ডেনমার্কের শাস্তিমূলক বর্ণবাদী অভিবাসন ব্যবস্থা যুক্তরাজ্যের জন্য কোন মডেল নয়
যুক্তরাজ্যে এসাইলাম অর্থাৎ আশ্রয় প্রার্থীদের হোটেলের সামনে মাসের পর মাস ধরে সহিংস অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভের পর, গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ তার এসাইলাম সংস্কার ঘোষণা করেন। তিনি স্বীকার করেন যে ডেনমার্কের শরণার্থী নীতিমালা থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
কেনো ডেনমার্ক:
ডেনমার্কের একটি বৈশ্বিক পরিচয় রয়েছে একটি সমাজতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, সমতাভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে, যা মধ্য-বামপন্থী উদারপন্থীদের কাছ থেকে প্রশংসা পায়। একই সঙ্গে দেশটিতে বিশ্বের ধনী উত্তর গোলার্ধের অন্যতম কঠোর ও প্রকাশ্য বর্ণবাদী অভিবাসন ও সীমান্ত নীতি বিদ্যমান—যা আবার ডানপন্থী জাতীয়তাবাদীদের মন জয় করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমন বৈপরীত্য কীভাবে সম্ভব?
ডেনিশ কল্যাণ রাষ্ট্র নিয়ে আমার গবেষণা দেখেছি একটি দীর্ঘ, ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা জাতিগত স্তরবিন্যাসের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা স্পষ্টভাবে “অ-ইউরোপীয়/অ-পশ্চিমা” অভিবাসন ও আশ্রয়কে নির্মূল করার লক্ষ্যে কাজ করে এবং ইউরোপের সবচেয়ে কঠিন নাগরিকত্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ-পশ্চিমাদের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর সীমিত করে।
জাতীয়তাবাদী বাগ্মিতা:
গ্লোবাল সাউথ থেকে ডেনমার্কে অভিবাসন শুরু হয় ষাট- সত্তরের দশকের “গেস্ট ওয়ার্কার” বা অতিথিশ্রমিক কর্মসূচির মাধ্যমে।
১৯৭৩ সালে আর্থিক সংকটের আশঙ্কায় ডেনমার্ক এই পথ বন্ধ করে দেয়, আশা করেছিল অভিবাসীরা ফিরে যাবে। কিন্তু তারা ফিরে যায়নি বরং বড় শহরগুলোতে তারা স্থায়ী সম্প্রদায় গড়ে তোলে।
১৯৮০ ও ৯০ দশকে যে শরণার্থীরা এলেন, তারা এমন একটি শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেন যেখানে অদক্ষ শ্রমের সুযোগ দ্রুত কমছিল, ফলে তাঁদের সামনে কর্মসংস্থানের খুব কম পথ খোলা ছিল।
প্রান্তিক শ্রমিক ও নবাগত শরণার্থীদের জন্য সামাজিক গতিশীলতার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। তারা বড় বড় শহরের জনবসতিপূর্ণ সরকারি আবাসন এলাকায় ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯৯০-এর দশকে সোমালিয়া, লেবানন, বসনিয়া ও ইরাকের গৃহযুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা প্রদানের মনোভাব বদলে যায়। মুসলিম অভিবাসীদের “একীভূত হতে অক্ষম” এবং তথাকথিত “হাউজিং গেটো”-র সাথে যুক্ত করে দেখা শুরু হয়।
গত ২৫ বছরে এই রাজনৈতিক বক্তব্য আইন ও নীতিতে রূপ নেয় জাতীয়তাবাদী সুরে সমাজনীতি পুনর্গঠনের মাধ্যমে। এভাবে ডেনিশ কল্যাণ রাষ্ট্রের সার্বজনীনতা ক্ষয়ে যেতে থাকে, কল্যাণকে “আমাদের” জন্য এবং “ওদের” জন্য নয়, এমনভাবে নির্মিত হয়। এতে মুসলিম-প্রধান দেশ থেকে আগত গ্লোবাল সাউথ অভিবাসন নিয়ে জাতিগত আতঙ্ককে উসকে দেওয়া হয়।
