ট্রাম্পের তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা: যাতে নেই ন্যায়বিচার ও শান্তি

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই বহুল প্রতীক্ষিত বক্তৃতা শুনতে আমি নাবলুসের কাছে আমার গ্রামের জলপাই ফসল তোলা বাদ দিয়েছিলাম, যা তিনি দিয়েছিলেন ইসরায়েলি নেসেটে এবং পরবর্তীতে শার্ম আল-শেইখ সম্মেলনে।
একটু সরলভাবেই হয়তো আমি আশা করেছিলাম—যিনি আবারও মধ্যপ্রাচ্যের কূটনীতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট, কমপক্ষে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ স্বীকার করবেন বা শান্তির জন্য একটি সত্যিকারের দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করবেন। কিন্তু যা শুনলাম, তা আমাকে গভীরভাবে হতাশ, ক্রুদ্ধ ও আহত করলো।
“ইসরায়েলের বেদনা”, কিন্তু ফিলিস্তিনের মৃত্যু নয়:
ট্রাম্প প্রায় এক ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন —যা নিজের প্রশংসা ও ইসরায়েলের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধাতে ভরপুর। তিনি বললেন, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইতিহাসের “অন্ধকারতম দিনগুলোর একটি।” তিনি বারবার ইসরায়েলি ভয়, কষ্ট ও সাহসিকতার গল্প বললেন —কিন্তু একবারও বলেননি গাজার গণহত্যার কথা, যেখানে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে, পরিবারগুলো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে, শিশুরা অনাহারে মরছে, যা এখন খোলা আকাশের নীচে বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কবরস্থান।
“শান্তি”র নামে অস্ত্র বিক্রি ও দখল:
তিনি গর্ব করে বললেন, তার প্রশাসন এমনভাবে “ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে যেভাবে কেউ দাঁড়ায়নি।” তিনি মনে করিয়ে দিলেন, আমেরিকান দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়া ও অবৈধ বসতিগুলোকে বৈধ ঘোষণা করা ছিলো তারই কাজ।
তিনি এসব এমনভাবে বললেন যেন আমাদের ভূমি দান করা কোনো শান্তির কাজ। একজন দখলদারিত্বের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনি হিসেবে তার কথাগুলো আমার কাছে শুধু অজ্ঞতাই নয়, নির্মমতাও মনে হয়েছে। তিনি আমাদের মানবিক অস্তিত্বকেই মুছে ফেললেন।
তিনি ৭৭ বছরের উচ্ছেদ ও নিপীড়নের ইতিহাস মুছে ফেললেন। চেকপয়েন্টগুলো মুছে ফেললেন, যা আমাদের জীবনকে ভাগ করে রেখেছে। দেয়ালগুলো, যা আমাদের গ্রামগুলোকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছে আর সৈন্যরা, যারা প্রতিদিন আমাদের প্রবীণ ও শিশুদের অপমান করে তার কথা অবলীলায় মুছে ফেললেন তার বক্তৃতা থেকে।
বাস্তবতা- ক্ষুধা, ধ্বংস আর হতাশা:
যখন ট্রাম্প জেরুজালেমে কথা বলছিলেন, তখন আমার গাজার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তার পরিবারকে আশ্রয় ও খাদ্য দিতে ছুটোছুটি করছিলেন, কারণ ইসরায়েলি বোমায় তার ঘর ধ্বংস হয়ে গেছে।তিনি এখন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে একটি ছোট তাঁবুতে থাকেন, তাদের ভাঙা পাড়া থেকে অনেক দূরে।
একটি ছোট ভয়েস নোটে, যার পেছনে ড্রোনের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, তিনি বলেছিলেন, “দুই দিনে আমরা সামান্য কিছুই খেতে পেরেছি। ”যখন ট্রাম্প “ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা”র কথা বলছিলেন,তখন আমার বন্ধু লড়ছিলেন ক্ষুধা, ঠান্ডা ও হতাশার বিরুদ্ধে। তিনি লড়ছিলেন না কোনো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, বরং তিনি লড়ছিলেন এমন একটি যুদ্ধযন্ত্রের বিরুদ্ধে, যা তার জীবনকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
