বাংলাদেশের পোষাক শিল্পে অশনি সংকেত

অধ্যাপক ওমর ফারুক
জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সের (জিএসপি) আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তবে এর মধ্যে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক নেই। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্রীড়া সরঞ্জাম, তামাক, প্লাস্টিক পণ্য ও সিরামিক পণ্য এ সুবিধার আওতায় রপ্তানি করে থাকে। গত অর্থবছরে জিএসপির আওতায় ৩ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের এ ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হয়েছে। এতে তারা শুল্ক ছাড় পেয়েছেন ২০ লাখ ডলারের মতো। অন্যদিকে ৪৯০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা শুল্ক বাবদ ৭৩ কোটি ডলার দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। উল্লেখ্য, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১১Ñ১২ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ (৫০০ কোটি ডলার)। তবে এর মধ্যে এক শতাংশ পণ্যের জিএসপি সুবিধা পাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার (জিএসপি) স্থগিত করা হয়েছে এমন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পোশাক শিল্পের শূন্যতা দখলে তৎপর হয়ে উঠেছেন ভারতীয় গার্মেন্টস মালিকরা। এরই মধ্যে তারা অতিরিক্ত একশ’কোটি ডলারের অর্ডার পেতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। গত ২৭ শে জুন ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের শূন্যতা পূরণে বাজার দখলের বিষয়ে আশাবাদী ভারতীয়রা।
গত বছরের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে অগ্নিকান্ডে শতাধিক এবং চলতি বছেরের এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক প্রাণ হারান। এ দুটি ঘটনার সূত্র ধরেই বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নেই উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। একই ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও (ইইউ)। উক্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পোশাকের শূন্যতা তৈরি হওয়ার ফলে ক্রেতারা এখন নতুন উৎসের সন্ধান করছেন। এরই মধ্যে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড ওয়াল্ট ডিজনি বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করেছে। যা ভারতের সামনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের মেলে ধরবার সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত কয়েক বছর ধরে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ক্রেতারা সস্তা শ্রমের জন্য বাংলাদেশে গেছে। যা দেশটিকে এই শিল্পে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। এখন সুপার মার্কেট চেইনসহ শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোও নিরাপত্তা ও শ্রমমান ইস্যুসহ রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বাংলাদেশকে বর্জন করতে চাইছে। এক্ষেত্রে তারা ভারতসহ অন্যান্য দেশগুলোকেই পছন্দ করছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জিএসপি সুবিধা স্থগিত করনের খবরে বাংলাদেশের রাজণীতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরকারি দলের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও দলটির নেতৃবৃন্দ জিএসপি সুবিধা বন্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সরাসরি অভিযুক্ত করলে তিনি ২৯ শে জুন ২০১৩ এ অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের বাণিজ্যসুবিধা (জিএসপি) স্থগিতের জন্য তিনি কোনো চিঠি দেন নি। চিঠি দেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বরং যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের সঙ্গে আমার যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই আমি বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধার আওতায় আনার অনুরোধ করেছি। ২৯ শে জুন জাতীয় সংসদে চলতি অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের জন্য সরকারকে দায়ী করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আমরা যেহেতু ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে পারিনি, তাই তারা জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। এ ব্যাপারে তার নিজের ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি। তিনি ২৯ শে জুন সকালে ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘সোশ্যাল বিজনেস ইয়ুথ কনভেনশনে’ প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করলেও এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে তিনি আশা প্রকাশ কওে বলেন, চেষ্টা করলে আবারো এই সুবিধা ফিরে পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, পোশাক কারখানায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মুত্যুর পর কারখানার কর্ম পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজারÑসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত ২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান এক বিবৃতি দ্বারা এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার লংঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন গত জানুয়ারিতে জিএসপি সুবিধার বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধার বিষয়ে প্রথম প্রশ্ন ওঠে ২০০৭ সালে। এরপর শ্রমিকদের কাজের উপযুক্ত পরিবেশ, সংগঠন করার অধিকার ও প্রাপ্য মজুরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠনগুলোর আপত্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশের এ সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে দেখতে শুরু করে মার্কিন বাণিজ্য দপ্তর। সবশেষ শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকান্ড আর তাজরীনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এ সুবিধা নিয়ে নতুন করে শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপের মুখে পড়ে মার্কিন প্রশাসন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের বক্তব্যও জানতে চাওয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে তাদের মতামত দাখিল করে। বিষয়টি নিয়ে শুনানির মধ্যেই গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩০ জনের মৃত্যু হয়, যাদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক। আওয়ামী লীগের যুগ্মÑসাধারণ সম্পাদক মাহবুবÑউল আলম হানিফ বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার তদবিরেই পোশাকশিল্পে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা জিএসপি বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৯ শে জুন রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ডিপে-ামা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে আইডিবি’র জেলা নেতৃবৃন্দের সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন। তিনি বলেন, জিএসপি সুবিধা বাতিলের জন্য খালেদা জিয়াই দায়ী।
ক্ষমতার লোভে আন্তর্জাতিক বাজারে লবিষ্ট নিয়োগ করে জিএসপি সুবিধা বাতিলে সহায়তা করেছেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি বলেন, খালেদা জিয়ার ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা প্রবন্ধে তিনটি আহবান ছিল, তন্মধ্যে একটি ছিল জিএসপি সুবিধা বাতিল।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) স্থগিতের ফলে অন্য বাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আরেক দেশ কানাডাও বাংলাদেশের পণ্যের বড় আমদানিকারক। ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের দেয়া জিএসপি সুবিধার ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে আপাতত সামান্য প্রভাব পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে তা অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাঁদের মতে, এরফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ সব ধরনের পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের অনীহা তৈরি হতে পারে। কারণ শ্রমমানের উন্নতি হয়নিÑএমন অভিযোগ তুলে ওবামা প্রশাসন বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। এদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছে। দেশে বর্তমানে পোশাক শিল্প নিয়ে আভ্যন্তরীন ও আন্তর্জাতিক ভাবে বিভিন্ন ষরযন্ত্র চলছে। যেহেতু এ শিল্প দেশের বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অগ্রণি ভূমিকা পালন করছে তাই একে রাজনীতির উর্দ্ধে রেখে দলমত নির্বিশেষে সকলকে এ শিল্প রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এ শিল্পের ধ্বংস পরিণামে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিকে পংগু করে দিবে। ¬

(অধ্যাপক ওমর ফারুক।। সুলেখক, সামাজিক গবেষক, সাংবাদিক, ইংরেজি সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট সম্পাদক, পাক্ষিক তৃতীয় বাংলা‘র প্রধান সম্পাদক, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক প্রবাস বার্তা’র ইউকে ব্যুরো উপদেস্টা সম্পাদক ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইউরোবাংলা’র বহির্বিশ্ব প্রতিনিধি)

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button