জাতীয় পরিসংখ্যানে পশ্চিমা ও অ-পশ্চিমা বাসিন্দাদের আলাদা শ্রেণীভুক্ত করে ডেনমার্ক তাদের রাজনৈতিক বচনে বর্ণবাদী যুক্তিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। এভাবে একসময়ের অন্তর্ভুক্তিমূলক কল্যাণনীতি কঠোর, বর্জনমূলক অভিবাসন নীতিতে রূপ নেয় এবং এই রূপান্তর ডান-বাম সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় ঘটে।
গেটো নীতি:
বহু বছর ধরেই ডেনমার্ক সামাজিক সেবা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও স্থানীয় রাজনীতিতে বর্ণবাদী অভিবাসন ও আশ্রয় নীতি প্রণয়ন করে চলেছে।
২০১৮ সালের “গেটো নীতি” ছিল এই ধারার অংশ, যেখানে অ-পশ্চিমা বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি আবাসন ধ্বংস করার লক্ষ্য নেওয়া হয়। নাগরিকত্ব পেতে কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়। আর অপরাধবিষয়ক নীতিতে সুযোগ পেলেই বহিষ্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
২০১৯ সালে সমাজতান্ত্রিক সরকার আশ্রয় নীতির সংস্কার আনে—যেখানে শরণার্থীদের একীভূতকরণের বদলে পুনর্বাসন বা ফেরত পাঠানোকে লক্ষ্য করা হয়। এর আগে ডেনমার্ক প্রত্যাখ্যাত আবেদনকারীদের জন্য এমন সব ডিপোর্টেশন সেন্টার বা বিতাড়ন কেন্দ্র নির্মাণ করে, যা পুরনো কারাগার বা সামরিক ঘাঁটি থেকে রূপান্তরিত। এগুলো পুলিশের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়, যেখানে কারফিউসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
কোনো শরণার্থী কয়েকবার কারফিউ ভাঙলে তাকে চার মাস পর্যন্ত জেল দেওয়া হতে পারে—এটি কোনো অপরাধ না করেও তাকে অপরাধী বানিয়ে ফেলে। এতে শরণার্থীদের জন্য আলাদা এক বৈষম্যমূলক ফৌজদারি আইন তৈরি হয়েছে। এগুলো বাস্তবে আশ্রয়কেন্দ্র নয়—কারাগারসদৃশ প্রতিষ্ঠান।
২০১৯ সালের পরিবর্তনের আরেকটি অংশ ছিল শরণার্থী মর্যাদার মেয়াদ কমিয়ে দুই বছর করা—এরপর তাদের অবস্থার পুনর্মূল্যায়ন হয়।
২০২১ সালে ডেনমার্ক প্রথম দেশ হিসেবে সিরীয় শরণার্থীদের মর্যাদা বাতিল করে, বিশেষত নারীদের ও প্রবীণদের ক্ষেত্রে—দাবি করে যে তাদের দেশে ফিরে যাওয়া নিরাপদ।
যদিও বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত আদালত খারিজ করে দেয়, কিন্তু ভয়, অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তীব্রভাবে বেড়ে যায়।
২০১৯ সালের পর ভাতা কমানোর ফলে শরণার্থী পরিবারগুলো দারিদ্র্যের মুখে পড়ে। ডেনমার্ক নিজেকে সমানাধিকারের দেশ বলে দাবি করলেও তাদের অভিবাসন নীতি একধরনের জাতিগত আধিপত্যবাদী যুক্তির ওপর পরিচালিত—যেখানে “পশ্চিমা” ও “অ-পশ্চিমা” শরণার্থীদের ভিন্নভাবে দেখা হয়। ২০২৫ সালে নতুন নিয়ম যুক্ত করা হয়, যে কেউ সেদেশে ৯ বছরের কম থাকলে এবং আড়াই বছর কাজ না করলে তাকে ভাতা পেতে হলে কাজ করতে হবে। এটি একটি বর্ণবাদী মজুরিভিত্তিক কাজের পরিবর্তে বেনিফিটভিত্তিক শ্রমব্যবস্থার জন্ম দিচ্ছে, যা সরাসরি অ-পশ্চিমা অভিবাসীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, পূর্বে বহু শরণার্থী এমন আবাসিক এলাকায় থাকতেন যেখানে পারস্পরিক সহায়তা ও সামাজিক সংযোগ গড়ে ওঠে, যা তাদের স্থায়িত্ব ও