ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি: ন্যায়ের পথ থেকে এক বিপজ্জনক বিচ্যুতি

ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার চলমান বিতর্ক এক বিপজ্জনক মনোযোগ বিচ্যুতি। এর মাধ্যমে কেয়ার স্টারমার ও তাঁর সরকার এমন দেখাতে পারছেন যেন তারা সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন, অথচ মূল ও গুরুতর প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। যুক্তরাজ্য কি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার দায়ে তাকে জবাবদিহি করবে? তারা কি অস্ত্র, গোয়েন্দা সহায়তা ও কূটনৈতিক সমর্থন দেওয়া বন্ধ করবে—যা ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের আশা ও ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংস করছে?
শুধু স্বীকৃতি ঘোষণা করা, কিন্তু কোনো পরিমাপযোগ্য ও কার্যকর শর্ত জুড়ে না দেওয়া, রাজনীতিকে নাটকে পরিণত করে। স্বীকৃতি তখন প্রকৃত আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে কেবল একটি শিরোনাম-কাড়া অভিনয় হয়ে দাঁড়ায়।
এর চেয়েও খারাপ বিষয় হলো—এই তথাকথিত রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করছে ফিলিস্তিনিরা নয়, বরং পশ্চিমা রাজধানী ও ইসরায়েল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ডেভিড ল্যামি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে ভবিষ্যতের যেকোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র অবশ্যই নিরস্ত্র হতে হবে। প্রথমে এটা যুক্তিযুক্ত মনে হলেও এর পরিণতি ভেবে দেখলে ভয়াবহতা স্পষ্ট হয়।
একটি নিরস্ত্র রাষ্ট্র নিজের নিরাপত্তা বা জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে না। এর মানে ফিলিস্তিনিরা স্থায়ীভাবে দুর্বল ও ইসরায়েল এবং সেই পশ্চিমা শক্তিগুলোর দয়ায় নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, যারা ইসরায়েলের সহিংসতা রুখতে অস্বীকার করছে।
তাছাড়া, স্টারমারের প্রস্তাব অনুযায়ী হামাসকে গাজা থেকে বাদ দিতে হবে এবং ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। জনপ্রিয়, যদিও বিতর্কিত, রাজনৈতিক আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার শর্তে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া মানে হচ্ছে সার্বভৌমত্বকে রাজনৈতিক দাসত্বের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা।
এটা শুধু ব্রিটেনের বিষয় নয়। বরং এটি পশ্চিমা কূটনীতির প্রতিফলন, যা ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেয় কিন্তু ফিলিস্তিনিদের টিকে থাকা ও মর্যাদাকে উপেক্ষা করে। এর পূর্বানুমেয় ফল হলো এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে আধিপত্যকে পুরস্কৃত করা হয় আর প্রতিরোধকে শাস্তি দেওয়া হয়—বসবাসকারীদের দেওয়া হয় রাষ্ট্রের ছলনা বা মরিচীকা, কিন্তু সার্বভৌমত্ব নয়।
স্টারমারের প্রস্তাব মুক্তি নয়; বরং আত্মসমর্পণ, যা উদারতার ছদ্মবেশে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। যখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয় কেবল তখনই, যদি ফিলিস্তিনিরা বহিরাগত ও দখলদারদের শর্ত পূরণ করে—যেমন নিরস্ত্রীকরণ, রাজনৈতিক বশ্যতা, বাহ্যিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে নেওয়া এবং ইসরায়েলের “নিরাপত্তা”কে ফিলিস্তিনি অধিকারগুলোর উপরে রাখা—তখন স্বীকৃতি হয়ে দাঁড়ায় আনুগত্যের পুরস্কার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অবিচ্ছেদ্য অধিকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নয়।
এই শর্তে স্টারমারের “স্বীকৃত” ফিলিস্তিন দেখতে কেমন হবে? কোনো নির্দিষ্ট সীমান্ত থাকবে না, জেরুজালেম ও মসজিদ আল-আকসার ওপর সার্বভৌম কর্তৃত্ব থাকবে না, নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে না, পানি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর স্বাধীন অধিকার থাকবে না, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের অধিকার থাকবে না। এমন একটি ফিলিস্তিন কেবল নামেই রাষ্ট্র, বাস্তবে সার্বভৌমত্বহীন এক ছদ্ম-রাষ্ট্র।
