প্রতিদিন তাপমাত্রা বাড়ছে : বদলে যাচ্ছে পৃথিবী

Changing Worldআখতার হামিদ খান: প্রতিদিনই বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির একমাত্র কারণ পৃথিবীর বায়ূমন্ডলে কতগুলো গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার জন্য এসব গ্যাস সৃষ্টি হয়। গ্রীন হাউজ গ্যাসসমূহের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ূমন্ডলের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
পরিবেশ দূষণের কারণে বায়ূমন্ডল প্রতিদিন কলুষিত হচ্ছে। ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন- আগামীতে পরিবেশগত বিপর্যয় এমনভাবে ঘটতে থাকবে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। তাই তাদের বিজ্ঞ মতামত, এই বিপর্যয় রোধ করতে হলে পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র এক হয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিপর্যয়কে শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে।
প্রতিদিনই বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির একমাত্র কারণ পৃথিবীর বায়ূমন্ডলে কতগুলো গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার জন্য এসব গ্যাস সৃষ্টি হয়। গ্রীণ হাউজ গ্যাসসমূহের মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস বায়ুমন্ডলের জন্য বিশেষভাবে ক্ষতিকর। আমাদের দেশে অবাধে ইটের ভাটা পোড়ানো, কয়লা ও গ্যাস পোড়ানো ও বনজঙ্গল পোড়ানোর মাধ্যমে এই গ্যাস মাত্রাতিরিক্তভাবে প্রতিদিন বাড়ছে। ফলে গোটা পরিবেশ দূষিত হচ্ছে-পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবী।
গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি তাপমাত্রা বাড়ছে পৃথিবীর, একথা আজ কারও অজানা নয়। এই তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্তভাবে বাড়ার কারণে গোটা বিশ্বের আবাহওয়ায় যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে- তা শুধু পরিবেশ বিজ্ঞানীদেরই ভাবাচ্ছে না, সবাইকেই উদ্বিগ্নতার মধ্যে ফেলেছে। আবহাওয়ার পট পরিবর্তনে পরিবেশের শেষ পরিণতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তবে তারা বলছেন- পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে খরা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি বাড়বে। সমুদ্রের পানির উষ্ণতা ক্রমশ বাড়ছে। ফলে বিশাল অঞ্চল জুড়ে বন্যা হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব আমরা ইতোমধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে পেতে শুরু করেছি। দেশের কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। পাশাপাশি পশুপাখিও বিলুপ্ত হতে থাকবে।
আবহাওয়া নিয়ে আসন্ন বিপর্যয়ের কথা আমরা প্রতিদিনই শুনছি। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর আবহাওয়া কেমন অবস্থায় আছে- তা সবাই জানতে ইচ্ছুক। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- ইদানিং গোটা বিশ্বের তাপমাত্রা গড়ে অর্ধেক ডিগ্রি সেলসিয়াস হারে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ শতকরা ৪০ ভাগই শ’শ’ বছর ধরে বিশাল বায়ূম-লে জমা রয়েছে। রাশিয়ার সর্বনিম্ন বার্ষিক তাপমাত্রা যেখানে অর্ধেক ডিগ্রি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখানে সর্বোচ্চ বার্ষিক তাপমাত্রার কোন বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়নি। কিছুদিন আগে এক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শতকরা ৫০ ভাগ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গাছগাছড়া,কীটপতঙ্গ ও উদ্ভিদের ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া যেকোন জায়গার বৃষ্টিপাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও তুষারপাতের হ্রাস-বৃদ্ধি ও উষ্ণতার হ্রাস-বৃদ্ধি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারি বৃষ্টিপাতের দরুন কানাডার দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকায় ও  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় ১৯৮৬ সালের পর বসন্ত ও গ্রীষ্মকালীন এলাকায় তুষারপাত শতকরা গড়ে ১০ ভাগ হারে কমেত গিয়েছে। জানা যায়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আমেরিকার মোট বার্ষিক বৃষ্টিপাতের শতকরা ১০ ভাগ বৃষ্টিই পতিত হয় একদিনে। অর্থাৎত ৫০ মিলিমিটার পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় ভারি বর্ষণের সময়। কিন্তু আগে এই হার ছিল খুবই নগণ্য।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গোটা বিশ্বব্যাপী ঝড়ের অবস্থারও আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যুক্তরাজ্যে অবস্থিত আবহাওয়া অফিসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রীণ হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধির ফলেই উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে ঝড়েরর গতি অপেক্ষাকৃত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ১৯৮০ সালে এক গবেষণায় দেখা যায় উত্তর আটলান্টিকের শীতকালীন ঝড়ের মাত্রা অপেক্ষাকৃত তীব্রতর হয়েছে আগের শতাব্দীর ঝড়ের তুলনায়।
