১৮ মে চ্যানেল এস এ ফান্ডরেইজিং অ্যাপিল

ইস্ট লন্ডন মসজিদের ‘ওয়াকফ ফান্ড’ চালু

ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও লন্ডন মুসলিম সেন্টারের দীর্ঘ মেয়াদী স্থায়ীত্ব অর্জনের লক্ষ্যে ‘ওয়াকফ ফান্ড’ চালু করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে চলমান ওয়াকফ-প্রথার আলোকেই এই ফান্ড চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মসজিদের ম্যানেজমেন্ট কমিটির নেতৃবৃন্দ।
১৩ মে সোমবার বিকেলে বিলেতের বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের সম্মানে আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে এসব তথ্য জানানো হয়। এসময় মসজিদের ম্যানেজমেন্ট কমিটির নেতৃবৃন্দ বলেন- ওয়াকফকৃত সম্পদের আয় থেকে মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামিক প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররামসহ অনেক মসজিদ-মাদ্রাসায় নিজস্ব ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এই ওয়াকফ সম্পত্তির আয় দিয়েই মসজিদের ব্যয় সংকুলান করা হয়। বৃটেনে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও ওয়াকফ বা ট্রাস্ট পদ্ধতি চালু আছে। সেই আলোকে আমরাও এই ফান্ড চালু করেছি। আগামী ১৮ মে শনিবার নতুন ‘ওয়াকফ ফান্ডে’র অ্যাপিল নিয়ে চ্যানেল এস টেলিভিশনে যাবো। ওইদিন বিকেল ৩টা থেকে পরদিন ফজর পর্যন্ত টেলিভিশনে থাকবো। আমরা আশাবাদী, কমিউনিটির মানুষের সাহায্যে ‘ওয়াকফ ফান্ড’কে সমৃদ্ধ করে মসজিদের দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ীত্ব অর্জনে সক্ষম হবো। ওয়াকফ ফান্ড সমৃদ্ধ করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে আর খুব বেশি ফান্ডরেইজ করতে হবেনা।

ইফতার মাহফিলপূর্ব প্রেস ব্রিফিংয়ে লিখিত বক্তব্য রাখেন মসজিদের সেক্রটারি জনাব আইয়ূব খান। বক্তব্য রাখেন চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ডাইরেক্টর দেলওয়ার খান এবং ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ূম। শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করেন মিশর থেকে আগত হাফিজ শায়খ আহমদ রজব। এসময় উপস্থিত ছিলেন মসজিদের সাবেক চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী এমবিই, ট্রাস্টি শায়খ শাফিউর রহমান, ট্রাস্টি সিরাজুল ইসলাম হীরা ও হেড অব অ্যাসেটস এন্ড ফ্যাসিলিটিজ আসাদ জামান।

লিখিত বক্তব্যে জনাব আইয়ূব খান ইস্ট লন্ডন মসজিদের অগ্রযাত্রায় বাংলা মিডিয়ার আন্তরিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মসজিদের সেবা ও উন্নয়ন কর্মকান্ডের সর্বশেষ আপডেট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০০৪ সালে ১০.৫ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে লন্ডন মুসলিম সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ২০১৩ সালে ৯.৫ মিলিয়ন পাউণ্ড ব্যয়ে নির্মিত হয় মারিয়াম সেন্টার। আর সর্বশেষ ২০১৫ সালে ১.৫ মিলিয়ন পাউণ্ড ব্যয়ে ক্রয় করা হয় মসজিদ সংলগ্ন সিনাগগ ভবন। এই তিনটি খাতে সর্বমোট ব্যয় হয় ২১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড। এই অর্থের মধ্যে প্রায় ৮৫ পার্সেন্ট আসে কমিউনিটির মানুষের দান ও ক্বরজে হাসানা (সুদবিহীন ঋণ) থেকে। আর বাকি ১৫ পার্সেন্ট আসে সরকারী গ্রাণ্ট ও বাইরের দেশের ডনেশন থেকে। সরকারী গ্রান্টের অর্থে তখন এলএমসি বিজনেস উইং নির্মিত হয়েছিলো। এই ২১.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের মধ্যে যে অর্থ ক্বরজে হাসানা হিসেবে সংগৃহিত হয়েছিলো এর অধিকাংশই আমরা পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছি। এখন মাত্র ২.৭ মিলিয়ন পাউন্ড পরিশোধের বাকি আছে। এই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হলে মসজিদটি সম্পুর্ণভাবে ঋণমুক্ত হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন বর্তমানে মসজিদের জন্য একটু বেশি করে ফান্ডরেইজ করতে হয়। কারণ মসজিদের দৈনন্দিন ব্যয় সংকুলানের পাশাপাশি ক্বরজে হাসানাও পরিশোধ করতে হয়। মসজিদের যেমন আয় আছে, তেমনি ব্যয়ও অনেক বেশি। একটি ইভনিং স্কুল, প্রাইমারি স্কুল ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলসহ ইস্ট লন্ডন মসজিদ, লন্ডন মুসলিম সেন্টার ও মারিয়াম সেন্টার পরিচালনায় ফুলটাইম, পার্ট টাইম ও জিরো আওয়ার কন্ট্রাক্টে অনেক স্টাফ কাজ করেন।

