শেকড় সন্ধানী গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল আর নেই

Kamalসিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্যের শেকড়সন্ধানী ধ্যানী গবেষক, কিংবদন্তীতুল্য রম্য লেখক সৈয়দ মোস্তফা কামাল (জন্ম ২৫ জানুয়ারি ১৯৪৩) আর নেই।  শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টায় নগরীর উপশহরস্থ নিজ বাসভবনে সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই কৃতী লেখক ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে…. রাজেউন)। তার মৃত্যুতে সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। গভীর রাত অবধি তার বাসভবনে ভীড় করেন লেখক-কবি, সাংবাদিক ও তার আত্মীয়-স্বজনরামৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে গেছেন। শনিবার বাদ জোহর দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.) মাজার মসজিদে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। পরে দরগাহ সংলগ্ন গোরস্তানে তার লাশ দাফন করা হবে।
সৈয়দ মোস্তফা কামাল বেশ কিছুদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। গত ২২ অক্টোবর তিনি অসুস্থতা বোধ করলে তাকে ভর্তি করা হয় নগরীর ইবনে সিনা হাসপাতালে। সেখানে কিছুদিন তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এরপর তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে তার উপশহরস্থ বাসভবন মোস্তফা মঞ্জিলে (বাসা নং-৫১, রোড নং-২, ব্লক-এফ) চিকিৎসা দেয়া হয়। সেখানে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুকালে তার এক ছেলে ও এক মেয়ে তার পাশে ছিলেন।
১৯৬৫ সালে প্রকাশিত ‘রঙের বিবি’ ও ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত ‘নবরঙ্গ’ রম্য গল্পগ্রন্থ দিয়ে সিলেটের সাহিত্যাঙ্গনে তার যে বর্ণাঢ্য যাত্রা শুরু হয়েছিল আজীবন সাহিত্য সাধনার ক্যানভাসে সফল বিচরণের পর গতকাল রাতে তার অবসান হলো। তিনি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের কেমুসাস সাহিত্য পুরষ্কার, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরষ্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরষ্কার অর্জন করেন। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের সর্বস্তরের লেখক-সাহিত্যিকদের উদ্যোগে সিলেটে তাকে বিশাল গণসংর্বধনা দেয়া হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী: লেখক-গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ১৯৪৩ সালের ২৫ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের মসাজানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সৈয়দ মছদ্দর আলী, মাতা সৈয়দা খোদেজা খাতুন। তিনি সিলেট ও তরপ বিজয়ী সৈয়দ নাসির উদ্দীন সিপাহসালার‘র অধ:স্থন বংশধর। তিনি ১৯৬৩ সালে সিলেটের রসময় উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৫ সালে তিনি সিলেট এম সি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (আইএ) পাশ করেন। তিনি ছাত্রলীগ থেকে ৬৫-৬৬ মেয়াদের জন্য সিলেট এম সি কলেজ ছাত্র সংসদের জি,এস নির্বাচিত হন। একই বছর(১৯৬৫ সালে) তার প্রথম রম্যরচনা রঙের বিবি প্রকাশিত হয়। ১৯৬৬ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান বিরোধী গণ আন্দোলনে যুক্ত হন। ৮ আগস্ট সিলেট সার্কিট হাউজে মার্চ পাষ্টে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে গার্ড অব অনার প্রদান অবস্থায় কিন ব্রীজের উপর থেকে জন-ঘৃণার প্রতীকস্বরূপ তার প্রতি সৈয়দ মোস্তফা কামাল জুতা নিক্ষেপ করেন। এ ঘটনার পর আইয়ুব সরকারের রোষানলে পড়ে তাকে দীর্ঘদিন ফেরারি জীবন কাটাতে হয়। ফলে লেখাপড়ায় সাময়িক বিরতী আসে। একই বছরের ফেব্রুয়ারীতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার রাজারবাজার হাইস্কুলে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনে যুক্ত হন এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মরহুম কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর নির্বাচনী প্রচারণায় ভূমিকা রাখেন।
১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর পুনরায় স্কুল চালু হলে পুরোদমে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে তার প্রথম পুঁথিকাব্য রিলিফ বন্টন রচনা ও প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় নাটক গ্রন্থ তরপ বিজয় রচনা ও প্রকাশ করেন।