“শান্তি পরিকল্পনা” নয়, উপনিবেশিক চুক্তি:
ট্রাম্পের তথাকথিত “শান্তি পরিকল্পনা” আসলে কোনো পরিকল্পনাই নয়।এটি ১৯৪৮ সাল থেকে চলমান ঔপনিবেশিক চিন্তার ধারাবাহিকতা: যাতে আছে ইসরায়েলের আধিপত্য নিশ্চিত করা, আর ফিলিস্তিনিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার বিষয়টি।
তার এই পরিকল্পনা সংঘাতের মূল কারণ ইসরায়েলি দখলদারিত্বের কথা একবারও উল্লেখ করে না।এর ভাষা অস্পষ্ট, “অর্থনৈতিক সুযোগ” ও “আঞ্চলিক সহযোগিতা”র কথা বলে, যেন আমরা স্বাধীনতার বদলে চাকরি চাই।
এটি প্রতিশ্রুতি দেয় ইসরায়েলের নিরাপত্তা, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা নিয়ে একটিও শব্দ নেই। এটি উদযাপন করে আরব দেশগুলোর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক, কিন্তু উপেক্ষা করে বর্ণবৈষম্য ও ভূমি দখলের বাস্তবতা। এটা কোনো শান্তি নয়। এটা একটি রাজনৈতিক মরীচিকা, যা ইসরায়েলকে আরও সময় দেয় তার উপনিবেশ বিস্তার চালিয়ে যাওয়ার।
“শতাব্দীর সেরা চুক্তি” — আসলে শতাব্দীর প্রতারণা:
আমি স্মরণ করি, ২০২০ সালে ট্রাম্পের “ডীল অব দ‌্য সেঞ্চুরি”র কথা। তখনও তিনি ইসরায়েলি নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনার মতো এটিও চেয়েছিল অবৈধকে বৈধ করতে, বসতি সংযুক্ত করতে,
শরণার্থীদের অধিকার অস্বীকার করতে আর ফিলিস্তিনি ভূমিকে চিরস্থায়ীভাবে বিভক্ত করতে। আজ পার্থক্য শুধু এতটুকুই —
গাজায় ধ্বংস ও পশ্চিম তীরে দখল এতটাই বেড়েছে যে এ ধরনের পরিকল্পনা এখন আরও অমানবিক ও বিকৃত।
“সভ্যতা”র নামে দখল:
যখন ট্রাম্প নেসেটে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইসরায়েল হলো গণতন্ত্র ও সভ্যতার আলোকবর্তিকা”, তখন আমার মনে পড়ল — আমার গ্রামের পাশে যে জলপাই গাছগুলো সেনাবাহিনীর পাহারায় উপড়ে ফেলা হয়েছে সেগুলোর কথা।
আমার মনে পড়ল শত শত চেকপয়েন্ট, যা আমাদের জমিতে পৌঁছাতে বাধা দেয়। আমার মনে পড়ল গাজার সেই বন্ধুরা,
যারা দুই বছর ধরে এক রাতও নিরাপদে ঘুমোতে পারেনি। এই কি সেই “সভ্যতা” যার প্রশংসা তিনি করছিলেন?
শান্তি মানে ন্যায়বিচার:
আমাদের জন্য, শান্তি মানে যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়, শান্তি মানে ন্যায়বিচার। এর অর্থ হলো যুদ্ধাপরাধের জবাবদিহি, নিজের ভূমিতে দখল ও অবরোধমুক্ত জীবন, ভয়হীন ও মর্যাদাপূর্ণ অস্তিত্ব।
আরব নীরবতা:
শার্ম আল-শেইখ সম্মেলনে ট্রাম্পের পাশে ছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি ও কয়েকজন আরব কর্মকর্তা। তারা সবাই একই কথা বললেন । বললেন স্থিতিশীলতা” “নিরাপত্তার কথা এবং সহিংসতার চক্র বন্ধের কথা। কিন্তু যা তারা বললেন না, সেটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউ বলেননি দখলদারিত্ব বন্ধের কথা, কেউ বলেননি গাজার অবরোধ তুলে নেওয়ার কথা, কেউ বলেননি ফিলিস্তিনি শহিদদের ন্যায়বিচারের কথা।
অনেক আরব সরকার যেন ফিলিস্তিন প্রশ্ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, নিজ নিজ স্বার্থে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। কিন্তু অন্যায় উপেক্ষা করে শান্তি আসবে না। কারণ অন্যায় থেকেই প্রতিরোধ জন্ম নেয়।
ট্রাম্পের পরিকল্পনা–রাজনীতি নয়, ব্যবসা:
ট্রাম্পের কাছে কূটনীতি মানে ব্যবসায়িক চুক্তি। যেখানে মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার হলো লেনদেনের পণ্য। তার দৃষ্টিভঙ্গি লেনদেনমূলক: অস্ত্র বিক্রি করো, চুক্তি করো, মিত্রদের পুরস্কৃত করো।