এছাড়াও তিনটি ভবন রিপেয়ার এণ্ড মেনটেইনেন্স বাবদ ৩০০ হাজার পাউণ্ড, গ্যাস বিদুৎ ও পানির বিল বাবদ বছরে প্রায় ২০০ হাজার পাউণ্ড এবং ক্লিলিং বা পরিচ্ছন্নতা বাবদ বছরে ৭০ হাজার পাউন্ড ব্যয় হয়ে থাকে। মসজিদের নিয়মিত আয় ও ফান্ডরেইজিংয়ের মাধ্যমেই আমরা এই ব্যয় সংকুলান করে থাকি। পাশাপাশি অতিরিক্ত ফান্ডরেইজিংয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর ২/৩শ হাজার পাউণ্ড করে ক্বরজে হাসানা পরিশোধের চেষ্টা করি। গত বছর আমরা প্রায় ২৫০ হাজার পাউন্ড ক্বরজে হাসানা পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছি। ফলে আমাদের ঋণের পরিমাণ ২.৭ মিলিয়ন পাউণ্ডে নেমে এসেছে। আর এভাবেই অতিরিক্ত ফান্ডরেইজ করে দৈনন্দিন ব্যয় সংকুলানের পাশাপাশি মসজিদকে ঋণমুক্ত করার চেষ্টা চলছে।

জনাব আইয়ূব খান বলেন, ইস্ট লন্ডন মসজিদ এখন তিনটি ভবন নিয়ে একটি পরিপুর্ণ মসজিদ ও কমিউনিটি সেন্টার। এখানে নামাজ, ইসলামি শিক্ষা, কমিউনিটি সেবাসহ প্রায় ৩৩টি প্রজেক্ট ও সার্ভিস পরিচালিত হয়ে আসছে। ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রতি সপ্তাহে মসজিদ ভিজিট করে থাকেন। এই মসজিদে বছরে প্রায় ১৭ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। একজন মানুষের জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেসকল ধর্মীয় সেবা প্রয়োজন হয় তার অধিকাংশই এখান থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে। তাই আমরা চাইনা ভবিষ্যতে কখনো অর্থাভাবে মসজিদের সার্ভিস প্রদানে ব্যাঘাত ঘটুক। আর তাই মসজিদের দীর্ঘ মেয়াদী স্থায়ীত্ব অর্জনে নিয়মিত আয়ের জন্য ‘ওয়াকফ ফান্ড’ চালু করেছি।

তিনি বলেন ওয়াকফের ব্যাপারে রাসুল (সাঃ)ও গুরুত্বারোপ করেছেন। সৌদি আরবের খায়বার এলাকায় হযরত ওমর (রাঃ) এর এক খণ্ড জমি ছিলো। তিনি রাসুল (সাঃ) এর কাছে জানতে চাইলেন, আমি এই জায়গাটুকু কীভাবে ইসলামের কাজে সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারি। জবাবে রাসুল (সাঃ) বললেন, জায়গাটুকু ওয়াকফ করে দিন। যাতে এই জায়গা কেউ কোনোদিন বিক্রি করতে পারবে না। শুধু ওই জমিতে উৎপাদিত ফসলাদী ইসলামের কাজে লাগানো হবে। ওমর (রাঃ) তা-ই করেছিলেন। আমরাও রাসুল (সাঃ) এর উক্ত হাদীসের আলোকে ‘ওয়াকফ ফান্ড’ চালু করেছি। এই ফান্ডে তিনভাবে দান করা যাবে। যেমন (এক). সম্পদ থেকে একটি অংশ দান করে দেওয়া। (দুই). ওয়াকফ ফান্ডকে সমৃদ্ধ করতে দীর্ঘ মেয়াদী ক্বরজে হাসানা প্রদান। (তিন). ইসলামিক উইল তথা ওসিয়তনামায় ইস্ট লন্ডন মসজিদের জন্য একটি অংশ সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে দান করা।

