দুই বছরের গাজা গণহত্যায় ইসরাইল বৈশ্বিক সমর্থন হারিয়েছে
গাজায় দুই বছরের অবিরাম ধ্বংসযজ্ঞের পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হতেই একটি সত্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: ইসরায়েল জয়লাভ করেনি, আর গাজাও ভেঙে পড়েনি। সব ধ্বংস আর শোকের মাঝেও ইসরায়েলের যুদ্ধ শেষ হয়েছে বিজয়ে নয়, বরং এই সত্যের উন্মোচনে যে, সে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। গাজায় যা ঘটেছে, তা শক্তির প্রদর্শন নয় বরং ন্যায় নীতির পতন।
শুরু থেকেই ইসরায়েলি নেতারা অঙ্গীকার করেছিল “প্রতিরোধ ধ্বংস করবে,” “গাজাকে শুদ্ধ করবে,” এবং “ভয়ভীতি পুনঃস্থাপন করবে।” কিন্তু এই লক্ষ্যগুলোর কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিরোধ টিকে আছে, তাদের নেতৃত্ব বেঁচে আছে, তাদের নেটওয়ার্ক কার্যকর রয়ে গেছে। অবরোধ, বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসের মধ্যেও গাজার রক্ষাকর্মীরা সংগঠিত ও অবিচল ছিল। একসময় “অজেয়” বলে খ্যাত ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আজ বিধ্বস্ত, মনোবলহীন এবং শ্রেষ্ঠত্বের ভাবমূর্তি হারিয়েছে তারা।
একটি কলঙ্কিত রাষ্ট্র:
যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে ইসরায়েলের পতন আরও স্পষ্ট। অর্থনৈতিকভাবে এই যুদ্ধ ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সরাসরি ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হচ্ছে, দশ বিলিয়ন ডলার। আর পর্যটন ও বিদেশি বিনিয়োগ সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়েছে দেশটির। বিমান সংস্থা থেকে ইসরাইলের বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান—বিমান সংস্থা থেকে প্রযুক্তি কোম্পানি পর্যন্ত ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের ব্যবসা বন্ধ বা স্থগিত করেছে।
তেল আভিভ স্টক এক্সচেঞ্জ গত দুই দশকের সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্স রেকর্ড করেছে। দেশের ভেতরে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ, অতি-ডানপন্থী ও অবশিষ্ট মধ্যপন্থী এবং উপনিবেশকারী ও সৈন্যদের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়েছে।
ভয় ও অবিশ্বাস এখন দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় অভিবাসন নীরবে বেড়ে চলেছে।
রাজনৈতিকভাবে, ইসরায়েল আধুনিক ইতিহাসের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলোর সংসদ তার কার্যকলাপের নিন্দা করছে এবং এক সময় যারা ইসরায়েলকে সমর্থন করত সেই রাজনৈতিক দলগুলো এখন তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলছে। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশ ইসরাইল থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে কিম্বা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে। এমনকি ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রে তাদের জনসমর্থনও রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ, ট্রেড ইউনিয়নের বিবৃতি, এমনকি ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যেও মতভেদ দেখা দিয়েছে।সব মিলিয়ে এটাস্পষ্ট যে, ইসরায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন এখন আর টেকসই নয়।
“গণতন্ত্রের বাতিঘর” হিসেবে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি ভেঙে পড়েছে। সেটি এখন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে তদন্তাধীন এক বহিষ্কৃত রাষ্ট্র।
ফিলিস্তিনি বর্ণনার বিজয়:
এদিকে গাজা, যে অঞ্চলটিকে ইসরায়েল মুছে ফেলতে চেয়েছিল,তা আজও টিকে আছে। সামরিক অর্থে জয়লাভ না করলেও, গাজা অবিচলতার মাধ্যমে বিজয়ী। বিমান হামলা তার মনোবল ভাঙতে পারেনি, অবরোধ তার মানবতা নিঃশেষ করতে পারেনি। ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকেও জীবন আবার উঠে আসে। যে বাবা-মা তাদের সন্তানকে কবর দেয়, তারা আবার ঘর গড়তে ফিরে আসে। শিক্ষকরা তাবুতে অস্থায়ী স্কুল খোলেন, শিশুরা মোমবাতির আলোয় পড়াশোনা করে।
