পরিত্যক্ত আমবাগান অথবা মুসলিম নিধনের গল্প…

Africaবিশ্বের এই বিশাল পটভূমিকায় আফ্রিকার দরিদ্র দেশ সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক বা কারের কোনো কৌশলগত গুরুত্ব নেই। গত ১২ মাস ধরেই সেখানে চলছে জাতিগত সহিংসতা। সংঘাতের কারণে দেশের অনেক এলাকা এখন বিরান পড়ে আছে।
আপনি যদি এখন আফ্রিকার এই দেশটিতে যান তাহলে অবাক হবেন। গ্রামগুলোতে সারিবদ্ধ আমগাছ দেখতে পাবেন। অথচ সেগুলোর কোনো মালিক নেই। তারা স্বাধীন অথবা নিঃস্বভাবে পড়ে আছে। বছরের এ সময়ে গাছগুলো ভরে গেছে ছোট ছোট সবুজ আম আর ঘন কচি পাতায়। জুন মাস নাগাদ এগুলো পেকে হলুদ হয়ে যাবে। তখন আঙ্গিনা ভরে উঠবে ঝড়ে পড়া সেসব রসাল ফলে। কিন্তু এগুলো কুড়িয়ে নেয়ার মত কেউ না থাকায় একসময় এগুলোতে পচন ধরবে।
আপনি যদি তখন এ দেশের মহাসড়কগুলোতে ভ্রমণ করেন তখন পচে পাওয়া ফলগুলো দেখতে পাবেন। হয়ত অবাক হয়ে ভাববেন, এসব আমগাছের তলায় যারা বাস করত তারা এখন কোথায়!
এর আগেও আফ্রিকার এই বেল্টটির বিস্তীর্ণ অরণ্য এলাকা সাহেলে নানা আন্দেলন হয়েছে। কারের জাতীয় ভাষায় এগুলোকে বলা হয় কেপেতেনে(বিপদ এড়িয়ে যাওয়া)।
এসব শূণ্য লোকালয় দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম, কি এমন ঘটল যে, এতগুলো মানুষ নতুন বসতির সন্ধানে পুরনো বাসস্থান ছেড়ে গেল? প্রতিবেশীদের সঙ্গে অকস্মাৎ কোনো সংঘর্ষের জের ধরেই কি পরিবারগুলো গ্রাম ছাড়ল! আসলে এটি এমন কোনো সাধারণ অভিবাসনের ঘটনা নয়, যার ফলে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠির লোকজন বংশ পরম্পরায় পাওয়া ঘর বাড়ি, জমি জিরাত আর গবাদি পশুগুলোকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
অথচ এক শতাব্দী আগে এই অঞ্চলের তারাই ছিল শাসনকর্তা। আধা যাযাবর এই উপজাতীটির নাম পেউল। ইংরেজি ভাষাভাষিদের কাছে তারা ‘ফুলানি’ জনগোষ্ঠি নামে পরিচিত ছিল। তারা কারে এসেছিল প্রতিবেশী দেশ নাইজার ও চাদ থেকে। সেন্ট্রাল আফ্রিকায় তারাই ছিল গবাদি পশুর প্রধান সরবরাহকারী।.
পেউল জাতিটি মূলত: ছিল পশুপালক। তাদের অধিকাংশই  মুসলিম। ইসলাম ধর্মে পশুপালনের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স:) একসময় উট চরিয়েছেন। এছাড়া কোরআন শরীফেও পশুর নামে(সুরা বাকারা) একটি সুরা রয়েছে। এই গোষ্ঠির মাধ্যমে আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে মন্থর গতিতে ছড়িয়ে  পড়েছিল ইসলাম ধর্ম যার ধারা বর্তমান সময়েও  অব্যাহত ছিল।
সাধারণত: কৃষক এবং রাখালদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বের সর্বত্র এ দুটি পেশাজীবী নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত হয়। বাইবেলের কেইন থেকে শুরু করে ওকলাহোমা ব্রডওয়ে পর্যন্ত একই অবস্থা দেখা যায়। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে একই ঘটনা দেখা গেছে। এখানেও পরাজিত হয়েছে পশুচারক পেউলরাই।
আজকে যদি আপনি আমগাছের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রাঙা মাটির পথ ধরে হেঁটে যান তবে দেখবেন, তাদের অসংখ্য ঘর-বাড়ি আর মসজিদগুলো এখন শূণ্য পড়ে আছে। গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে একই অবস্থা। কোথাও জনমানুষের চিহ্ণ নেই। এখানকার বাসিন্দারা কোথায় বসবাস করত সেটি কারো না বললেও চলবে। এমনকি এখানকার বাসিন্দারা কোথায় গেছে সেটিও আপনাকে বলে দিতে হবে না। তাদের অধিকাংশকেই হত্যা করা হয়েছে। বাকিরা পালিয়ে গেছে। তারা বধ হয়েছে প্রতিবেশী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের হাতে।
