মুরসি ইসলামপন্থী, এটাই কি তাঁর অপরাধ?

ফরীদ আহমদ রেজা
মিশরের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন মুহাম্মাদ মুরসী। গতকাল সেনা অভ্যূত্থানের মাধ্যমে তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে। তবে সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি বলছেন, এটা কোন সেনা অভ্যূত্থান নয়, জনগণের আকাঙ্খা বাস্তবায়নের জন্যেই সেনাবাহিনী হাল ধরেছে। এটা যদি সেনা অভ্যূত্থান না হয় তা হলে সেনা অভ্যূত্থান কোনটা? দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়েছে, একটি গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গৃহবন্দি, আরো বহু রাজনৈতিক নেতা আটক রয়েছেন, শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করা হয়েছে, ৭টি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং সেনাপ্রধানের নির্দেশ পালন করে প্রধান বিচারপতি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। এর পরও যদি সেনাপ্রধান বলেন, এটা সেনা-ক্যু নয় তা হলে সেনা-ক্যু’র সংজ্ঞা নতুন করে নির্ধারণ করতে হবে। অন্যান্য দেশের অভ্যূত্থানকারীদের মতোই মিশরের সেনাপ্রধান জোর দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে। বিশ্বের হাজারো গণতান্ত্রিক মানুষের প্রশ্ন, মিশরীয় সেনাবাহিনী কি সত্যি ব্যারাকে ফিরে যাবে? সেনাবাহিনীর ঘোষণায় নির্বাচনের কোন সময়সীমা নির্ধারণ হয়নি। পৃথিবীর অন্যান্য সামরিক অভ্যূত্থান থেকে আমরা কি শিক্ষা লাভ করি? তারা কি কখনো ব্যারাকে ফিরে যায়? মিশরে অবশ্য যেতে পারে, যদি হুসনি মোবারক স্টাইল শাসন আবার ফিরে আসে। হতে পারে সে লক্ষ্যেই বর্তমান ক্যু সম্পন্ন করা হয়েছে।
মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর অন্তরবর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন সুপ্রিম কনস্টিটিশনাল কোটের প্রধান বিচারপতি আদলি মনসুর। গত সোমবার মুরসি তাকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন এবং বৃহস্পতিবার তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। হুসনি মোবরক সরকারের ঘনিষ্টদের সাথে তার সম্পর্ক আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিচারপতি হিসেবে তার প্রদত্ত একটি রায়ের কারণে হুসনি মোবারকের প্রধানমন্ত্রী আহমাদ শফিক গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পেরেছিলেন। পর্যবেক্ষক মহলের আশঙ্কা আহমাদ শফিক এখন দেশে ফিরে আসবেন। হুসনি মোবারকপন্থী আরো যারা বিদেশে আছেন এবং ঘাপটি মেরে দেশে বসে আছেন তারা এখন গা ঝাড়া দিয়ে উঠবেন। এ ভাবেই কি তাহলে তাহরির স্কোয়ারের সংগ্রামী জনতার আকাঙ্খা পূর্ণতা লাভ করবে?
কেন মুরসিকে অপসারণ করা হলো, এ প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তর দেয়া কঠিন। প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে দুর্নীতি কিংবা স্বজনপ্রীতির কোনো অভিযোগ নেই। উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তাঁর কমিটমেন্ট সুস্পষ্ট। রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিজীবনে ইসলামের কঠোর অনুসারি মুরসি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে জেলও খেটেছেন বারবার। এক বছরের শাসনামলে তার প্রতিপক্ষরা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হননি। তিনি কোন পত্রিকার বন্ধ করেননি, কোন টেলিভিশন চ্যানেল বাতিল করেননি। যারা তার দলের অফিসে হামলা করেছে তাদের নির্যাতন করেননি। তার বিরুদ্ধে পরিচালিত মিছিল বা সমাবেশে গুলি চালানোর নির্দেশ দেননি। স্বৈরশাসকের যাঁতাকলে নিস্পেষিত মিশরবাসী তার সময়ে গণতন্ত্রের পূর্ণ স্বাদ লাভ করেছে। এটাই কি তাঁর অপরাধ?
