আমার জীবন জড়িয়ে আছে মদীনার সঙ্গে : মাওলানা মুহিউদ্দিন খান

Muhi Uddin Khanমাওলানা মুহিউদ্দীন খান, জন্ম ৭ বৈশাখ ১৩৪২, জুমার আজানের সময় ময়মনসিংহের মাতুলালয়ে। ইসলামী সাহিত্য সাংবাদিকতা জগতে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। বাংলা ভাষায় সিরাত চর্চা প্রবর্তন, মাআরেফুল কোরআনের অনুবাদ, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো দুষ্প্রাপ্য ও উচ্চাঙ্গের কিতাবাদি সহজ-সরল, সাবলীল ভাষায় সবার বোধগম্য করে প্রকাশ করে তিনি আমাদের কাছে দূর আকাশের দীপিত তারকা। পাঠকনন্দিত মাসিক মদীনারও যশস্বী সম্পাদক তিনি। বয়সের ভারে ন্যুব্জ আর রোগের প্রকোপে দুর্বল আলোকিত এ মানুষটি বর্তমানে সপরিবারে গেন্ডারিয়ায় নিজ বাসায় জীবন সায়াহ্ন অতিক্রম করছেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন- হাফেজ রিদওয়ানুল কাদির

প্রশ্নঃ  আপনার বর্তমানে শারীরিক অবস্থা কেমন?
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান : চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। উভয় পায়ে প্রচন্ড ব্যথা। হাঁটতে চাইলে মনে হয় মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে যাব।

প্রশ্নঃ  আপনার চিকিৎসা চলছে কোথায়?
** হ্যাঁ, রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে প্রায়ই চিকিৎসা নেই।

প্রশ্নঃ  আপনার সম্পাদনায় মাসিক মদীনা বের করার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলুন।
** সে তো অনেক কথা। মদীনা বের করার আগেও আমি কয়েকটা পত্রিকায় কাজ করেছি। দৈনিক ‘পাসবানে’ পাঁচ বছর ও সাপ্তাহিক ‘আজ’-এ দীর্ঘদিন কাজ করেছি। কিন্তু কিছু কারণে সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমার মধ্যে একটা চেতনা আসে। আমাদের দেশে একটা বিপ্লব হওয়া দরকার। আর বিপ্লবের সূচনা হওয়া দরকার ভাষার মাধ্যমে। তদুপরি ‘মদীনা’ শব্দটা যেন আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত। তাই মদীনা নামে একটা মাসিক পত্রিকা বের করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।

প্রশ্নঃ  মাসিক মদীনাকে নিয়ে বিশেষ কোনো স্মৃতি?
** আমার জীবনে মাসিক মদীনাকে কতটুকু নিষ্ঠাপূর্ণ শ্রম ও মেধা দিয়েছি, জানি না। তবে মাসিক মদীনা আমাকে যশ-খ্যাতি দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর জীবন-জীবিকায়ও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। তাই মাসিক মদীনার সঙ্গে আমার জীবনটা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে মাসিক মদীনার জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের স্মৃতিটা এখনও ভুলতে পারিনি। এখনও চোখে ভাসছে সেই অনুষ্ঠানের চিত্র। যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন তদানীন্তন বাংলার সর্বাপেক্ষা বড় পন্ডিত ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কবি গোলাম মোস্তফা, সুলেখক মশাররফ হোসেন, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, কবি তালিম হোসেন চৌধুরী, চৌধুরী শামসুর রহমান, খানবাহাদুর জসীমুদ্দীনসহ আরও অনেকেই।

প্রশ্নঃ  মাসিক মদীনা বের করার পর কোনো সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন কিনা?
** অনেক সমালোচনা হয়েছে। কত তির্যক বাক্য, কটূক্তি সহ্য করতে হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তখন অনেককে বলতে শুনেছি, হুজুররা আবার বাংলা পত্রিকা বের করবে! কত মানুষের ক্রুর হাসি আমাকে ছেঁড়াখোঁড়া করেছে, তার কোনো হিসাব নেই।

প্রশ্নঃ  তখন কিছুটা হতাশা আপনাকে গ্রাস করত না?
** অবশ্যই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের সেই স্বপ্নের কথা স্মরণ করতাম, সে স্বপ্নের কাছে তাদের এসব অবমূল্যায়ন এবং বক্র হাসি নস্যি মাত্র। ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম উম্মাহর জন্য বাংলা ভাষায় একটা স্বতন্ত্র এবং সম্মানজনক অবস্থান তৈরির যে মহান ব্রত নিয়ে আমার অগ্রযাত্রা, সে মহান অবিনাশী চৈতন্যের সামনে এসব নিন্দাবাদ কি ধোপে টিকতে পারে?