সংখ্যাগুরু খ্রিস্টানরা এখন কার দেশটিকে মুসলমান শূন্য করার মিশনে নেমেছে। তারা এখন প্রতিশোধের নেশায় মত্ত। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মুসলিশ নিধনের এই করুণ কাহিনী সম্পর্কে বর্হিবিশ্ব খুব কমই খবর রাখে। সে দেশের ব্যর্থ রাজনীতিবিদরাও এ ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিবেশী চাদ এতে মদদ দিচ্ছে। তাদের লোভ সেন্ট্রাল আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি।
এটা আংশিকভাবে ঈর্ষারও গল্প। দুটি ধর্মীয় গোষ্টির মধ্যে এক পক্ষ রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী কিন্তু দরিদ্র। এরাই হল সংখ্রাগুরু খ্রিস্টান জনগোষ্ঠি। আর রাজনীতি থেকে দূরে থাকা অপর অংশটি হচ্ছে মুসলিম এবং তারা তাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় কিছুটা ধনী। তারাই হল কারের প্রধান ব্যবসায়ী এবং পশুপালক।
গত কয়েকদিন ধরে আমি দেশের বিভিন্ন সড়ক ধরে ভ্রমণ করেছি। কিন্তু একটাও গরু দেখিনি। সেদিন হঠাৎ করে দেখি, একটা জঙ্গল থেকে কিছু গরু বেরিয়ে আসল। কিন্তু তাদের মালিক পেউল জাতির কেউ নয়, যদিও একসময় তারাই ছিল এগুলোর প্রকৃত মালিক ।
এই গবাদি পশুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছিল একদল তরুণ যাদের দেখলেই ভয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। তাদের হাতে ধরা ছিল, ছুরি, তীর-ধনুক এবং ঘরে নির্মিত রাইফেল। তারা আমাকে বলল,‘আমরা পেউলদের হত্যা করেছি। এখন এ গরুগুলোর মালিক আমরা।’ গরুর পালের পিছন থেকে উকি ঝুঁকি দিচ্ছিল কয়েকজন নারী। নিঃসন্দেহে তারা পেউল গোষ্ঠির। গরুর মতো এসব মেয়েদেরকেও তারা ছিনিয়ে নিয়েছে। এসব যুবকরা বালাকা বিরোধী জঙ্গি দলের একাংশ। আপনি কারের রাস্তায় সর্বত্র এদের দেখা পাবেন। এরা একসময় মহাসড়কে যাত্রীদের মালামাল লুট করতো। এখন দেশের নামে শ্লোগান দিয়ে হত্যাযজ্ঞে ঝাপিয়ে পড়েছে।
দেশটির মুসলিম জনগোষ্ঠিটি হঠাৎ করেই যেন বিদেশি হয়ে গেছে- যদিও বংশ পরস্পরায় এরা এদেশেই বাস করে আসছিল, সেই কবে থেকে। তাদের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ ইতিমধ্যেই চাদ ও ক্যামেরনের সীমান্ত সংলগ্ন শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, এখন তাদের অসংখ্য গবাদিপশুগুলোর কি হবে?
ওআসলে সেন্ট্রাল আফ্রিকায় এখন চলছে মাংসের সঙ্কট। কৃষকদের এখন রাখাল দরকার। কেননা তারা যে গরুগুলোর সঠিক পরিচর্যা করতে পারেনা। এমনকি জবাই করার কাজও জানা নেই তাদের!
চলতি বছরের গোড়ার দিকে কারের বোজুম শহরটিতে হাজার হাজার মুসলিম বসবাস করত। এখন সেখানে মাত্র দু জন মুসলিম বেঁচে আছে বলে বিবিসি’র এই প্রতিনিধিকে জানান হল। এদের একজন পাগল- অন্যজন কসাই। খ্রিস্টানরা তাদের প্রয়োজনেই লাল টুপি আর গাউন পরা এই লম্বা লোকটি মানে কসাইকে শহরে বসবাসের অনুমতি দিয়েছে। কারণ, তারা যে পশু জবাই করতে জানে না!
তার বাড়ির উঠোনে আমগাছটার নিচে দুজন বসলাম। আমরা দুজন ছাড়া সেখানে আর কেউ ছিল না। তারপরও ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল সে। সে এখানে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করে। তারপরও সে শহর ছেড়ে যাবে না। সে বলে,‘ এই ঘর-বাড়ি, বাগান সব আমার।’
আমি তার বাগানের আমগাছগুলোর দিকে তাকালাম। সম্ভবত সে জুন মাস অব্দি এখানেই থাকবে। তখন আমগুলো পেকে টসটসে হয়ে যাবে। সেইসব লাল টকটকে আমের স্বাদ আস্বাদন করারও সুযোগ পাবে সে। আমি তখন ভাবছিলাম, অন্য আমগুলোর কি হবে? হায়, গাছের নিচে পড়ে থাকা অজস্র পাকা আম কুড়ানোর মতো কেউ যে নেই আফ্রিকার এই দেশটিতে!
সূত্র:বিবিসি, ভাষান্তর: মাহমুদা আকতার

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button