এই ভুয়া রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতাও শুরু থেকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এর নেতাদের অনুমোদন করতে হবে পশ্চিমা সরকার ও ইসরায়েলকে। এই ইসরায়েলি ঠিকাদাররা ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের ছদ্মবেশে কাজ করবে, আসলে তারা ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষার মধ্যস্থতাকারী ছাড়া কিছুই হবে না। তারা শাসন করতে পারবে কেবল তখনই, যদি ইসরায়েলের কৌশলগত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখে।
ফাঁপা এক ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া, অথচ যুক্তরাজ্য যদি ইসরায়েলের সাথে আগের মতো সম্পর্ক চালিয়ে যায়, তবে সেটা কেবল দখলদার ইসরায়েলি উপনিবেশবাদকে মজবুত করবে। এতে বর্ণবাদের কাঠামো স্থায়ী হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ইসরায়েলি নেতাদের জবাবদিহি থেকে রক্ষা করবে।
স্বীকৃতি যদি কেবল প্রতীকী হয়—বা তার চেয়েও খারাপ, ফিলিস্তিনিদের অক্ষম করে দেওয়ার শর্তে হয়—তাহলে তা কখনোই মুক্তি আনতে পারবে না।
স্টারমার, অন্য অনেকের চেয়ে বেশি, জানা উচিত যে ফিলিস্তিনি দুর্ভোগের জন্য ব্রিটেনের বিশেষ নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায় আছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের বালফোর ঘোষণা এবং তার পরের নীতিগুলো ফিলিস্তিনি বিপর্যয় সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
৭৭ বছর পরেও সেই সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্প, যা ইসরায়েল গঠনে সহায়তা করেছিল, তা এখনো গণ উচ্ছেদ, জোরপূর্বক বহিষ্কার, ৫০ লাখেরও বেশি শরণার্থী, গণহত্যা, জাতিগত নিধন এবং গণহত্যার জন্ম দিয়েছে।
বালফোর ঘোষণা, যেখানে ইহুদি জনগণের জন্য একটি স্বদেশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এই শর্তে যে “ফিলিস্তিনি জনগণের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে না”—আজ তা ছিন্নভিন্ন। বাস্তবে এখন দেখা যাচ্ছে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন, জেনেভা কনভেনশন, জাতিসংঘ প্রস্তাবনা এবং মানবিক নীতির চরম লঙ্ঘন করছে।
যদি স্টারমার সত্যিই ফিলিস্তিনি অধিকারের ব্যাপারে আন্তরিক হন এবং ঐতিহাসিক দায় মেনে নেন, তবে তার প্রস্তাবের সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ থাকা উচিত।
স্বীকৃতি দেওয়া উচিত নয় কেবলমাত্র সান্ত্বনা হিসেবে, যখন উপনিবেশবাদী যন্ত্র চালু রয়েছে। এর চেয়ে কম কিছু মানে হবে জড়িত থাকা—এমন এক প্রসাধনী উদ্যোগ, যা দখল, উচ্ছেদ ও প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যকে অক্ষুণ্ণ রাখবে। এটা দমন-পীড়নকে স্বাভাবিক করে তুলবে এবং অগ্রগতির ভান তৈরি করবে, অথচ বাস্তবে দখলদারিত্ব চলতেই থাকবে।
এই পরিস্থিতিতে স্টারমার ও যুক্তরাজ্যের একমাত্র নৈতিক, ন্যায্য ও আন্তরিক নীতি হতে পারে—কেবল প্রতীকী রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নয়, বরং সেই ইসরায়েলি ঔপনিবেশিক মতাদর্শের মোকাবিলা করা, যা অমানবিক নিপীড়নকে টিকিয়ে রেখেছে। এর অর্থ সর্বনিম্ন পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়াকে নিঃশর্ত সমর্থন করা। আর সর্বোচ্চ পর্যায়ে ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে, ধর্মবিশ্বাসহীন ও সকল ধর্মবিশ্বাসীদের সমন্বয়ে একটি একক রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করা। -ইসমাইল প্যাটেল, The Muslim Problem: From the British Empire to Islamophobia গ্রন্থের লেখক। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিডসের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিও ফ্রেন্ডস অব আল-আকসা-এর চেয়ারম্যান।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button