গাজা ধ্বংস করে ইসরায়েল তার নৈতিক ভাবমূর্তি ধ্বংস করেছে
এটি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ, রক্তাক্ত ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সমাপ্তি হবে এক ধরনের নাটকীয় প্রদর্শনীতে, যার মূল পরিচালক হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি ইসরায়েলে গিয়ে জীবিত উদ্ধার হওয়া বন্দীদের স্বাগত জানাবেন। হামাস ও কাতারের চাপে যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণাও হতে পারে।
ইসরায়েলি বাহিনী গাজার প্রধান শহরগুলো থেকে পিছু হটবে, জাতিসংঘের সহায়তা ট্রাকগুলো আবার গাজায় প্রবেশ করবে — আপাতত।
কিন্তু ভুল করবেন না, দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপের কোনো চুক্তি এখনো হয়নি, যেখানে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ ও আন্তর্জাতিক প্রশাসনের অধীনে গাজা পরিচালনার প্রস্তাব রয়েছে। এবং সম্ভবত, এমন চুক্তি হবে না।
বাস্তবতা ও ট্রাম্পের বিভ্রম:
ট্রাম্পের বক্তব্যে হামাসের ক্ষয়ক্ষতি বাস্তবতার সঙ্গে অনেকটাই বিরোধপূর্ণ। তিনি দাবি করেছেন, হামাস ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, এর নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন, ২৫,০০০ যোদ্ধা নিহত — যা এর মোট শক্তির অর্ধেকের সমান। কিন্তু হামাসের নিজস্ব মূল্যায়ন অনুযায়ী, তাদের সংগঠন, কমান্ড কাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছুই টিকে আছে। যদিও শীর্ষ নেতারা নিহত হয়েছে এবং ইসরায়েল গাজায় হিরোশিমার মতো বহু বোমা ফেলেছে। তাদের এখনো যুদ্ধের শুরুতে যত সৈন্য ছিল ততই আছে এবং তাদের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র ও বিস্ফোরক রয়েছে নতুন অস্ত্র তৈরি করার মতো। হামাস নিজেকে পরাজিত সংগঠন হিসেবে দেখে না, বরং মনে করে তারা এখনো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার যোগ্য। গাজার অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর অবস্থানও একই।
“আমাদের সময়ের শান্তি” থেকে বহু দূরে:
গাজায় হামাসের জনপ্রিয়তা যুদ্ধেও টিকে আছে, আর পশ্চিম তীরে তা বেড়েছে। আরব বিশ্বের রাস্তায়, বিশেষ করে জর্ডানে, হামাসের আল-কাসাম ব্রিগেড এখন এক কিংবদন্তি নাম। হামাস একে কখনোই যুদ্ধের সমাপ্তি হিসেবে দেখছে না —যেমনটা ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করছেন।
তাদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি তখনই সম্ভব, যখন ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমানায় ফিরে যাবে এবং গাজা, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমের দখল শেষ করবে। তারা কোনো আন্তর্জাতিক প্রশাসনকে গাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে দেবে না, যা আবার শত বছর আগের ব্রিটিশ ম্যান্ডেট যুগে ফেরার মতো।তাই ট্রাম্প যে “আমাদের সময়ের শান্তি” ঘোষণা করবেন, বাস্তবে তা এক অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি মাত্র।
কৌশলগত সাফল্য ও বিপর্যয়:
হামাস, অন্যান্য প্রতিরোধ গোষ্ঠী, এবং গাজার সাধারণ মানুষ ইসরায়েলের গণউচ্ছেদ পরিকল্পনা ব্যর্থ করেছে। তারা গণহত্যার মুখে দাঁড়িয়েও টিকে থেকেছে। তবে এই স্থিতিশীলতার মূল্য ভয়াবহ, ৬৭,০০০ এর বেশি প্রাণহানি (ধ্বংসস্তূপের নিচে থাকা লাশ বাদে),
প্রায় সব বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস।
পুরো গাজার মানুষ মানসিক আঘাত ও ক্ষুধার অভিশাপের শিকার হবে আজীবন। অন্যদিকে, নেতানিয়াহু দাবি করবেন তিনি হামাসকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, যেমন তিনি একসময় হিজবুল্লাহ ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড সম্পর্কেও দাবি করেছিলেন। তিনি বলবেন, সব বন্দি ফিরিয়ে এনেছেন এবং অন্তত আগামী প্রজন্মের জন্য গাজা থেকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন।
ইসরায়েলের সুনাম ধ্বংস:
নেতানিয়াহু গাজাকে বাসের অনুপযুক্ত মরুভূমিতে পরিণত করেছেন, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় ইসরায়েল হারিয়েছে আরও এক বড় সম্পদ —তার আন্তর্জাতিক সুনাম। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েল “নৈতিক রাষ্ট্র” হিসেবে পশ্চিমা সমর্থন পেয়েছে, বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত ইহুদিদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে। কিন্তু দুই বছরের গণহত্যা সেই ভাবমূর্তিকে ছিন্নভিন্ন করেছে।
