দিনটি হোক আনন্দের, চেতনা হোক মুসলমানের

ইনাম চৌধুরী
এক ফালি বাঁকা চাঁদ। আকাশের ওই কোণে। লক্ষ কোটি চোখ খুঁজে বেড়ায় সেই চাঁদের ফালিটুকু। কারণ এটিই ঈদুল ফিতরের চাঁদ। দেখতেই হবে-না হলে যেন পূর্ণতাটুকু আসছে না। এটির একটি কারণ অবশ্য আছে এই চাঁদের বক্র রেখাটুকুর স্থায়িত্ব মাত্র দুমিনিট। আকাশের ওই কোণটিতে। তাই দুমিনিটেই সেরে নিতে হয় ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখার আনন্দ। সেটি দেখে নিতে পারার সওয়াব আবার সেই ক্ষণিকের দেখাটুকুর আনন্দকে অন্য দর্শনার্থীর সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার এক অনির্বচনীয় আত্মতৃপ্তি। সারাবিশ্বে জনগোষ্ঠীর মাথা গুনতি হিসাবে মানুষের সংখ্যা হলো সাতশত পঞ্চাশ কোটির মতো। এরা সবাই মানুষ এবং প্রত্যেকেই এক একটি আলাদা সত্তা। জ্ঞানী ব্যক্তিরা প্রতিটি মানবসত্তাকে একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। অর্থাৎ সবার চিন্তাধারা, সাফল্য-ব্যর্থতা এবং জীবনচয়ন পুরো আলাদা। এরা একইভাবে কখনো চিন্তা করতে পারেনা আবার কখনো বা প্রায় সমান্তরাল চিন্তা ভাবনা করতে সক্ষম হয়। সে হিসাবে একটি নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছুতে একটি দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তির প্রয়োজন হয় এবং সেই বিশ্বাসটি হলো ধর্মীয় বিশ্বাস। আজ সারা বিশ্বে প্রধানত ধর্ম হিসাবে পাঁচটির হিসাব থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে, গোষ্ঠীগতভাবে এবং গোত্রপ্রধানের অনুসৃত নীতি হিসাবে ধর্মের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও ওপর। মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য শেষ নবী পাঠিয়েছেন চূড়ান্ত একটি ধর্মের বার্তাসহ। সেই ধর্মই হলো শান্তির ধর্ম ইসলাম। আজ সারা বিশ্বে প্রায় একশত বিশ কোটি মুসলমান রয়েছেন। তারা শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হিসাবে অত্যন্ত কঠোর নিয়মনিষ্ঠ জীবন যাপন করছেন। এই নিয়মনিষ্ঠ জীবনে বছরে একটি মাস মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন তাদর জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন রমজানুল মোবারক হিসাবে। এই মাসটিতে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী কঠোর সংযম সাধনা করবে। আহার বিহার দৃষ্টি, কর্ম সবকিছুর নিয়ম মাফিক ব্যবহারের অতিরিক্ত কিছুই করা যাবে না। ঘরে খাবার দাবারের প্রাচুর্য থাকা, সত্ত্বেও একেবারে অভুক্ত থেকে একজন অনাহারী দুঃখী লোকের অনুভূতিকে কষ্টকে নিজের সত্তায় ধারনা করার প্রচেষ্টা, এই সবকিছুই পবিত্র মাহে রমজানের শিক্ষা হিসাবে আমরা গ্রহণ করে নেই। এই মাহে রমজানকে তিনটি ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে রোজাদার মুসলমানদের গোনাহ সমূহ থেকে পরিত্রাণ লাভের পন্থা হিসাবে। সর্বোপরি মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র রমজানের রোজাদারদের জন্য নিজে উপহার বন্টন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন। সে হিসাবে পবিত্র ঈদুল ফিতরকে একটি মর্যাদাবান উৎসব, একটি বরকতময় দিন হিসাবে সবাই দেখতে বেশি আগ্রহী এবং সাথে সাথে রাববুল আলামীনের রেজামন্দী হাসিলের একটি পন্থা হিসাবে গ্রহণ করতে চান রজমানুল মোবারক মাসটিকে এবং তৎসঙ্গে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনটিকে। আরবি শব্দ ফিতরাত একটি বহুমাত্রিক অর্থ বহনকারী বিষয়। সাধারণত একজন ব্যক্তি