প্রশ্নঃ  যে মহান স্বপ্ন নিয়ে আপনার পথচলা, তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

** আমার জীবদ্দশায় বাস্তবায়িত হতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই। সুন্দর একটা স্বপ্নের বীজ তাদের সামনে রোপণ করলাম, পরবর্তী প্রজন্ম তা দেখে নিজেদের লক্ষ্য স্থির করে নেবে।

প্রশ্নঃ  মাসিক মদীনা বের হওয়ার পর কখনও কি বন্ধ ছিল?
** স্বাধীনতার সময় কিছুদিন বন্ধ ছিল।

প্রশ্নঃ  পাঠকদের বিচারে মাসিক মদীনার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভাগ প্রশ্নোত্তর বিভাগ। এটা করতে আপনার কষ্ট হতো না?
** কষ্ট তো অবশ্যই হতো। কত ধরনের প্রশ্ন আসত, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। দ্বীন-ধর্ম, আচার-ব্যবহার, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, রাজনীতি-অর্থনীতি সবকিছুর উত্তর তো আমাকেই দিতে হতো।

প্রশ্নঃ  শুনেছি অনেক জায়গায় মহিলারা মাসিক মদীনার নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঠচক্র করেন।
** হ্যাঁ, বি-বাড়িয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কক্সবাজারসহ অনেক স্থানে মহিলারা মদীনার পাঠচক্র করে থাকেন।

প্রশ্নঃ  সিরাত বিষয়ে তো আপনি অনেক লেখালেখি করেছেন…
** আল্লাহর শোকর করে বলছি, বাংলা ভাষায় আমিই সিরাত চর্চার প্রবর্তন করেছি। আমার আগে কেউ সিরাত নিয়ে এত লেখালেখি করেনি। এখনও তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

প্রশ্নঃ  সিরাত নিয়ে এত লেখালেখির কারণ কী?
** কারণ, আমি দেখলাম, সমাজ পরিবর্তন করতে চাইলে কিংবা সমাজে একটা নতুন বিপ্লব ঘটাতে চাইলে ব্যাপক এবং সুপরিকল্পিতভাবে সিরাত চর্চার কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু আমি অনুভব করলাম, সিরাত চর্চার ক্ষেত্রে আমাদের বাংলা ভাষা একেবারে কপর্দকশূন্য। এটাই ছিল সিরাত চর্চার প্রতি আমার অত্যধিক মনোনিবেশের কারণ। অধিকন্তু সিরাতচর্চায় আমি অন্যরকম যে আত্মিক প্রশান্তি লাভ করি, তা অন্য কোথাও অনুভব করি না।

প্রশ্নঃ  বর্তমানে সিরাত চর্চায় অগ্রগতি হয়েছে বলে আপনি মনে করেন কি?
** কিছুটা তো অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু আরও ব্যাপক পরিসরে সিরাতচর্চা হওয়া দরকার। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া যেসব কুসংস্কার আমাদের ঈমানি চেতনাকে বিনষ্ট করছে তা বিদূরিত করতে সিরাতচর্চার কোনো বিকল্প নেই।

প্রশ্নঃ  মাসিক মদীনায় সিরাত বিষয়ে যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তা সংকলনের কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
** সংকলনের অবশ্যই পরিকল্পনা আছে। আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, তিনি মাসিক মদীনা নিয়মিত পড়েন। আমি তাকে বলেছি, আপনি সিরাতবিষয়ক সব লেখা একত্রিত করুন। ইনশাআল্লাহ তা আমি ছাপানোর ব্যবস্থা করব। গ্রন্থটি যদি প্রকাশিত হয়, তাহলে বাংলা ভাষায় সিরাতচর্চায় তা হবে এক অনন্য মাইলফলক এবং অনবদ্য কীর্তি।

প্রশ্নঃ  আপনাকে যদি জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম নির্বাচন করতে বলা হয়, আপনি কোনটাকে বেছে নেবেন?
** আসলে তা নির্বাচন করা অত্যন্ত জটিল। তবে পবিত্র কোরআনের অনবদ্য তাফসির গ্রন্থ, মুফতি শফী (রহ.) বিরচিত মাআরিফুল কোরআনের বাংলা অনুবাদ, বাংলা ভাষায় সিরাতচর্চার প্রবর্তন, মাসিক মদীনা- এগুলোই তো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম।

