প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারি বিমানকে ৩৭ মিনিট আকাশে চক্কর দিতে হয়েছে

ঢাকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ

শহীদুল ইসলাম: ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান সৌদি আরব থেকে ঢাকা আসার পরও সময় মতো নামতে পারেনি। নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় বিমানটিকে ৩৭ মিনিট ঢাকার আকাশে চক্কর দিতে হয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে বাঘ এলো নয় এসে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়াসহ বিদেশীরা যে সন্দেহ করেছিলেন তা আর সন্দেহ নেই এখন তা বাস্তব। ৬ মাস আগে বিদেশীরা যখন এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তারপরে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাস্তবে তা কোন কাজে এসেছে বলে প্রমাণ মিলছে না।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পাঁচ দিনের সৌদি সফর শেষে দেশে ফিরে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানটি। আর এ দুর্ঘটনা এড়াতে বিমানটিকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আকাশে অন্তত ৩৭ মিনিট চক্কর দিতে হয়েছে।
জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের ভিভিআইপি ফ্লাইট উড্ডয়ন-অবতরণের আগে এসএসএফ বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। সেদিন রানওয়ে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এসএসএফ সদস্যরা দেখতে পান রানওয়ের ঠিক মাঝামাঝি স্থানে বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ মেটালিক বস্তু পড়ে  আছে। এসব বস্তু দেখে তারাও আঁতকে ওঠেন। বিমানটি অবতরণের আগ মুহূর্তে কন্ট্রোল টাওয়ারের মাধ্যমে ফ্লাইটটি অবতরণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)।
বিষয়টি ফ্লাইটের পাইলট ক্যাপ্টেন জামিলকে জানানোর পর মুহূর্তে পাইলট বিমানটি অবতরণের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। পরে উপায়ান্তর না দেখে আকাশে চক্কর দিতে থাকে। প্রায় ৩৭ মিনিট আকাশে চক্কর দেয়ার পর ৭টা ৫০ মিনিটে অবতরণের অনুমতি পান পাইলট।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রানওয়ে থেকে যেসব মেটালিক বস্তু অপসারণ করা হয়েছে সেগুলো না সরালে ফ্লাইটটি ল্যান্ড করার পর বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা ছিল। উড়োজাহাজের চাকা ফেটে গিয়ে জাহাজটি রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়তে পারত। মেটালিক বস্তুগুলো উড়োজাহাজের ইঞ্জিনে ঢুকে যেতে পারত। এতে আগুনও ধরার সম্ভাবনা ছিল। এছাড়া চাকার সঙ্গে ঘর্ষণেও উড়োজাহাজে আগুন ধরে বড় ধরনের ক্রাশ হওয়ারও আশঙ্কা ছিল। তাদের মতে, এসএসএফের বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় অল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের ওই ভিভিআইপি ফ্লাইটটি রক্ষা পেয়েছে। পরে এসএসএফ সদস্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেটালিক বস্তু সরিয়ে নেয়ার পর ফ্লাইটটিকে অবতরণের সংকেত বার্তা পাঠান ককপিটে। তারপর রাত আটটার দিকে সেটা নিরাপদে অবতরণ করে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে হাজির হওয়া সরকারের মন্ত্রী ও ভিআইপিরা এ খবর জেনে আঁতকে ওঠেন। এ সময় একাধিক মন্ত্রী জানতে চান, রানওয়ে ক্লিয়ার রাখা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্ব কার?