জনাব আইয়ূব খান ওয়াকফ ফান্ডে দান, ক্বরজে হাসানা এবং ইসলামিক উইলের অর্থ কীভাবে ব্যবহার করা হবে তারও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, কেউ যদি মসজিদে দান অথবা দীর্ঘ মেয়াদী ক্বরজে হাসানা প্রদান করেন তাহলে এই অর্থ কম ঝুঁকিপুর্ণ হালাল খাতে বিনিয়োগ করা হবে। প্রোপার্টি খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে আমাদের অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে এক হিসেবে দেখা গেছে, কেউ যদি ১০ হাজার পাউন্ড দান করেন অথবা ক্বরজে হাসানা হিসেবে প্রদান করেন, আর এই অর্থ প্রোপার্টি খাতে বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে ১০ বছর পর ৬ হাজার পাউণ্ড লাভ আসবে। কিন্তু মূলধন সংরক্ষিতই থাকবে।

ইসলামিক উইল-সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জনাব আইয়ূব খান বলেন, ইসলামিক উইলকে বাংলাদেশে ওসিয়ত বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ তাই কারো মৃত্যুর পর ইসলামি শরীয়াহ অনুযায়ী তাঁর সম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বৃটেনে বৃটিশ আইন অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন হয়। এতে অনেক ক্ষেত্রেই শরীয়াহ আইন অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন না হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মনমালিন্যের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সম্পদ নিয়ে পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে। তাই এই জন্য মৃত্যুর আগে একজন দক্ষ আইনজীবীর মাধ্যমে সম্পদের উইল প্রস্তুত করে গেলে মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন নিয়ে আর ঝামেলা হওয়ার আশংকা থাকে না।

তবে ইসলামিক উইল যে মৃত্যুর পর শুধু সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনই নিশ্চিত করে তা নয়, বরং বড় অংকের ট্যাক্স প্রদান থেকে বাঁচাতেও সাহায্য করতে পারে। কারণ বৃটিশ আইন অনুযায়ী, যদি কারো সম্পদ ট্যাক্সের আওতাভুক্ত হয় এবং তিনি উইল না করে মৃত্যুবরণ করেন তাহলে সর্বোচ্চ ৪০ পার্সেন্ট পর্যন্ত ট্যাক্স সরকারকে প্রদান করতে হয়।
উইল সংক্রান্ত বৃটিশ আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কেউ যদি মৃত্যুকালে ৩২৫ হাজার পাউণ্ডের বেশি মূল্যমানের সম্পদ রেখে যান তাহলে তার উত্তরাধীকারীকে অতিরিক্ত সম্পদের জন্য (৩২৫ হাজার পাউণ্ড মুল্যের উপরের সম্পদের জন্য) ৪০ পার্সেন্ট পর্যন্ত সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করতে হয়। তিনি একটি উদাহরণ টেনে বলেন, যেমন একজন ব্যক্তি মৃত্যুকালে ৪২৫ হাজার পাউণ্ড মূল্যের প্রোপার্টি রেখে গেলেন। তাহলে মৃত ব্যক্তির উত্তরাধীকারীদেরকে ৩২৫ হাজার পাউণ্ডের উপরের অতিরিক্ত ১০০ হাজার পাউণ্ডের জন্য ৪০ পার্সেন্ট অর্থাৎ ৪০ হাজার পাউণ্ড ট্যাক্স দিয়ে দিতে হবে। তবে যদি ওই ব্যক্তি তাঁর মৃত্যুর আগে ৪২৫ হাজার দামের সম্পদ থেকে ১০০ হাজার পাউণ্ড কোনো মসজিদ, মাদ্রাসা কিংবা চ্যারিটিতে দান করে যান তাহলে তাঁর পরিবারকে কোনো ট্যাক্স প্রদান করতে হবে না। তবে কেউ পুরো ১০০ হাজার পাউণ্ড চ্যারিটিতে দান না করতে চাইলে ১০ পার্সেন্ট অর্থাৎ ১০ হাজার পাউণ্ডও দিয়ে দিতে পারেন। এতেকরে বাকি ৯০ হাজার পাউণ্ডের ওপর ট্যাক্স অনেক কম পড়বে। যাঁরা ইস্ট লন্ডন মসজিদে তাঁদের কোনো প্রোপার্টি উইল করতে চান তাদেরকে মসজিদের পক্ষ থেকে একটি সলিসিটর কোম্পানীর মাধ্যমে সহযোগিতা করা হবে বলেও তিনি জানান।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button