প্রশ্নঃ  পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদ করেছেন গিরিশচন্দ্র সেন। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?
** বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কোরআনের অনুবাদ কে করেছে? বিষয়টা যথেষ্ট বিতর্কিত। তবে গিরিশচন্দ্র সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, তিনি নাকি একত্মবাদী হিন্দু ছিলেন (যদিও নাজাতের জন্য তা মোটেও যথেষ্ট নয়)। আজকালকার হিন্দুদের মতো তিনি অসংখ্য খোদার আরাধনা করতেন না। তিনি নরসিংদীর পাঁচধোনার যে বাড়িতে থাকতেন ওই বাড়িতে আমি ছাত্রাবস্থায় গিয়েছিলাম। বর্তমানে সম্ভবত তা ভেঙে ফেলা হয়েছে।

প্রশ্নঃ  এখন কি আপনি লেখালেখি করতে পারেন?
** খুব কষ্ট হয়। কারণ আমার স্মৃতিশক্তি প্রচন্ড ভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। কোনো ঘটনা লিখতে বসলে কোথাকার ঘটনা, কার সঙ্গে ঘটেছিল, সবকিছু বেমালুম ভুলে যাই। আর ইদানীং হাতের লেখা অনেক খারাপ হয়ে গেছে। কম্পোজও করতে পারি না।

প্রশ্নঃ  ইসলামী ভাবধারার অনেক মননশীল পত্রিকা বের হচ্ছে। এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
** এটা অনেক ইতিবাচক একটা দিক। কোনো নতুন ইসলামী পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, শুনলে আমি এখনও অন্য ধরনের আত্মিক প্রশান্তি অনুভব করি। এখন আমাদের অনেক মাসিক পত্রিকা। একটা ধর্মীয় পত্রিকা বের করে টিকে থাকা কতটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার, তা মনে হয় আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। এখন তো আমাদের অনেক ভালো ভালো লেখক। তারা যথেষ্ট উন্নতি করছে। আমার মনে হয়, এখন একটা বিপ্লব হওয়া দরকার। আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা আর কত দিন ‘জিম্মি’ হয়ে থাকবে? সবক্ষেত্রে আমাদের জয়জয়কার হওয়া দরকার। যেখানেই মত প্রকাশের অবারিত ক্ষেত্র, সেখানেই যেন ‘বিশ্বাসীদের’ দৃপ্ত পদচারণা থাকে, এমন নির্মল পরিবেশ তৈরি করা দরকার।

প্রশ্নঃ  বর্তমানে জাতীয় দৈনিকেও আমাদের অনেক প্রতিভাবান তরুণ যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। এটা আপনি কীভাবে দেখছেন?
** এসব সংবাদে আমি কতটা পুলকিত হই, তা কীভাবে বোঝাই? এমন কিছু সম্ভাবনাময়ী তরুণের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই তো পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তাদের দেখে অনেক আনন্দ লাগছে।

প্রশ্নঃ  আপনার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘জীবনের খেলাঘরে’ আপনার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্টে পেঁৗছে শেষ হয়ে গেল। এখন তার দ্বিতীয় খন্ড বের করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
** আসলে ‘জীবনের খেলাঘরে’ গ্রন্থটি আমি পরিকল্পিতভাবে রচনা করিনি। বরং সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান কর্তৃপক্ষ আমার কাছে লেখা চাইলে আমি তৎক্ষণাৎ লিখে তাদের দিয়ে দিতাম। পরে লেখাগুলোকে সংকলন করে ‘জীবনের খেলাঘরে’ প্রকাশিত হয়েছে। এখন তো স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা আর রোগের আধিক্যের কারণে লিখতে পারছি না।

প্রশ্নঃ  এখন আপনার সময় কাটে কীভাবে?
** কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করি। নামাজ-দোয়া পড়ি। নাতি-নাতনি, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আছি। আর প্রচুর বইপত্র পড়ি- এভাবেই মোটামুটি দিনকাল অতিবাহিত হচ্ছে।

প্রশ্নঃ  নবীন লেখকদের যদি কিছু বলতেন?
** কী উপদেশ দেব? একটা কথাই বলব, প্রচুর পরিমাণে পড় আর পড়। জগতে সেরা হতে চাইলে পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আর টুকটাক লেখার অভ্যাস গড়ে তোল। সবাইকে যশস্বী হতে হবে, আমি এটা বলছি না; কিন্তু তোমার জীবনের মহান মিশন এবং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য যাতে লেখনীর মাধ্যমে জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পার, এতটুকু তো অবশ্যই জানা উচিত।

** আপনার কোনো অপূর্ণ চাওয়া…
মুহিউদ্দীন খান : অনেক পেয়েছি এ ধরিত্রীতে। তবে শেষ চাওয়া একটাই, তালেবে এলম হয়ে যেন ঈমানের সঙ্গে আমার মৃত্যু নসিব হয়- এটাই আমার পরম চাওয়া।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button