মানসিক নিরাপত্তা তৈরি করত। কিন্তু এখন সরকার তাদের এসব সম্প্রদায় থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, দাবি করছে, এতে “সাদা ডেনিশ সংস্কৃতিতে” তাদের একীভূত হওয়া সহজ হবে এবং তারা “সমান্তরাল সমাজ” তৈরি করতে পারবে না। ফলে তারা আরও বিচ্ছিন্ন, রাজনৈতিকভাবে নিন্দিত এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভীত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
বর্ণবাদী নীতির অনুসরণ:
ডেনমার্ক নিজেকে এক প্রগতিশীল ও সমানাধিকারের দেশ হিসেবে তুলে ধরে কিন্তু বাস্তবে তাদের অভিবাসন নীতি নির্ধারণ করে কে “গ্রহণযোগ্য” এবং কে “অগ্রহণযোগ্য”।
এর সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, ইউক্রেনীয় শরণার্থী একটি আলাদা আইনের অধীনে কোনো কঠোরতা ছাড়াই তাৎক্ষণিক বাসস্থান, কাজ ও স্কুলে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। কিন্তু এই সুযোগ প্রদান গ্লোবাল সাউথের শরণার্থীদের ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে অস্বীকার করা হয়।
ডেনমার্কের নীতি শরণার্থীদের প্রান্তিকতা বাড়িয়েছে, তাদের অপরাধী বানিয়েছে এবং বেনিফিট পাওয়ার পথ রুদ্ধ করেছে।
ডেনমার্কে শিশুরাসহ শরণার্থীরা এক অনিশ্চিত, অস্থায়ী জীবনে বসবাস করছে, যেখানে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পিত।
এই নীতি শুধু শরণার্থীদের নয়, বর্ণিত যে কোনো সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব ফেলছে। স্বাস্থ্য, হাউজিং ও স্কুলিঙয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি এবং বাসস্থান, শিক্ষা ও কল্যাণ সুবিধায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও পুলিশি নজরদারির মাধ্যমে তাদের টার্গেট করা হচ্ছে।
ডেনমার্কের বর্ণবাদী অভিবাসন নীতি ইউরোপের বিস্তৃত ইসলামোফোবিয়া ও বর্ণবাদের প্রতিফলন। ইউরোপের মূলধারার দলগুলো এখন ডানপন্থী ভোটের জন্য এমন নীতি গ্রহণ করছে। যুক্তরাজ্যের লেবার সরকারও একই পথে হাঁটছে।
তবে লক্ষণীয়, যুক্তরাজ্য ডেনমার্কের বিনামূল্যের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, সুলভ সরকারি আবাসন ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা এসব কল্যাণমূলক ব্যবস্থা অনুসরণ করতে চায় না। তারা অনুকরণ করছে ডেনমার্কের মানবিকতাকে শূন্য করে দেওয়া অমানবিক, বর্ণবাদী অভিবাসন আইন।
ডেনমার্ক, যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি ডেনমার্ক ও ইউরোপের বাকি দেশগুলো এমন বর্ণবাদী নীতি অনুসরণ করছে যা বিশেষভাবে মুসলিম ও অভিবাসীদের মানবিক মর্যাদা অস্বীকার করে এবং ভবিষ্যতে এই নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আরও কঠিন হয়ে উঠছে। -আমানি হাসানি, ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের Lecturer। তিনি শহুরে নৃবিজ্ঞানী হিসেবে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলিম ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র হলো বর্ণায়ন, ইসলামোফোবিয়া এবং ডেনমার্কের কল্যাণ ও সামাজিক নীতি।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



