রোহিঙ্গাদের দুর্দিনে পাশে নেই কোনো মুসলিম দেশ

Rohingaমিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যের মৌংদো শহরের কাছে গণহারে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায় জানুয়ারির মাঝামাঝি। দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে খবরটি। কিছুদিন পর মিয়ানমার সরকার প্রকাশ করে ঘটনার একেবারে ভিন্ন একটি বিবরণ। বলা হয়, ঐ ঘটনায় কেউ মারা যায়নি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার গোষ্ঠী ও ফার্টিফাই রাইটস-এর মতো কিছু এনজিও পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী পরবর্তীতে যে রিপোর্ট দেয় তাতে মিয়ানমারে মুসলিম গণসংহারের খবরের সত্যতা স্বীকার করা হয়। বলা হয়, বহু রোহিঙ্গা মুসলিম ঐ দাঙ্গায় প্রাণ হারান এবং মুসলিম হত্যা বন্ধে স্থানীয় পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এমএসএফ (মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ারস) তাদের সংকলিত তথ্যসহ বিবরণে জানায়, দাঙ্গাপীড়িত ‘দুচী ইয়ার তান’ গ্রামের বহু আহত ব্যক্তির তারা চিকিৎসা করেন। এরপরও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হামলার যাবতীয় খবর সরকার অস্বীকার করে এবং এমএসএফ-কে দেশ থেকে বের করে দেয়। পরবর্তীতে মিয়ানমারে প্রবেশের এমএসএফ-কে অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বলে দেয়া হয়, এমএসএফ তার কাজকর্ম বহাল রাখতে পারবে শুধু রাখাইন রাজ্যে। রাজ্যের বাইরে কোথাও নয়।
রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হামলার ও তাদের হত্যার ঘটনার অবশেষে মার্চে যে তদন্ত রিপোর্ট মিয়ানমার সরকার প্রকাশ করে, বাস্তব চিত্র তাতে উদঘাটিত হবেÑ সত্যান্বেষীদের এই প্রত্যাশা তা পূরণ করেনি। দাঙ্গায় কোনো মুসলিম নিহত হয়নি এই তদন্ত রিপোর্টেও সরকারের আগের দাবিটিই পুনর্ব্যক্ত হয়। প্রসঙ্গত স্মরণে আসে তামিল হত্যা পরবর্তীতে শ্রীলংকা সরকারের গড়া তদন্ত কমিশন ও তাদের পরিবেশিত রিপোর্টের বিষয়টি। শ্রীলংকা সরকার অবলম্বিত অবস্থান আলোচ্য সর্বশেষ তদন্ত রিপোর্টেও যথাপূর্ব বহাল রাখা হয়। সিংহলীদের নির্দোষিতা প্রমাণে তৎপর শ্রীলংকা সরকারের মতো মিয়ানমার সরকারকে তাদের তৈরি তদন্ত রিপোর্টে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংস অমুসলিম বর্মীদের সাফাই গাইতে শোনা যায়।
মিয়ানমার সরকারের তদন্ত রিপোর্টটি অন লাইনে প্রকাশ করা হয়নি। কিছু এনজিও-কে সরবরাহ করা হয় সেটি। দেখা যায় অতি ধূর্ত সরকারি তদন্ত কর্তারা উন্মত্ত জনগণের হামলায় এক রাখাইন পুলিশের মৃত্যুর ঘটনার সত্যতা রোহিঙ্গা মুসলিমদের মুখ থেকে আদায় করে নিয়েছেন কিন্তু বর্মী জনতার বেপরোয়া সহিংসতায় অসংখ্য রোহিঙ্গা মুসলমানের নিহত হওয়ার ঘটনার কোনো স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তারা মুসলমানদের কোনো প্রশ্নই করেননি। এক কথায় বলা যায় বাস্তবতা উদঘাটনের নামে মিয়ানমার সরকারের তদন্ত রিপোর্টে সত্য ছিনতাইয়ের জন্য যে তথ্য প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে, তা নজিরবিহীন। রিপোর্টে দাবি করা হয়, এনজিওগুলো মিয়ানমারের ঘটনার প্রকৃত বিবরণ সংগ্রহের চেষ্টা বাদ দিয়ে সরকারকে মুসলিম বিদ্বেষী ঠাওরানোর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চেষ্টা চালিয়ে গেছে এবং একই উদ্দেশ্যে ঘটনার বিবরণ সংগ্রহে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। এনজিওগুলো কোন লাভ-ক্ষতির তাড়নায় সরকার বিদ্বেষী অবস্থান নিলোÑ তা কিন্তু রিপোর্টে ব্যাখ্যা করা হয়নি। