মাহমুদ দারবিশ : ফিলিস্তিনের এক অসাধারন কবির কথা

Mahmudফয়সাল বিন খালেদ:
মাহমুদ দারবিশ, ফিলিস্তিনিদের জাতীয় কবি, অজস্র ফিলিস্তিনির মতো হারিয়েছিলেন তার গৃহ, গ্রাম, শৈশব। হানাদার ইসরাইলি সৈন্যরা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তার স্বদেশ-মাতৃভূমি, পরিচয়। কিন্তু পরিচয় ও ভূমিহীন মাহমুদ দারবিশ দেখিয়েছেন একজন কবি, ভাষা-কবিতার মাঝে কিভাবে নির্মাণ করে নিতে পারে তার মাতৃভূমি-স্বদেশ পরিচয়, হারানো শৈশব ও মায়ের ভালোবাসা।
‘আমি ভূমির জন্য গান গাই না’ একটি কবিতায় দারবিশ বলেছেন ‘কারণ আমিই ভূমি’। অস্ত্রহীন ফিলিস্তিনি তরুণরা ইসরাইলি সৈন্যদের রাইফেলের গুলি ও ট্যাংকের গোলার মুখে ছুড়েছে নির্বাক পাথর। মাহমুদ দারবিশ দেখিয়েছেন নিরীহ ভাষা-কবিতা কিভাবে পরাজিত করে দিতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর পরাশক্তিকে। জীব ছেড়া ফিলিস্তিনিদের চিৎকার ও বিজয়ী ভাষার নাম মাহমুদ দারবিশ। ফিলিস্তিনহীন পৃথিবীর মানচিত্রে দারবিশের কবিতা লাল ফিলিস্তিন।
মাহমুদ দারবিশ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালে, ফিলিস্তিনের এক অখ্যাত গ্রাম ‘আল-বোরোতে’। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলি সৈন্যদের ফিলিস্তিন দখলের সময়, এক ভয়াবহ রাতে আক্রান্ত হয় দারবিশের এই ছোট্ট গ্রামটিও। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় দারবিশের পরিবার। ইসরাইলি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা লুকিয়ে ছিলেন ক্ষেতের মাঝে। পরে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেন লেবাননে। এক বছর পর, সাত বছর বয়সে, দারবিশ লেবাননের সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেন ফিলিস্তিনে, তার হারানো জন্মভূমিতে। কিন্তু শিশু দারবিশ দেখলেন ইসরাইলি গোলার আগুনে পুড়ে গেছে তার বাড়ি-গ্রাম-ফিলিস্তিনের মানচিত্র।
ফিলিস্তিনের সন্তান মাহমুদ দারবিশ ফিলিস্তিনে প্রবেশ করেন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয়ে। ১৯৬৯ সালে ইসরাইলি কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘জো হাদারেক’-এ এক সাাৎকারে দারবিশ বলেছেন : ‘সেই একটি রাত সবাইকে শরণার্থী বানিয়ে দেয়… লেবাননে আমি শরণার্থী ছিলাম। ফিলিস্তিনেও আমি শরণার্থী হয়ে আছি।’ এটা কোনো কাব্যিক দীর্ঘশ্বাস ছিল না। ইসরাইলি রাষ্ট্রের প্রথম আদমশুমারিতে যেসব ফিলিস্তিনি অন্তর্ভুক্ত হয়নি, নতুন ইসরাইলি সরকার তাদের পরিচয়পত্র দেয়নি। তাদের চিহ্নিহ্নত করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। ফলে দারবিশের মতো অজস্র ফিলিস্তিনি নিজ জন্মভূমিতে হয়ে থাকে অবৈধ অভিবাসী।
লেবানন থেকে ফিরে আসার পর তার প্রাথমিক শিা শুরু হয় ‘দাইরুল আছাদ’-এ, আত্মপরিচয় গোপন করে। কারণ ইসরাইলি সরকারের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অবৈধ অভিবাসী। তিনি জানতেন ধরা পড়লে তাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। তার মাধ্যমিক শিা ‘কাফার ইয়াসিফ’ গ্রামে। মাধ্যমিক শিার পরই তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা তৎপরতায়। তার জীবন হয়ে ওঠে শুধু কবিতা লেখা এবং কবিতার মাধ্যমে লড়াই করা।
দারবিশ তখন এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ খুঁজছিলেন। এই সময় তিনি ইসরাইলি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং পার্টির পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামের একটি শক্তিশালী অস্ত্র হয়ে উঠেছিল কবিতা। ‘আমছিয়া’ বা সান্ধ্য কবিতা পাঠ অনুষ্ঠানগুলোতে গ্রামে গ্রামে গিয়ে দারবিশ কবিতা পাঠ করতেন, যা ফিলিস্তিনিদের দারুণ প্রভাবিত করেছিল। ইসরাইলি সরকার শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং তার আমছিয়াগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেই সময় ইসরাইলি সৈন্যরা সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত দারবিশকে গৃহবন্দী করে রাখত।
