে। সংগ্রহ শেষে মাওলানা ফারুকীর লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠায় পুলিশ।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ওই বাড়ির দোতলার বাম পাশের ফাটে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করতেন ফারুকী। তার বাসায় একটি কক্ষে তিনি অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। গতকাল সন্ধ্যার পর দু’জন লোক ওই বাসায় আসে। তাদের নিয়ে অফিসকক্ষে কথা বলছিলেন ফারুকী। মাগরীরের নামাজের পর চার-পাঁচজন যুবক বাসায় ঢুকে বলে আমরা হজের বিষয় নিয়ে কথা বলতে এসেছি। এ কথা বলে বাসার মধ্যে ঢুকেই অস্ত্রের মুখে সবাইকে জিম্মি করে বলে, কেউ নড়াচড়া করবে না। যদি নড়াচড়া কিংবা চিৎকার করো তাহলে সবাইকে হত্যা করে ফেলবো। এ কথা বলেই মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে অফিস কক্ষ থেকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার পরিবারের সদস্যদের আলাদা একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মাওলানা ফারুকীর পরিবারের লোকজনের চিৎকারে আশপাশের লোকজন বাসায় ভেতরে ঢুকে মাওলানা ফারুকীর গলাকাটা লাশ দেখতে পায়।
মাওলানা ফারুকীর ভাতিজা জানান, গত সোমবার দুইজন লোক এসে ফারুকীকে বলে তার এক ভাই হজে যাবে। তাদের মঙ্গলবার আসার কথা ছিল। কিন্তু তারা মঙ্গলবার না এসে গত রাতে ওই বাসায় আসে। এর কিছুক্ষণ পরই ১০-১২ জন যুবক এসে বাসায় ঢুকে মাওলানা ফারুকীসহ বাসার লোকজনকে জিম্মি করে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে। এরপর তাদেরকে অন্য একটি রুমে নিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে এবং ফারুকীকে অন্য একটি রুমে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
ছেলেমেয়েরা জানিয়েছেন, তারা বুঝতেই পারেনি এত দ্রুত সময়ের মধ্যে এ ঘটনাটি ঘটে যাবে। তারাও নিশ্চিতভাবে বলতে পাছেন না কে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
রাত সোয়া ১০টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। কেন এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কে বা কারা এটি ঘটিয়েছে তা খুঁজে বের করা হবে। এ সময় তিনি র‌্যাব ও পুলিশকে দ্রুত সময়ের মধ্যে খুনিদের ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন।
এ রকম হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তার জন্য হুমকি কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, অবশ্যই হুমকি। এসব হত্যাকাণ্ডে মোটিভ থাকে। এখানে হত্যাকাণ্ডের পেছনে কী মোটিভ ছিল তা তদন্তের ফলাফলে জানা যাবে।
মাওলানা ফারুকীর হত্যার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন র‌্যাব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, এশার নামাজের পর আনুমানিক ছয়-সাতজন যুবক তার কে প্রবেশ করে। কিছু সময় পর ফারুকীর স্ত্রী ও এক ছেলেসহ তিনজনকে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এরপর পৃথক কে ফারুকীকে হত্যা করা হয়।
পুলিশের তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, ফারুকীকে হত্যার পরপরই সিআইডির ক্রাইম টিম, ঢাকা মহানগরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাবের পৃথক টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া হত্যার সাথে জড়িতদের ব্যাপারে তথ্য উদঘাটনে আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে বিষয়টি তদন্ত না করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া পরিবারের লোকজনও বলতে পারছে না কেন এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ : মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী খুনের প্রতিবাদে রাজধানীর ফার্মগেট ও পূর্বরাজাবাজার এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন ফারুকীর কয়েক শ’ অনুসারী। তারা খুনিদের বিচারের দাবিতে ফার্মগেট এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এতে ওই এলাকায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। এ ছাড়া মাওলানা ফারুকীর হত্যার খবর দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তার ভক্তরা।
ফারুকী খুনের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক গাড়ি ও দোকানপাট ভাঙচুর করেছেন তার ভক্ত-অনুসারীরা। গত রাত সোয়া ১১টা থেকে বিােভ মিছিল নিয়ে ভাঙচুর শুরু করে ফারুকীর প্রায় পাঁচ শতাধিক অনুসারী। এ সময় তারা সড়কের বিভিন্ন অংশে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিােভ প্রদর্শন করে। তারা শহরের মুরাদপুর, জিইসির মোড়, দেওয়ানহাট, একে খান, ২ নম্বর গেট এসব ভাঙচুর চালায় ও আগুন জ্বালিয়ে সড়কে অবস্থান নেয়। এ দিকে খুনের প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেস কাবের সামনে বিােভ মিছিল করেছে অপর কয়েক শ’ অনুসারী। মহাসড়কে অবস্থান নেয়ার ফলে চট্টগ্রাম থেকে তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মহিউদ্দিন মাহমুদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ রয়েছে। তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া রাতে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্নস্থানে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে মাওলানা ফারুকী ভক্ত ও অনুসারীরা।
কর্মসূচি ঘোষণা : মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীর খুনিদের খুঁজে বের করতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত। আজ রাজধানীর জাতীয় প্রেস কাবের সামনে সমাবেশ ডেকেছে সংগঠনটি। এ ছাড়া আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিােভের ঘোষণা দেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বাংলাদেশের নির্বাহী মহাসচিব মাওলানা মোহাম্মদ মাসুদ হোসাইন আল কাদেরি। এ ছাড়া মাওলানা ফারুকী খুনের প্রতিবাদে আগামী রোববার ঢাকা হরতালের ডাক দিয়েছে ইসলামী ছাত্রসেনা। গত রাত সোয়া ১২টায় ফারুকীর বাসার সামনে এ ঘোষণা দেন ইসলামী ছাত্রসেনার সেক্রেটারি ইমরান হোসেন তুষার। রোববার চট্টগ্রামে হরতালের ডাক দিয়েছে ইসলামী ফ্রন্ট। আজ বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস কাবের সামনে ফারুকী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হবে।
৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ: এদিকে খুনের ঘটনায় শেরেবাংলা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহতের মেঝ ছেলে ফয়সাল ফারুকী অজ্ঞাত ৮/৯ কে আসামি করে গত রাতে এই মামলা দায়ের করেন। বুধবার দিবাগত রাতে নিহতের বাসা থেকে তিন জনকে ধরে নিয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা হলেন- রফিকুল ইসলাম, মোঃ শফিক ও  মোঃ বেল্লাল।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button