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন যে, বর্মীদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর সংগ্রহে এনজিওদের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যেই মিয়ানমার সরকার তদন্ত রিপোর্ট প্রণয়নে এই তথ্যও যুক্তি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে ‘দুচী ইয়ার তান’ গ্রামের ঘটনার বিবরণ তৈরিতে অবলম্বিত বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতার পর্যবেক্ষকেরা উল্লেখ করলেও মিয়ানমার সরকার তাতে বিচলিত নয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে একটি তামার খনির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একদল প্রতিবাদরত মানুষের গায়ে সাদা ফসফরাস ছিটিয়ে তাদের পুলিশ কর্তৃক মেরে ফেলার ঘটনারও তদন্ত শেষে সরকার দোষীদের শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে দ-মুক্তি দিয়েছিল।
অতি সসম্প্রতি ফাঁস হওয়া সরকারি গোপন নথিপত্র বিশ্লেষণে ‘ফর্টিফাই রাইটস’ উদঘাটন করে যে মুসলিম বর্জিত রাখাইন রাজ্য তথা মিয়ানমার গড়ার একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার আওতায় দেশে রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যায় ও বিতাড়নে নেমেছে সরকার। সরকার যথারীতি তার উন্মত্ত প্রতিক্রিয়ায় বলেছে ফর্টিফাই রাইটসের মতো কোনো সংস্থা কিছু প্রকাশ করলেই সরকার সেটিকে সত্য বলে মেনে নেবে না। সরকারের ভাষায়Ñ এই সংস্থা হচ্ছে মিয়ানমারে বহিরাগত বাঙালিদের পক্ষ সমর্থক।
মিয়ানমার সরকারের ভাষায়Ñ রোহিঙ্গা মুসলমানরা হচ্ছেন বর্মায় অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী বাঙালি। ইতিহাস সাক্ষী বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ঐ বাঙালিদের বর্মায় নিয়ে আসে তাদের অতীত শাসনামলে। তখন থেকে বাংলাদেশীরা বর্মা বা মিয়ানমারের বাসিন্দা। তাছাড়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমারে আবাদ হওয়ার আরো কয়েকশ’ বছরের পুরনো ইতিহাস সম্বন্ধে ইতিহাস পাঠক মাত্রই অবহিত রয়েছেন।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থা দিন দিন দুর্বিষহ হতে দেখা যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সরেজমিন সম্পর্ক ও অন্যান্য যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খবরের যথার্থতা যাচাই অসম্ভব থাকছে না। নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে দেড়শ’ রোহিঙ্গাকে ইতিমধ্যে তারা মরতে দেখেছেন। ২০ মহিলার মৃত্যু হয়েছে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। অর্থাৎ জীবন রক্ষার জরুরি প্রয়োজন মুহূর্তেও কোনো সেবা-উপচার লাভের সুযোগ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সামনে সেখানকার সরকার উপস্থিত থাকতে দিচ্ছে না।
কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে রোহিঙ্গাদের এতো দুর্দিনেও তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে কোনো মুসলিম দেশকে এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা সঙ্কটে উদ্বেগ প্রকাশে এ পর্যন্ত একটি মাত্র দেশকে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে। সেটি  হচ্ছে তুরস্ক। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের সমালোচনায় তাদের কণ্ঠস্বরেও কোনো জোর বা আন্তরিকতা অনুপস্থিত দেখা গেছে।  রোহিঙ্গা মুসলমানদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিপন্ন হতে না দেখা পর্যন্ত পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন কোনো মুসলিম দেশ কি তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না? রোহিঙ্গা সঙ্কটে আসিয়ানের কোনো বিচলিত তৎপরতা এ পর্যন্ত দেখা যায়নি। -আল-জাজিরা

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button