গাজা রক্তাক্ত, কিন্তু নত নয়। তাদের সংগ্রাম শুধু প্রতিবাদের কারণে নয় বরং এক অটল বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত। মর্যাদা কখনও আপসযোগ্য নয়।
এই যুদ্ধ বিশ্বচেতনায়ও পরিবর্তন এনেছে। দশকের পর দশক এই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক পরিসরে ফিলিস্তিনের ন্যারেটিভ ইসরায়েলের ন্যারেটিভকে ছাড়িয়ে গেছে। ইসরায়েলি প্রচারণার যন্ত্র, যা একসময় পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করত, তা এখন ভেঙে পড়েছে অকাট্য প্রমাণের ভারে। বিশ্ব দেখেছে,রিয়েল টাইমে, পরিবার হত্যা, হাসপাতাল ধ্বংস ও বেসামরিকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনাহারে ফেলে দেওয়ার ঘটনা। কোনো জনসংযোগ কৌশলই তা ঢাকতে পারেনি। নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন, প্যারিস থেকে জোহানেসবার্গ—কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে ন্যায়বিচারের দাবিতে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের তাঁবু আন্দোলনগুলো নৈতিক প্রতিরোধের চিরস্থায়ী প্রতীক হয়ে উঠেছে।
নৈতিক অবস্থান হারানো:
ইসরাইল বিরুপভাবে তার ভীতিকর ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য যে যুদ্ধ শুরু করেছিল, সেটিই তার ভাবমূর্তি ভেঙে দিয়েছে। আজ এটি আর ভীতিকর আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং অবাধ দায়মুক্তিতে টিকে থাকা এক নৈতিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্র। ইসরায়েল আজ শুধু সামরিকভাবে ব্যর্থ একটি রাষ্ট্র নয়, এটি এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত প্রকল্প—রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সব দিক দিয়েই।
যে প্রতিরোধকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইসরাইল, সেটিই এখন বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে। গাজা, ভেঙে পড়ার বদলে, অদম্যতার সংজ্ঞা নতুন করে লিখেছে। ইসরায়েল আজ শুধু এক রাষ্ট্র নয় যে সামরিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, এটি এক প্রকল্প যা নিজস্ব ভয়, বিচারের শঙ্কা ও সমর্থকদের দূরত্বের ভয়ে আক্রান্ত। এটি হারিয়েছে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসগুলো—নৈতিক অবস্থান, বর্ণনার নিয়ন্ত্রণ এবং উদ্দেশ্যের বোধ। অন্যদিকে গাজা হারিয়েছে তার ভবনগুলো, কিন্তু তার আত্মা হারায়নি।
গাজা রয়ে গেছে যেমন ছিল—একটি ক্ষত হিসেবে, যা ভণ্ডামিকে উন্মোচিত করে।একটি প্রতীক হিসেবে যা দৃঢ়তার নতুন সংজ্ঞা দেয়। গাজা জয়লাভ করেনি কারণ বিশ্ব তাকে ত্যাগ করেছে, কিন্তু এটি ভাঙেনি কারণ ন্যায়বিচারের প্রতি তার বিশ্বাস ধ্বংসের চেয়েও শক্তিশালী।
গাজায় বিজয় পরিমাপ হয় না কত রকেট ছোড়া হলো তা দিয়ে বরং সেই মায়েদের দিয়ে যারা ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ান, সেই শিশুদের দিয়ে যারা অন্ধকারেও পড়াশোনা চালিয়ে যায়, আর সেই মানুষদের দিয়ে যারা বিশ্বাস করে—যা বোমায় ভাঙে, তা মুছে ফেলা যায় না; আর যা অবরুদ্ধ, তা কখনও মরে না।
ইসরায়েল জয়লাভ করেনি, কারণ সে তার মানবতা হারিয়েছে। গাজা ভাঙেনি, কারণ সে এখনও জীবনের মূল সত্তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। যুদ্ধ হয়তো শেষ, কিন্তু বড় লড়াই—বিবেক, সত্য ও ন্যায়ের লড়াই—এখনই শুরু হয়েছে। সেই নৈতিক বিচারে, গাজা ইতিমধ্যেই বিজয়ী। -আদনান হামিদান, যুক্তরাজ্যের প্যালেস্টিনিয়ান ফোরাম ইন ব্রিটেন (Palestinian Forum in Britain)-এর চেয়ারম্যান।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