এঘটনার পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে আবারো প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইট অবতরণ হবে সেখানে রানওয়েতে ঝুঁকিপূর্ণ এ ধাতব বস্তুগুলো কীভাবে আসলো এ নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বড় ধরনের কোনো নাশকতার লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে কেউ এটা করছে কি না এমন প্রশ্নও কারো কারো মনে দেখা দিয়েছে। যদিও দাবি করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআরের একটি এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন থেকেই ওই মেটালিক বস্তুগুলো রানওয়েতে পড়েছিল।
সিভিল এভিয়েশনের অ্যারো এটিএস (এয়ার ট্রাফিক সিস্টেম) বিভাগের উচিত ছিল রানওয়ে থেকে মেটালিক বস্তুগুলো অপসারণ করা। কিন্তু অভিযোগ আছে, ভিভিআইপি ফ্লাইট আছে জেনেও এটিএস বিভাগ তা করেনি।
আর বাংলাদেশ বিমানের নতুন কেনা বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজের ইঞ্জিন এভাবে বিকল হওয়া বা ইঞ্জিনের ভেতর থেকে ধাতব টুকরা ছিটকে পড়াটাও অস্বাভাবিক বলে মনে করেন বিমানের কর্মকর্তারা। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘটনায় আবারও শাহজালাল বিমানবন্দরের রানওয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনায় সিভিল এভিয়েশনের গাফিলতি ও দৈন্যদশার চিত্র ফুটে উঠেছে।
জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের এটিএস আর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী ও সদ্য গঠিত এভসেক সেল বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করছেন। তাদের পেশাগত কর্মদক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সাধারণ নিরাপত্তা বিভাগের পাশাপাশি অতিরিক্ত ইউনিট হিসেবে এভসেক মোতায়েন করার পরও কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন একাধিক মন্ত্রী ও ভিআইপি।
জানা যায়, অর্গানোগ্রাম অনুমোদনের আগেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদারের অজুহাত দেখিয়ে তড়িঘড়ি করে এভসেক গঠন করেন মেম্বার অপারেশন। উচ্চ বেতনের নিয়োগপ্রাপ্ত এসব সদস্য নিরাপত্তার কাজের চেয়ে বসে বসে অলস সময় কাটান, আর সাধারণ নিরাপত্তাকর্মীদের ওপর খবরদারি করেন। এ নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধছে। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় শাহজালালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলেও জানান দায়িত্বরতরা।
বারবার বলার পরও আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণে ব্যর্থতার অভিযোগে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল দেশটি। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখে ৩১ মার্চের মধ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন। অন্যথায় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ব্রিটেনে যাত্রী চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর আগে অস্ট্রেলিয়াও একই পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ কারণেই ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে সরাসরি ফ্লাইটও বন্ধ রয়েছে। যেখানে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চলমান, সেখানে কেন এমন পরিস্থিতির উদয় হলো?
গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রও ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল। তখনো তিন মাসের সময়সীমা দিয়ে যৌথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা ঠিক করা হয়েছিল। ক্যামেরনের চিঠি প্রমাণ করে, সেই কর্মপরিকল্পনা পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, গত জানুয়ারিতে তৈরি পরিকল্পনা অনুযায়ী বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার জন্য আলাদা বাহিনী, জনবলের প্রশিক্ষণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করার কাজ কত দূর এগিয়েছে? সরকার বলছে, গত ১১ জানুয়ারি কর্মপরিকল্পনাটি যুক্তরাজ্যের কাছে বিনিময়ের পর বিমানবন্দরে নিরাপত্তা বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত তা বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের মানদ- উন্নয়নে সক্ষম হয়নি।
যুক্তরাজ্য সরকারের পদক্ষেপের ফলে দেশটিতে সবজি ও ফল রপ্তানি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। শাহজালালসহ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তা নিñিদ্র করতে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। নিরাপত্তার জন্য যেমন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা দরকার, তেমনি বিমান প্রশাসনকে দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত করার আবশ্যকতাও অস্বীকার করা যায় না। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যাত্রী চলাচল, নিরাপত্তা এবং ভাবমূর্তির স্বার্থেই দ্রুত এ সমস্যার সমাধান জরুরি।
ডিসেম্বর-জানুয়ারির ঘটনাবলির পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নানা ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে সরকার নিরাপত্তার স্বার্থে এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ব্রিটিশ আমেরিকা অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের এভিয়েশন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের পরামর্শে সরকার তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বার বার বলার পর সিভিল এভিয়েশন নড়েচড়ে বসে। তবে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারি বিমান ৩৭ মিনিট আকাশে চক্কর দেয়ার পর ধারণা করা হয় যে, নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, দেশের স্বার্থে দেশের ভাবমর্যাদার স্বার্থে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button