ইউরেনিয়ামের খনি ব্রহ্মপুত্র নদ

ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে আহরণযোগ্য ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও এর বালিতে কয়েক প্রকার ভারী খনিজ ও রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতিও রয়েছে। মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য এসব খনিজ পদার্থের পরিমাণ শতকরা ৯ ভাগ হওয়ায় তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আহরণযোগ্য। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের (জিএসবি) একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে ব্রহ্মপুত্র নদকে মহামূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থ ইউরেনিয়ামের খনি হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশের বেশ কিছু জায়গায় আহরণযোগ্য ইউরেনিয়াম রয়েছে। বাংলাদেশের মাটিতে খনিজ পদার্থ ইউরেনিয়ামের সন্ধানে দীর্ঘদিন ধরে জরিপ চালায় বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি)। এ উপলক্ষে বৃহত্তর তিন নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীবাহিত বালুতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আহরণযোগ্য ইউরেনিয়াম পাওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা হয়। বাংলা মেইল।
গত দুই দশক ধরেই নানা আলোচনায় বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মাটিতে ইউরেনিয়াম পাওয়া সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নতুন করে খনিজ পদার্থ অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কিত নিবিড় জরিপ ও অনুসন্ধানের জন্য জিএসবিকে দায়িত্ব দেয়। একটি বিশেষ প্রকল্পের অধীনে চলছে জরিপ ও অনুসন্ধানের কাজ। জিএসবি এর আগে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার গারো পাহাড়ের আশেপাশের এলাকায় ইউরেনিয়ামের সন্ধান পায়। তবে তা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আহরণযোগ্য ছিল না। ১৯৮৯ সালে উল্লেখিত নদীগুলোর উজান থেকে বয়ে আনা বালুতে গুরুত্বপূর্ণ ভারী খনিজ ও রাসায়নিকের সন্ধান পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে সরকার কার্বন মাইনিং বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্রহ্মপুত্র, যমুনার প্রায় চার হাজার হেক্টর চরাঞ্চল অনুসন্ধান জরিপের জন্য নির্দেশ দেয়।
এর সূত্র ধরে জিএসবি পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের বালুর রাসায়নিক ও খনিজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য একটি বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয়। এর অধীনে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার অন্তত ১০টি স্থানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ২০ মিটার গভীরতা থেকে বালির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। যা দেশে ও বিদেশের গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করা হয়।
ফলাফলে দেখা গেছে, ওই নদীগুলোর বালিতে আহরণযোগ্য ভারী খনিজ ও রাসায়নিকের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের জন্য যেখানে ৭ শতাংশই যথেষ্ট। প্রতি এক টন বালুতে এক গ্রাম ইউরেনিয়াম পাওয়া গেলে তা বাণিজ্যিকভাবে আহরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সীমান্ত সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকায় মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য খনিজ পদার্থ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। সেখানে সবচেয়ে দামী খনিজ প্লাটিনাম রয়েছে বলেও শোনা গেছে। তবে সরাসরি নয়, এ ইউরেনিয়াম বাণিজ্যিকভাবে আহরণের পর বিশ্ববাজারে বিক্রি করা যাবে।
জিএসবির মহাপরিচালক সিরাজুর রহমান খান বলেছেন, ‘কার্বন মাইনিং অনুসন্ধান এবং জিএসবির বিশেষ কার্যক্রমের ফলাফল প্রায় একই রকম ইতিবাচক ও উৎসাহব্যঞ্জক। অতি শিগগিরই এ বিষয়ে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হচ্ছে।’ সরকারি সূত্রগুলো জানায়, জিএসবি যে প্রকল্পটি তৈরি করছে, তার অধীনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী খনিজ ও রাসায়নিকের বিস্তৃতি, আহরণযোগ্য পরিমাণ, আহরণের পদ্ধতি বিষয়ে জরিপ ও অনুসন্ধান চালানো হবে। এ প্রকল্পের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, নৌপরিবহনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগও সম্পৃক্ত থাকবে।
সূত্রমতে, ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে রাসায়নিক বিশ্লেষণে যেসব মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য পদার্থ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে রয়েছে টাইটেনিয়াম, বেরিয়াম, জিরকন, স্ট্রনটিয়াম, রুবিডিয়াম, ক্রোমিয়াম, ট্যান্টালাম, নিকেল, নিওবিয়াম, রুথেনিয়াম, ইন্ডিয়াম ও অসমিয়াম। বিভিন্ন শিল্পে এসব মৌলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। প্রাপ্ত ভারী খনিজসমূহের মধ্যে ইলমেনাইট ব্যবহƒত হয় ছাপাখানা, কাগজকল, রাবার ও সিনথেটিক শিল্প, ওষুধশিল্প ও ইলেকট্রনিক শিল্পে। মোনাজাইট ব্যবহƒত হয় নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কোয়ার্টজ ব্যবহƒত হয় কাঁচশিল্পে। এছাড়া নিওকোক্সেন, জিরকন, গারনেট, গোয়েথাইট, মিকা, সিলিমেনাইট, কায়ানাইট গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহƒত হয়।
ইউরেনিয়াম মহামূল্যবান একটি খনিজ পদার্থ। পারমাণবিক গবেষণা, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অত্যাধুনিক সামরিক শিল্পে এটি একটি অপরিহার্য উপাদান। এছাড়া যেসব গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ ও ভারী খনিজের সন্ধান পাওয়া গেছে, বিশ্ববাজারে সেগুলোর দাম এবং চাহিদাও প্রচুর। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং জিএসবির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের বালিতে মূল্যবান খনিজ পদার্থ ইউরেনিয়ামের সন্ধান পাওয়ার খবরে দেশের ব্যাপক সম্ভাবনার বিষয়ে নতুন করে আশা জেগেছে। কোনো দেশে ইউরেনিয়াম বা প্লাটিনামের খনি পাওয়ার ঘটনা অনেকটা হীরা বা সোনার খনি পাওয়ার মতোই ঘটনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সন্ধান পাওয়া ইউরেনিয়াম আহরণ করে পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা যেতে পারে। এটা সম্ভব হলে রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্টের জ্বালানির জন্য বিদেশীদের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে জ্বালানি রড কিনতে হবে না। বিদ্যুতের মূল্য দীর্ঘমেয়াদী পর্যায়ে সাশ্রয়ী রাখা যাবে।
সূত্রমতে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় জিরকনসহ ইউরেনিয়ামের প্রাথমিক সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৮৮ সালে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলীয় কোম্পানিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দায়িত্ব দেয়। তবে কয়েক বছর পর কোম্পানিটি চলে যায়। উল্লেখ্য, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি প্রবাহে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। বর্ষাকালে উজান থেকে নদীবাহিত বালি এসে মজুদ হয়ে থাকে। কাঁচবালু হিসেবে খ্যাত ব্রহ্মপুত্র নদের এসব বালি অবৈধভাবে উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এক সময় রাজস্ব বিভাগ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের বালিমহাল ইজারা দেয়া হতো। পরবর্তী সময়ে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত হয় দেশের বৃহত্তম ব্রহ্মপুত্র নদের বিস্তীর্ণ বালি মহাল। নির্মাণ কাজে যথেচ্ছভাবে এ বালি ব্যবহার করে দেশের মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button