এক সময় পশ্চিমা দেশগুলিতে “ইসরায়েলের বন্ধু” বলা মানে ছিল একজন রাজনীতিকের গম্ভীরতা ও ক্ষমতার যোগ্যতা প্রমাণ। কিন্তু এখন এই “বন্ধুত্ব” রাজনৈতিক বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সমর্থনের পতন:
সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা গেছে, ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। দুই বছর আগে, যুক্তরাষ্ট্রে ৪৭% মানুষ ইসরায়েলের পক্ষে ছিল, ২০% ফিলিস্তিনের পক্ষে। এখন, নিউ ইয়র্ক টাইমসের জরিপ অনুযায়ী, ৩৫% ফিলিস্তিনের পক্ষে, ৩৪% ইসরায়েলের পক্ষে। অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক এখন ইসরায়েলকে অতিরিক্ত সামরিক সাহায্য দেওয়ার বিরোধিতা করছে এবং ৬০% মানুষ মনে করে যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত, যদিও সব বন্দি মুক্ত না হয়। তরুণদের মধ্যে এই বিরোধিতা আরও তীব্র —৩০ বছরের নিচে ৭০% ভোটার ইসরায়েলকে সাহায্যের বিপক্ষে।
সামাজিক মাধ্যমে ইসরায়েলের পরাজয়:
সামাজিক মাধ্যমেও ইসরায়েল জনমতের যুদ্ধে হেরে গেছে। ‘সাইবার সিকিউরিটি ফর ডেমোক্র্যাসি’ গবেষণায় দেখা গেছে —প্রতিটি প্রো-ইসরায়েল পোস্টের বিপরীতে ১৭টি প্রো-ফিলিস্তিনি পোস্ট ছড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক বিচার ও প্রতিবাদ:
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও বিচার আদালতেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা চলছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এখন পুতিনের সমান বা তারও বেশি গুরুতর। ইউরোপজুড়ে রেকর্ড সংখ্যক প্রতিবাদ হচ্ছে , জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ গাজা গণহত্যার বিরুদ্ধে লাল রেখা টানছে।
অপ্রতিরোধ্য পরিবর্তন:
বিশ্লেষক মইন রাব্বান লিখেছেন: “আমি নেদারল্যান্ডসে বড় হয়েছি, একসময় ইউরোপের সবচেয়ে প্রো-ইসরায়েল দেশ ছিল এটি।
আজ সেখানে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে গাজা গণহত্যার প্রতিবাদ করছে।”
তার ভাষায়, “ইসরায়েল চিরতরে ডাচ জনসমর্থন হারিয়েছে, ভবিষ্যতের সরকারগুলোর পক্ষে ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়ানো ক্রমেই কঠিন হবে।” একই অবস্থা স্পেন ও ইতালিতেও। ইতালিতে ৪ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করেছে, যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করা হয়।
ফিলিস্তিনপন্থী ধারা এখন অপরিবর্তনীয়:
যুদ্ধ শেষ হলেও এই বৈশ্বিক জনসমর্থন অদৃশ্য হবে না। বরং এটি এখন অপ্রতিরোধ্য ধারায় রূপ নিচ্ছে। হামাস সব বন্দি মুক্ত করে নিজেদের একটি বড় বোঝা থেকে মুক্ত করেছে, যা ইসরায়েলের সমর্থকদের একটি বড় যুক্তি কেড়ে নিয়েছে।
যদি যুদ্ধবিরতি চুক্তি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপে না যায়, তাহলে নেতানিয়াহু দক্ষিণ লেবানন বা সিরিয়ার মতো একটি “নিয়ন্ত্রিত সংঘাত” অবস্থা বজায় রাখবেন, মাঝেমধ্যে বোমা হামলা, কিন্তু স্থায়ী শান্তি নয়।কিন্তু ইউরোপের প্রতিবাদ আরও জোরদার হবে। বিশ্বে ফিলিস্তিনের অধিকার সমর্থনে যে সীমা অতিক্রম হয়েছে, তা আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।
উপসংহার
ইসরায়েল এখনো বুঝে উঠতে পারেনি,এই জনমত পরিবর্তন তাদের জন্য কতটা ঐতিহাসিক পরিণতি ডেকে আনবে। কিন্তু ইতিহাসের প্রতিটি উপনিবেশিক শক্তির মতো, তারা নিজেদের পতন কখনোই আগে থেকে টের পায় না। -ডেভিড হার্স্ট, মিডল ইস্ট আই-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক-প্রধান। তিনি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক, বক্তা এবং বিশেষ করে সৌদি আরব নিয়ে কাজ করেন। তিনি আগে দ্য গার্ডিয়ান-এর বিদেশবিষয়ক লিড রাইটার ছিলেন এবং রাশিয়া, ইউরোপ ও বেলফাস্টে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। দ্য স্কটসম্যান পত্রিকায় শিক্ষা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার পর তিনি দ্য গার্ডিয়ান-এ যোগ দেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