সত্তার নানাবিধ দুঃখবেদনার অনুভূতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য মহান আল্লাহ রমজানুল মোবারকের মতো উপহার মুসলিম উম্মাহর জন্য পাঠিয়েছেন। দীনহীনের কাছে নিজের ব্যক্তি সত্তাটিকে উপস্থাপন করার ক্ষমতা দানের জন্য মহান আল্লাহ রাববুল আলামীন ফিতরা প্রথার প্রবর্তন করেছেন এবং ফিতরা, যাকাত প্রভৃতি আদায়ের জন্য কঠোরভাবে তাগিদ দিয়েছেন। এ সকল আর্থিক ব্যবস্থা গরীব দুঃখীদের জীবনে এনে দেয় এক অনাবিল আনন্দ। এদেরই প্রাণের দোয়ায় ধনবানদের আরও ধনস্ফীতি ঘটে। নিয়মটি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় যে ধনবানের সম্পদের ওপর গরীব দুঃখীদের হক রয়েছে পুরোদস্ত্তর। মানুষ হিসাবে সকলেই যে সমান মর্যাদার, সমান অনুভূতির এবং একই মানসিকতার এই ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করে ফিতরা এবং যাকাত বন্টনের মাধ্যমে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনটি আমরা উদযাপিত করব আনন্দের সাথে। সেই আনন্দটি হতে হবে শালীনতার এবং শিষ্টাচারের গন্ডীর ভিতর। আমরা ঈদগাহ ময়দানে একতাবদ্ধ বিরাট কাতারে সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে ঈদুল ফিতরের ওয়াজিব দু’রাকাত নামাজ আদায় করবো ইমাম সাহেবের সাথে। এই নামাজের ফজিলত যতোটুকু সেই পরিমাণ কলুষমুক্ত মনও আমরা লাভ করতে পারি একই সাথে। সেটি নির্ভর করবে রমজানুল মোবারকের সংযম সাধনার মধ্য দিয়ে। আমরা যদি রমজান মাসটি কাটিয়ে দেই হৈ হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে আবার ঈদুল ফিতরের দিনের আনন্দ উপকরণ সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তাহলে ঈদের দিনটি শুধুমাত্র একটি আনন্দের দিন বা সাদামাটা একটি দিন ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা ঈদুল ফিতরের দিনটিতে সাধ্যমতো নতুন কাপড় চোপড় পরিধান করব। সাধ্যমতো মজাদার খাবার তৈরি করব। পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে যাবো আবার ওনাদেরকেও নিজেদের ঘরে আসার আহবান জানাব। প্রতিটি মুসলমান পুরুষ সদস্য একে অপরের সাথে সহাস্য বদনে সাক্ষাৎ করবে। এমনকি পারস্পরিক আলিঙ্গনের মারফত বিগত দিনগুলির সব কালিমা যেন ধুয়ে মুছে নিয়ে যাওয়া যায় এর ব্যবস্থাও আমরা করে রাখতে পারি রাববুল আলামীনের অশেষ করুণায়। একটি পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা অন্যদের সাথে প্রীতিপূর্ণ আচরণ করবেন আবার কোনটা গ্রহণীয় আর কোনটা বর্জনীয় সেটিও শেখানোর ব্যবস্থাটিও করবেন। আকাশ সংস্কৃতির কারণে আজ যেন সবকিছুই উলট পালট হওয়ার পথে এবং সেটা কখনোই শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়। ভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব, ভিন্নধর্মী পোশাক, ভিন্ন প্রকার আচার আচরণের বলয় থেকে নবপ্রজন্মের সদস্যদের বের করে এনে নিজস্ব জাতীয় ধ্যান ধারণা আর ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে গঠিত জীবন ধারার প্রতি সবাইকে আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নেয়া সকল বয়োজ্যেষ্ঠের কর্তব্য। শুধু ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করলাম যে যার মতো, নেচে গেয়ে বেড়ালাম যার যার পছন্দমতো। দিনটি ভালো যাবে সাথে যাবে আম ছালা দুটোই। সবশেষে সুধী সমাজ-সুধী পাঠকবৃন্দ সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক : অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button