যুদ্ধ স্থগিত, জবাবদিহি অস্বীকৃত : গাজার সার্বভৌমত্বের লড়াই
১৩ অক্টোবর মিশরের শার্ম আল-শেইখে এক শীর্ষ সম্মেলনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ এল-সিসি ও অন্যান্য আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন, যা গাজায় একটি “নতুন অধ্যায়”কে স্বাগত জানায়। ট্রাম্পের ২০-পয়েন্ট শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপের অংশ হিসেবে, একটি যুদ্ধ বিরতি কার্যকর হয়েছে, যা গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ ও যুদ্ধ কর্মকাণ্ডকে থামিয়েছে। বন্দী ও জিম্মিরা মুক্তি পেয়েছেন,আর পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিক শিরোনামগুলো এই সাফল্যকে উদযাপন করেছে। কিন্তু আশাবাদী শিরোনামের পেছনে সূক্ষ্ম বিবরণ একটি ভিন্ন ছবি দেখায়।
অস্থির যুদ্ধ বিরতি:
যুদ্ধ বিরতি দুর্বল অবস্থা বজায় রেখেছে। ইসরায়েলি সৈন্যরা এখনও গাজার কিছু অংশে অবস্থান করছে এবং হামাস অস্ত্র ত্যাগ করেনি। প্রস্তাবিত আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষীবাহিনী, যার পরিবর্তন প্রক্রিয়া নিরাপদ করতে হয়েছে, এটি পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত নয়: তার গঠন, ম্যান্ডেট এবং নেতৃত্ব এখনও অস্পষ্ট। গাজার বাইরের বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রাফাহ ক্রসিং আংশিকভাবে বন্ধ আছে, যার ফলে হিউম্যানিটেরিয়ান কনভয় আটকে পড়েছে।
বর্তমানে, বোমাবর্ষণ স্থগিত, কিন্তু লঙ্ঘন এখনও ঘটছে, ইসরায়েলি বাহিনী যুদ্ধবিরতি ভাঙার ঘটনার সময় কয়েক ডজন মানুষ হত্যা করেছে।
শান্তি পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা:
ট্রাম্পের ২০-পয়েন্ট শান্তি পরিকল্পনায় গাজার পুনর্গঠন, সব সশস্ত্র গোষ্ঠীর (বিশেষত হামাস) অস্ত্র ত্যাগ, হিউম্যানিটেরিয়ান সহায়তার প্রবেশাধিকার,আর একটি আন্তর্জাতিক “শান্তি বোর্ড” গঠন প্রতিশ্রুত। কিন্তু পরিকল্পনা সার্বভৌমত্ব, মুক্তি, রাষ্ট্রত্ব বা স্বীকৃতি নিশ্চিত করে না। এটি ইসরায়েলের ভূমিকা, বিপর্যস্ত নাগরিকদের দুর্দশা বা মানবাধিকার লঙ্ঘন উল্লেখ করে না। পরিকল্পনার ভাষা “প্রযুক্তিগত ফিলিস্তিনি প্রশাসন” উল্লেখ করে, যা আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। এটি ক্ষমতার স্থানান্তর নয়, বরং দীর্ঘস্থায়ী তত্ত্বাবধানের মতো। পরিকল্পনা একটি “ফিলিস্তিনি স্ব-নিয়ন্ত্রণের বিশ্বাসযোগ্য পথ” নির্দেশ করে, কিন্তু সময়সীমা, নির্বাচনী প্রক্রিয়া বা বিদেশি নিয়ন্ত্রণের শেষ নির্ধারণ করে না।
শব্দের ব্যবহারও শর্তযুক্ত:
“বিশ্বাসযোগ্য” এবং “পথে” যা স্ব-নিয়ন্ত্রণকে ভবিষ্যতে স্থাপিত করে, একটি দীর্ঘ অন্তর্বর্তীকালীন ধাপের পর। ফলে, গাজাকে স্বীকৃতি ছাড়া সাময়িক ত্রাণ দেওয়া হয়েছে।
সার্বভৌমত্বের অভাব:
সার্বভৌমত্বের অভাবই শান্তির প্রকৃতি নির্ধারণ করে। সীমান্ত, সম্পদ বা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ না থাকলে, গাজা বাইরের পরিচালনায় থাকা অঞ্চল হিসেবে থেকে যেতে পারে, নিজস্ব জনগণ দ্বারা শাসিত হওয়ার পরিবর্তে।
পরিস্থিতি স্পষ্ট:
যুদ্ধ শেষ হবে নীরবতায়, মুক্তিতে নয়। একটি প্রযুক্তিগত সরকার বিদেশি মনোনীতদের তত্ত্বাবধানে, ধ্বংসাবশেষ স্থিতিশীল করতে পারে, কিন্তু সার্বভৌমত্ব বা বৈধতা দিতে পারবে না।
অস্ত্র ত্যাগ- নিরাপত্তার অগ্রাধিকার:
পরিকল্পনা অস্ত্র ত্যাগকে কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে উপস্থাপন করে: গাজাকে “নিরস্ত্রীকরণ ও চরমপন্থামুক্ত” করতে হবে, তারপরই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হবে — নিরাপত্তা প্রথম, গণতন্ত্র পরে। এ ধরনের ক্রম শান্তি নির্মাণের যুক্তি উল্টো করে দেয়। রাজনৈতিক নিশ্চয়তা ছাড়া অস্ত্র ত্যাগ শান্তির পদক্ষেপের চেয়ে সমর্পণ মনে হতে পারে। নিরাপত্তা অধিকার সহ থাকে, এটি অধিকারকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। নাহলে শান্তি শুধু নিরাশার পরিচালনা হয়ে যায়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বন্দ্ব:
ইইউ পরিকল্পনাকে সতর্কভাবে অনুমোদন করেছে, যদিও এটি গণতন্ত্র ও স্ব-নিয়ন্ত্রণে চুপচাপ। একটি শান্তি প্রক্রিয়া যা নির্বাচন বিলম্বিত ও সার্বভৌমত্ব স্থগিত করে, ইইউর দাবি করা মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। যদি রাষ্ট্রত্ব অসীমভাবে বিলম্বিত হয়, গাজা হতে পারে “সার্বভৌমত্বহীন ভূমি।”
ন্যায়বিচারের চুপচাপ:
পরিকল্পনা কোনো ন্যায়বিচার উল্লেখ করে না। দুই বছরের যুদ্ধের সময় অপরাধের জন্য কেউ জবাবদিহি বহন করবে না।
যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ:
গাজার পরিবারগুলো যারা বাস্তুচ্যুত ও হামাস দ্বারা নিহত বা অপহৃত ইসরায়েলি পরিবারগুলো জবাবদিহিতাহীন পুনর্গঠনে শুধু শূন্যতাই অনুভব করবে। একটি স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজন: বিশ্বাস, সমন্বয়, তদন্ত, শাস্তি, সংস্কার ও সহাবস্থান।
মানবিক চাহিদা ব্যাপক। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালের পর কমপক্ষে একবার গাজার জনসংখ্যার চার পঞ্চমাংশ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর গাজার অনেক অংশ এখন ধ্বংসস্তূপ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সতর্ক করে দিয়েছে যে, ধ্বংসাবশেষ সরাতে দুই দশক লাগতে পারে, খরচ হতে পারে কোটি কোটি ডলার।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বিনিয়োগ ও পুনঃ নির্মাণের মাধ্যমে গাজাকে একটি “নতুন গাজা”য় রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু অর্থ কীভাবে যোগাড় হবে এবং কে এর তত্ত্বাবধান করবে তার বিস্তারিত নেই।
শান্তি যদি নিছক একটি সহিংসতার বিরতি না হয় তবে স্থায়ী শান্তির তিনটি ভিত আবশ্যক। প্রথমত: নির্বাচনের নির্ধারিত সময়সূচি ও স্ব-শাসনের মাধ্যমে গাজার জনগণের জন্য সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত: স্বাধীন তদন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য জবাবদিহি ব্যবস্থার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে হবে।
তৃতীয়ত: পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে শুধু অবকাঠামো নয়, অধিকার ও মর্যাদা অবশ্যই অগ্রাধিকারঝ পাবে।
উপসংহার:
বর্তমানে অস্ত্র শান্ত, কিন্তু ন্যায়বিচার নীরব। ট্রাম্পের পরিকল্পনা একটি যুদ্ধ বিরতি ও স্বস্তি দেয়, কিন্তু দুটি মূল প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে দেয়: শান্তি কি স্থায়ী হবে, কে শাসন করবে? কে জবাবদিহি হবে? গাজার ট্রাজেডি শুধু ধ্বংসে নয়, এর পরের নীরবতাতেও নিহিত।
সার্বভৌমত্বহীন একটি ভূমি হচ্ছে বন্দী ভূমি, জবাবদিহি ছাড়া যুদ্ধ বিদ্যমান থাকে উন্মুক্ত ক্ষত হিসেবে। বাস্তব শান্তি নির্ভর করবে: গাজার মানুষ নিজের ভবিষ্যত নিজেই গড়তে পারছে কিনা। কূটনীতির এই নাজুক মুহূর্তে, বন্দীরা মুক্তি পেয়েছে, যুদ্ধ বিরতি হয়েছে, পুনর্গঠনের আলোচনা চলছে। কিন্তু শান্তির রূপ এখনও অনিশ্চিত। গাজার জন্য প্রতিশ্রুতি হলো পুনর্গঠিত ভবিষ্যত, কিন্তু খসড়া অসম্পূর্ণ। যুদ্ধ বিরতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শান্তি যদি শাসন, কর্তৃত্ব ও ন্যায়বিচারের প্রশ্নের উত্তর না দেয়, তাহলে তা অস্থির থাকবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য চ্যালেঞ্জ যুদ্ধ বন্ধ করা নয়, ন্যায্য শান্তি শুরু করা। গাজার মানুষের জন্য দুটি পছন্দ রয়েছে যার একটি হলো, দূরের নিয়ন্ত্রণে পুনর্গঠন আর অপরটি নিজের ক্ষমতায় পুনর্গঠন। বিশ্ব তাদেরক সাহায্য করতে হবে দ্বিতীয়টি বেছে নিতে। -আজমত আলি, ভারতের নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন বিভাগে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থী।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