স্বাভাবিক কারণেই ইসরাইলে দারবিশের এই রাজনৈতিক তৎপরতা নির্বিঘ্ন হয়নি। ১৯৬১, ১৯৬৫, ১৯৬৭ সালে তিনি তিনবার জেলে গিয়েছিলেন। সত্তরের দশকের শুরুতে তিনি বইরুত চলে যান। তত দিনে কবি হিসেবে দারবিশ বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ১৯৭৭ সালে বের হয় তার বিখ্যাত জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ ‘আবিরুনা ফি কালামিন আবিরিন’, যা ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এই সময় দারবিশ ‘আল্লাজনাতুত্তানফিযা লি মুনাজ্জামাতিত তাহরিরির ফিলিস্তিনি’তে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি দীর্ঘ দিন ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে কাজ করেছিলেন। ফিলিস্তিনি সরকার গঠনকালে আরাফাত তাকে সাংস্কৃতিক মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। দারবিশ তা গ্রহণ করেননি। দারবিশ বলেছিলেন, আমার একমাত্র আকাক্সা বারুদের ধোঁয়ামুক্ত ফিলিস্তিনে বসে কবিতা লেখা। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পর দারবিশ এই দল থেকে বের হয়ে যান। এরপর তিনি আরাফাতের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখেননি। তিনি প্রতিবাদ করে বলেছিলেন : ‘এই চুক্তিতে ইনসাফ নেই, এই চুক্তিতে ফিলিস্তিনি পরিচয়ের ন্যূনতম অনুভূতি এবং তার ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতি কোনো ল রাখা হয়নি। এই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের একটি যাযাবর জাতিতে পরিণত করবে।’ তার পরও দারবিশ আরাফাতকে ভালোবাসতেন।
আরাফাতের মৃত্যুর পর এক সাাৎকারে দারবিশ বলেছিলেন : ‘‘পৃথিবীর কানে যারা ‘ফিলিস্তিন’ শব্দটি তুলেছেন আরাফাত তাদের অন্যতম। আরাফাত তার জীবনকে এর জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। আরাফাত কখনো নিজের জন্য বাঁচেননি আমি চাই আমার স্মৃতিতে আরাফাতের এই চিত্রটি জেগে থাক। আরাফাতকে আমরা খুব মিস করি কিন্তু আমরা আর কোনো আরাফাত চাই না…’’
দারবিশ ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মাঠে ছিলেন। তবে তিনি লড়েছেন ভাষা কবিতা দিয়ে। এই সময় দারবিশের কবিতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বদল ঘটে। তিনি, তার এর আগের কবিতায় যে কাব্যিক জটিলতা ছিল তা থেকে ফিরে আসেন। তিনি দেখতে পান তার এ ধরনের কবিতাগুলো সাধারণ মানুষ-যোদ্ধারা বুঝতে পারে না।
দারবিশ কবিতা লিখতে শুরু করলেন সরল ভাষায়, সহজ করে, যা বুঝতে পারে সাধারণ মানুষ, উদ্দীপ্ত করে সাধারণ মুক্তিসংগ্রামীদের। এই সঙ্কলনের চৌদ্দটি কবিতার তেরোটিই এই সময়, মু্ক্তিযোদ্ধাদের সাথে অবস্থানকালে লেখা।
নানা দেশ ঘুরে ১৯৯৪ সালে দারবিশ ফিলিস্তিনের রামাল্লায় ফিরে আসেন এবং ইসরাইলি সৈন্যরা তাকে গৃহাবোরোধ করে রাখে। অবরোধকালে দারবিশ নিরন্তর লিখেছেন, ইসরাইলি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়েছেন ভাষা-কবিতা দিয়ে। ২০০২ সালের মার্চে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের একটি দল গৃহবন্দী দারবিশের সাথে সাাৎ করতে রামাল্লায় গিয়েছিলেন।
দারবিশ কবিতাকে গ্রহণ করেছিলেন শিশুকালেই। স্কুলজীবনে তিনি কাসিক আরবি কবিতার সবটুকু পড়ে ফেলেছিলেন। দারবিশজীবনে প্রথম কবিতা পাঠ করেন নতুন ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদযাপন অনুষ্ঠানে। দারবিশ তখন স্কুলের ছাত্র। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে দারবিশ স্বরচিত কবিতা পাঠ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘সেখানেই জীবনের প্রথমবারের মতো আমি মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা পাঠ করি। কবিতাটি ছিল এক ইহুদি বালকের প্রতি এক ফিলিস্তিনি বালকের আর্তনাদপূর্ণ আহ্বান। পুরো কবিতাটি আজ আর মনে নেই। তবে তার মূল ভাবনাটি ছিল এই : ‘তুমি চাইলেই সোনালি রোদে খেলা করতে পারো, তুমি চাইলেই পাও উজ্জ্বল পুতুল, কিন্তু আমার তা নেই। তোমার আছে ঘর, আমার কিছুই নেই। তোমার আছে উৎসব আর উদযাপন, কিন্তু আমি তার দেখা পাই না। বল কেন আমরা একসাথে খেলতে পারি না? পরদিন ইসরাইলি সামরিক সরকারের লোকরা তাকে ডেকে নিয়ে শাসায়। তাকে বলা হয় ‘যদি আর এ ধরনের কবিতা লেখো তো তোমার বাবার কাজ করতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হবে।’ দারবিশ লিখেছেন ‘আমি বুঝতে পারিনি একটি কবিতা কেন এই সামরিক সরকারকে এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সেই ছিল প্রথম ইহুদি সন্তান, যার সাথে আমার দেখা এবং কথাবার্তা। আমি খুব হতাশ হয়ে পড়ি, এই যদি হয় তাহলে ইহুদি বালকের সাথে কথা বলে আর কী লাভ হবে?’
লেনিন সাহিত্য পুরস্কারসহ দারবিশ তার কাব্যকীর্তির জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তবে তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার তার প্রতি ফিলিস্তিনিদের ভালোবাসা। দারবিশ প্রধানত কবিতা লিখেছেন, লিখেছেন নিরবধি। বিপুল তার আলোচনা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button