জাপানী পরিবেশ এজেন্সী হাউজ প্রতিক্রিয়ার ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ১.৫০ সে.মি. -৩.৫০ সে.মি. বেড়ে যাবে। ফলে সমুদ্রোপকূলে অবস্থিত দেশসমূহ একটা মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন- পৃথিবীর সার্বিক মৌসুম বিজ্ঞানে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ও বিপর্যয় নেমে আসবে। পাশাপাশি গোটা ঋতুচক্র পাল্টে যাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়বে। আমাদের দেশে প্রায়ই যে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে তার মূল কারণ গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়া। যার কারণে দেশের কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। আর কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে দেশের অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও এই ধ্বংসযজ্ঞের বাইরে নয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন- পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ৩ সে.মি. এরমত বাড়ে তাহলে জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তন হবে। অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলে জমে থাকা হিমশৈল গলে সাগর ও মহাসাগরের পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। তাই পরিবেশ দূষণের ফলে কতটুকু ভয়ঙ্কর তা সহজেই অনুমের। একথা স্বীকার্য যে, সমুদ্র তলের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফল পানির লবণাক্ততা বাড়বে। এতে উপকূলীয় বাঁধের প্রচন্ড ক্ষতি হবে। উপকূলীয় এলাকায় সবচে’ ক্ষতি হবে সুন্দরবনের। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস শক্ত হাতে প্রতিরোধ করার জন্য সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ বনভূমি সৃষ্টির যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কারণ উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততার জন্য মিঠাপানি-এলাকা দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। তাছাড়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস ক্রমাগতভাবে বাড়ার ফলে পৃথিবীর সামগ্রিক তাপমাত্রা বাড়ছে। দু’মেরু অঞ্চলে জমা হয়ে আছে প্রচুর বরফখন্ড। আবহাওয়ার তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব বরফখন্ড গলতে শুরু করেছে এবং সমুদ্রের পানি বাষ্পায়িত হয়ে আকাশে মেঘমালার সৃষ্টি করছে। মেঘমালা বিকিরিত তাপকে বিজ্ঞানীরা আশংকা করছেন-অনেক মরু অঞ্চল হয়ত উর্বর হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে অনেক উর্বর অঞ্চল হয়ত মরুভূমি হয়ে যাবে। পৃথিবীর এক অঞ্চল উপকৃত হবে- অন্য অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সবুজ বনভূমি ধ্বংসের ফলে বায়ুর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমানের জনসংখ্যার চাপে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এতে করে দেশের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এতে করে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। আর এই জনসংখ্যা সমস্যার কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের কথা চিন্তা করে দেশের জমিতে শস্য উৎপাদন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট নির্মাণ, বনায়ন ও মাছ চাষ করা হচ্ছে। আমরা সবাই জানি ও মানি-পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যে পানি নিরাপদ থাকার কথা ছিল তাই এখন পরিবেশ দূষণের কারণে সবচে’ অনিরাপদ। যারা টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভরশীল তারা আর্সেনিক দূষণের কারণে বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে স্থানীয় লোকজন বিশুদ্ধ পানির জন্য যে বিকল্প উপায় গ্রহণ করবে- তাও সম্ভব হচ্ছে না জনসংখ্যাধিক্যের কারণে। এভাবে জনসংখ্যার চাপের সঙ্গে বহু সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশ দূষণের।
গাছ মানুষের পরম বন্ধু। গাছপালা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। গাছপালা বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করেও অক্সিজেন গ্যাস ত্যাগ করে। এই গ্যাসকৃত অক্সিজেন আমরা গ্রহণ করি। গাছপালা ও প্রাণীকূলের মাঝে এভাবে একটা ভারসাম্যতা থাকে। ফলে পরিবেশও ভাল থাকে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে দেশে প্রায় ২৫ ভাগ সবুজ বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে বনভূমির পরিমাণ মাত্র ১৬ গুণ ভাগ। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ পরিমাণ বনভূমি খুবই কম। দেশের বনজসম্পদ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘বৃক্ষরোপণ অভিযান কর্মসূচি’ নামক যে অভিযান চালানো হয়- তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার কারণেই প্রতিদিন পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে, বিপন্ন হচ্ছে পৃথিব। আসলে গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার সমস্যা কোন দেশের একক সমস্যা নয়। এটি একটি গুরুতর আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মারাত্মক উদ্বিগ্ন। যেসব দেশ অক্ষেপাকৃত উন্নত এবং বেশি বেশি শিল্পকারখানা আছে- সেসব দেশে এই সমস্যা আরও প্রকট। এ ব্যাপারে করণীয় হচ্ছে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে হবে এবং বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরন রোধ করতে হবে। এজন্য জ্বালানির ভিন্ন উৎসের সন্ধান করতে হবে-প্রচুর পরিমাণে বনাঞ্চল সৃষ্টি করতে হবে। পরিবেশ সচেতনাই পারে এ গুরুতর সমস্যার সমাধান দিতে, এজন্য বিশ্ববাসী এক হয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
কোন মানুষই হুমকির মুখে বাঁচতে চায় না বহুমাত্রিক আবিষ্কারের প্রতিক্রিয়ার মাঝে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যভাবেই জীবন ধারণ করুক-এটাই সবার কাম্য। এজন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করা জরুরি, এখনই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button