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যারা সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা তারা কেউ নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সেনাবাহিনী কর্তৃক অপসারণের নিন্দা করেনি বা একে সেনা-অভ্যূত্থান হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। দুটি দেশ ছাড়া মুসলিম বিশ্বের রাজা-বাদশাহ বা আমীর-প্রধানমন্ত্রীরাও এর নিন্দা করেননি। এ ঘটনাকে অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছে তুরস্ক আর সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে তিউনিসিয়া। সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক শাসক এই সেনা অভ্যূত্থানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ মিশরের নতুন অন্তরবর্তীকালীন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদ তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভকারীদের প্রশংসা করে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করায় ‘রাজনৈতিক ইসলামের’ বিদায় হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমির মিশরীয় সেনাবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। আর এ ঘটনায় বুদ্ধিমানের মতো চুপ থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে মুরসির ক্ষমতাগ্রহণে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত রাষ্ট্র ইসরাইল।
মুরসী পদচ্যূত হবার পর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন এ ঘটনায় তিনি ‘ডিপলি কনসার্নড’ – গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বৃটিশ বিদেশমন্ত্রীর মন্তব্য হচ্ছে, ‘এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক হস্তক্ষেপ’। তবে এর সাথে তিনি যোগ করেন, ‘তবে এ হস্তক্ষেপের পক্ষে জনসমর্থন রয়েছে।’ এর মানে হচ্ছে মিশরে সেনা অভ্যূত্থান নিয়ে বৃটিশ সরকার চিন্তিত নয়, কারণ জনগণ এর পক্ষে রয়েছে। এর মানে কি এ যে জনসমর্থন থাকলে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করা অনৈতিক বা অগণতান্ত্রিক নয়? সত্যি কথা বলতে কি, এ ধরণের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতেই আজকের বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে।
মিশরের স্বৈরশাসক হোসনী মোবারক পদচ্যূত হবার পূর্ব পর্যন্ত সেখানে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবার পরও সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট মুরসীর প্রতি যথাযোগ্য আচরণ করেনি। প্রেসিডেন্ট মুরসী কতিপয় উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠালেও সেনাবাহিনীর মধ্যে বড় ধরণের কোন পরিবর্তন সাধন করেননি। রাজপথে মুরসী বিরোধী আন্দোলন জমে উঠার অজুহাতে সেনাবাহিনী তাদের পুরানো ভূমিকায় অবতীর্ন হবার সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। যথানিয়মে জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে তারা ক্ষমতা দখল করেছে। সেনাবাহিনীর ফাঁস হওয়া রোডম্যাপ থেকে জানা যায়, সরকার বিরোধী আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনী মুরসীকে ক্ষমতাচ্যুত করে একজন জেনারেলকে প্রধান করে সরকার গঠনের পরিকল্পণা গ্রহণ করে। মিশরের সেনাবাহিনী প্রতিবছর বিপুল পরিমান মার্কিন সাহায্য লাভ করে থাকে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে বর্তমান অভ্যূত্থানের পেছনে মার্কিন সাহায্যও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে।
একটি-দুটি নির্বাচন হলেই কোন দেশে গণতন্ত্র সুসংহত হয়ে যায় না। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি ও মূল্যবোধকে সুসংহত করার জন্যে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ, সিভিল প্রশাসন, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি দেশের জনগণসহ সবাই মিলে কাজ করতে হয়। গণতন্ত্র একটি অভ্যাস যা একটি সমাজের জনগণের মধ্যে ধীরে ধীরে দানা বাঁধে এবং পরিপক্ক হয়। স্বৈরতন্ত্র থেকে উত্তরণের এক বছরের মধ্যে মিশর সে পর্যায়ে পৌঁছে যাবে বলে ভাবা যায় না। গতকালের সেনা অভ্যূত্থান গণতান্ত্রিক মিশরের জন্যে নিঃসন্দেহে একটা বড় আঘাত।