১৯৮২ সালের ৪ঠা জানুয়ারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’র সিলেট সংস্কৃতিক কেন্দ্রে ডেপুটেশনে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ৯ মে ১৯৯৫-এ তিনি চাকুরী থেকে অবসর নেন। ১৯৮৪ সালে তিনি সৌদী আরব সফর করেন এবং হজ্জ ও ওমরা আদায় করেন।
১৯৮৮ সালে ‘ঐতিহ্যের সোনালী অধ্যায় : সিলেটের লোক সাহিত্য প্রসংগ’ নামক গবেষণা গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট এ্যাওয়ার্ড লন্ডন সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করেন। একই বছরের ১৬ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার ক্যামব্রীজ ইংল্যান্ড’র ওয়ার্ল্ড এ্যওয়ার্ড ডিকশনারীতে তার জীবনী অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯৯০ সালের ২২ নভেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় কলেজে অধ্যয়নরত প্রথম পুত্র সৈয়দ মোস্তফা মন্জূর ইন্তেকাল করেন। ছেলের মৃত্যুর পর তিনি মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়েন। ১৯৯২ সালে নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত বাংলা একাডেমী প্রকাশিত মরমী কবি শিতালং শাহ (র.) গ্রন্থে তাঁর দুটি প্রবন্ধ অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৯৯৫ সালে সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দীন উদ্দীন রহ. হিফজুল কুরআন মাদরাসা, বগাডুপি, চুনারুঘাট, হবিগঞ্জ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে কর্মবীর আমীনুর রশীদ চৌধুরী’র জীবনী গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। একই বছর. বিএনএসএ (লন্ডন) এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন এবং দি আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইন্সটিটিউট রির্সাচ এসোসিয়েশন নর্থ ক্যালোরিনা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ম্যন অব দ্যা ডিকেট হিসেবে সনদ লাভ করেন।
১৯৯৮ সালে ‘সিলেটের মরমী সাহিত্য’ নামক গবেষণা গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশ করেন। একই বছর জননেতা দেওয়ান ফরিদ গাজী জীবনীগ্রন্থ যৌথভাবে সম্পাদনা করেন এবং বাংলা একাডেমী প্রকাশিত লেখক অভিধানের ২১৫ পৃ. জীবনী অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৯৯৯ সালে তিনি দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ও শাহেদ আলী (রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার-১৯৯৮ খৃ.) স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। গ্রেট বৃটেন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন-লন্ডন, সেঞ্চুরী এ্যওয়ার্ড লাভ করেন।
২০০২ সালে তিনি ‘দানবীর রাগীব আলী’ (মাটি ও মানুষের মিলন মেলায়) গ্রন্থ যৌথভাবে সম্পাদনা করেন এবং একই বছর তিনি রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। সৈয়দ মোস্তফা কামালের এ যাবত রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থেও সংখ্যা ৬৩ টি। এর মধ্যে .গবেষণা ২২ টি, নবী জীবনী ২ টি, জীবনী ১ টি, নাটক ২ টি, রম্য-রচনা ২ টি, পুঁতিকাব্য ৩ টি, আত্নজৈবনিক ২টি এবং বিবিধ ৮ টি এবং সম্পাদনা ২৩ টি।পুরস্কার, সম্মাননা, সংবর্ধনা ও স্বীকৃতি ৩৮ টি। তাকে উৎসর্গিত গ্রন্থ ১৫ টি। তিনি জালালাবাদ লোক সাহিত্য পরিষদ এর সভাপতি (২০০৭ থেকে), সিলেট লেখক ক্লাব এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৯৪ খৃ.থেকে), কবি আফজাল চৌধুরী ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (২০০৪ খৃ. থেকে) এবং সিলেট সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সভাপতি (২০০৭ থেকে) ছিলেন। এছাড়াও তিনি জালালাবাদ লেখক ফোরামের উপদেষ্টাসহ বহু শিক্ষা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার উপদেষ্টা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন সময় সিলেটের সাহিত্য সংস্কৃতির সুতিকাগার কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের কার্যকরী পরিষদের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button