এই পরিকল্পনার মাধ্যমে ট্রাম্প চান ইসরায়েলের অপরাধ ধুয়ে মুছে ফেলতে, গণহত্যা ও বর্ণবৈষম্যকে “স্থিতিশীলতা ও অংশীদারিত্ব” হিসেবে দেখাতে। তিনি চাচ্ছেন ইসরায়েলের ভাবমূর্তি বিশ্বে উজ্জ্বল করতে, একইসাথে অস্ত্র ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুযোগ বাড়াতে, এটাই অত্যাচারের বাণিজ্যিকীকরণ।
আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের পতন:
যদি ইসরায়েলকে তার লাইভস্ট্রিম করা হত্যাযজ্ঞের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি না করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার পতন ঘটেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিষ্ঠিত যে প্রতিষ্ঠানগুলো “ন্যায়বিচার রক্ষা” ও “গণহত্যা রোধ” করার কথা বলেছিল —তারা অর্থহীন হয়ে গেছে। যদি এমন নৃশংসতা দিনের আলোয় ঘটে, আর বিশ্বনেতারা একে “শান্তি” বলে অভিহিত করেন, তবে মানবতার নৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়েছে।
এটি কোনো শান্তি প্রক্রিয়া নয়, এক প্রদর্শনী:
যখন ট্রাম্প বক্তৃতা শেষ করে ইসরায়েলি সংসদের করতালিতে সিক্ত হলেন, আমি বুঝলাম —এটা কোনো শান্তি প্রক্রিয়া নয়, এটা ছিল একটি রাজনৈতিক মঞ্চনাট্য। উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েল ও তার মিত্রদের আশ্বস্ত করা যে, কিছুই পরিবর্তন হবে না, ফিলিস্তিনিদের কষ্ট থাকবে পটভূমির আওয়াজ হিসেবে।
কিন্তু আমাদের বাস্তবতা ভিন্ন — প্রতিদিন গাজায় নতুন হত্যাযজ্ঞ, পশ্চিম তীরে নতুন গ্রেপ্তার, ভূমি দখল, ধ্বংস আর হতাশা। আমরা ন্যায়বিচারহীন শান্তির ভান করার বিলাসিতা ভোগ করি না।
জলপাই গাছের নিচে সত্যিকারের শান্তি:
ট্রাম্পের বক্তৃতার পর আমি ফিরে গেলাম আমার জলপাই গাছে। যখন দাদার রোপণ করা গাছ থেকে ফল তুলছিলাম, আমি অনুভব করলাম আমাদের ভূমি ও সংগ্রামের গভীর সংযোগ। এই গাছগুলো খরা, যুদ্ধ, দখল—সব কিছুইতেই টিকে গেছে।
তারা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী, আমাদের অটলতার প্রতীক।
ট্রাম্প হয়তো বিলাসবহুল প্রাসাদে “শান্তি”র কথা বলবেন, কিন্তু বাস্তব শান্তি জন্ম নেয় এখানেই —ফিলিস্তিনের মাটিতে, আমাদের মানুষের মর্যাদায়, আর সেই ন্যায়বিচারের সন্ধানে, যা কোনো বক্তৃতা থামাতে পারে না।
উপসংহার:
যতদিন দখলদারিত্ব শেষ না হবে, যতদিন গাজার অবরোধ না উঠবে এবং গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের অপরাধীরা শাস্তি না পাবে —ততদিন কোনো শান্তি থাকবে না। বিশ্বকে বুঝতে হবে, ফিলিস্তিনিরা শান্তি প্রত্যাখ্যান করে না, তারা অন্যায়ের ছদ্মবেশী শান্তি প্রত্যাখ্যান করে।
আমরা কোনো বিশেষ সুবিধা চাই না, আমরা চাই আমাদের মৌলিক মানবাধিকার: স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচার। ট্রাম্পের এই সফর কেবল এক সত্য প্রমাণ করেছে যে, অন্যায় ও অস্বীকারের ওপর গড়া শান্তি কখনো স্থায়ী হয় না। নেসেট বা শরম আল- শেইখে নয়, বাস্তব শান্তি শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের অধিকারের স্বীকৃতি ও ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসানেই। আর তখনই আমরা অর্থবহ শান্তির কথা বলতে পারব। -ফারিদ তামাল্লাহ, রামাল্লায় বসবাসরত ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ফারিদ একজন কৃষক, পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button