বিচারবুদ্ধির দাবি হচ্ছে, যারা গণতান্ত্রিক চেতনার অধিকারী তাদের মিশরে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া দরকার। মুরসি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাকে অপসারণ করার অধিকার সৈনিকদের নেই। গণতান্ত্রিক নিয়মে বিরোধী দল মধ্যবর্তী নির্বাচন দাবি করতে পারে। সেটা না করে সেনা ক্যু করা হয়েছে, এটা অগণতান্ত্রিক। মুরসির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তিনি বিরোধী দলের সাথে মিলে মিশে কাজ করেন নি। এটা চরম মিথ্যাচার। তিনি বামপন্থি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সামদান সাবীহকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তিনি নিজে মুসলিম ব্রাদারহুডের এবং ব্রাদারহুড পার্লামেন্ট-সদস্য সংখ্যার দিক দিয়ে বেশি থাকলেও মন্ত্রীসভায় ব্রাদারহুড ছিল শতকরা ৩০ ভাগ মাত্র। মুরসির বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ, যারা আন্দোলন করে মিশরে পরিবর্তন এনেছে তাদের আকাঙ্খা পূরণ করতে পারেননি। আন্দোলনে কি মুসলিম ব্রাদারহুড ছিল না? মোবারক বিরোধী আন্দোলনে ব্রাদারহুড অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। যুগ যুগ ধরে পরিচালিত স্বৈরশাসন থেকে উত্তরণের পর এক বছরের মধ্যে মানুষের সকল অকাঙ্খা পূরণ কি এতোই সহজ? কোন দল বা ব্যক্তির পক্ষে মিশরের মতো বিরাট একটি দেশে এক বছরে মানুষের আকাঙ্খা পূরণ সম্ভব নয়। আসলে তিনি ইসলামপন্থী, এটাই তাঁর বড় অপরাধ এবং এ জন্যেই তাকে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়েছে। তবে যে সংগঠন নাসের, সাদাত এবং মোবারকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এতদূর এগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করা এতো সহজ নয়।
মুরসীর আরো অনেক দোষ আছে। তিনি হামিদ কারজাই, বাসার আল আসাদ বা বাদশাহ আব্দুল্লাহ হতে পারেননি। ইসলামপন্থী হিজবুত তাহরিরের কাছে তার দোষ তিনি গণতন্ত্রী। সালাফিদের কাছে তিনি মডারেট, আধুনিক। সেকুলার গণতন্ত্রীদের কাছে তিনি ইসলামী। ইসরাইল এবং তার বন্ধুদের কাছে তিনি বিপজ্জনক ইসলামপন্থী যার গণভিত্তি রয়েছে এবং তিনি সমসাময়িক সমস্যার মোকাবেলা করার যোগ্যতা রাখেন। আল-কায়েদার কাছে তিনি আপোসকামী। রাজা-বাদশাদের কাছে তিনি বিপজ্জনক, কারণ তিনি জনগণের রায়কে শ্রদ্ধা করেন। সুন্নী বিশ্বে ইসলামী লেবাসে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গহণ করলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশাহদের ভবিষ্যত অন্ধকার। যারা বলে গণতন্ত্র হারাম, যারা পরিবর্তন বিরোধী ইসলামপন্থী, যারা ছিল হুসনি মোবারকের সহযোগী, যারা ইসলামের চেয়ে স্বৈরশাসনকে পছন্দ করে এবং যারা মুরসিকে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের স্বার্থ হাসিলের পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছে তারা সবাই মিশরে সেনা অভ্যূত্থানের পর বগল বাজিয়ে উদ্বাহু নৃত্য করছে।
একটা মিলিয়ন পাউন্ডের প্রশ্ন রেখেছেন বিবিসি’র সাংবাদিক জনাথন মার্কাস। মিশরসহ গোটা পৃথিবীর সর্বত্র যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক ও বাহক তাদের সকলের শঙ্কা এ প্রশ্নের মাধ্যমে সামনে চলে এসেছে। তিনি বলেছেন, একজন ইসলামপন্থী ব্যক্তি গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হবার পর এক বছরের মাথায় যদি তাকে বন্দুকের জোরে সরিয়ে দেয়া হয় তা হলে এ থেকে মানুষ কি শিক্ষা গ্রহণ করবে? এ ধরণের ঘটনার পর আলোচ্য ইসলামপন্থী পার্টিসহ অন্যান্য ইসলামপন্থী দল বা জোট কি তাদের কর্মকৌশল নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করবে না? তারা যদি এ ঘটনায় হতাশ ও বিরক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক পথ পরিহার করে সন্ত্রাস বা চরমপন্থা অবলম্বন করে তা হলে কি উপায় হবে? সুশীল সমাজ বা গণতান্ত্রিক শক্তি কি সহজে তাদের প্রতিহত করতে পারবে? বর্তমান পৃথিবী অসংখ্য দল-উপদলের অস্তিত্ব রয়েছে যারা বলে গণতন্ত্র নয়, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। যারা তা বলে তাদের মধ্যে ডানপন্থী আছে, বাম পন্থী আছে, আছে মধ্যপন্থী লোক। মিশরের সেনা অভূত্থানের কারণে তাদের উৎসাহ বহুগুণ বেড়ে যাবে। সেনাবাহিনী যদি চরমপন্থীদের দমন করতে না পারে তা হলে তারা হয়তো এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধে নাম লেখাবে। এটা কোন মিশরবাসীর কাম্য হতে পারে না।
লেখক লন্ডন প্রবাসী শিক্ষক, কবি ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button