গাজায় প্রতিটি দিনই ১১ই সেপ্টেম্বর
বিশ্ব এখনও ভুলে যায়নি ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরকে। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমানের আঘাত, ধোঁয়া,প ভবনের ধ্বংসস্তূপ, আর একদিনে হাজারো প্রাণহানি— এসব দৃশ্য আমাদের সমষ্টিগত স্মৃতিতে চিরদিনের জন্য স্মৃতি হয়ে গেছে। এটি ছিল একটি তাৎক্ষণিক, নির্মম ও সরাসরি সম্প্রচারিত ট্র্যাজেডি, যা প্রতিটি মহাদেশের মানুষকে হতবাক করেছিল। সেই থেকে এটি ভয়, রাজনৈতিক সহিংসতা ও যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদের মুখে মানব দুর্বলতার একটি সর্বজনীন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু যেখানে একদিনের ধ্বংসযজ্ঞ বৈশ্বিক ট্রমার প্রতীক হলো, সেখানে গাজা উপত্যকায় প্রতিদিনই সেই একই ভয়াবহতা সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। এটি কোনো একক ঘটনা নয়, বরং ৭০৬ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলমান হত্যাযজ্ঞ, বোমাবর্ষণ, অনাহারকে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ভয়াবহ বাস্তবতা।
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর থেকে, যখন হামাসের নেতৃত্বে পরিচালিত আল-আকসা ফ্লাড অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল সামরিক আক্রমণ শুরু করে, তখন থেকে গাজা পরিণত হয়েছে নজিরবিহীন ধ্বংস ও মৃত্যুর এক মঞ্চে।
যা প্রতিশোধমূলক অভিযানের মতো শুরু হয়েছিল, তা রূপ নিয়েছে গণহত্যায়— ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের একটি ছোট্ট অঞ্চলে আটকে থাকা দুই মিলিয়নেরও বেশি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, যেখানে কোনো পালানোর পথ নেই, আর আকাশ, স্থল ও সমুদ্র— সর্বত্র অবরোধ।
আজ, দ্য ল্যানসেট বৈজ্ঞানিক জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, ২ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে— যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। হাজারো মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ, অবশিষ্ট হাসপাতালগুলো ভেঙে পড়ছে, আর মৃতদেহের সংখ্যা এত বেশি যে কবরস্থানের জায়গা না থাকায় গণকবর খুঁড়ে সমাহিত করা হচ্ছে।
৯/১১ এবং তার পরিণতি:
নিউইয়র্কে ৯/১১ হামলা ছিল এক নতুন যুগের অজুহাত— যেখানে পুরো সম্প্রদায়গুলোকে নজরদারি, অপরাধীকরণ এবং সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এটি ইসলামোফোবিয়া ও সাংস্কৃতিক দানবায়নের চক্রকে খাইয়ে তুলেছিল, যা আজও যুদ্ধ, দখলদারিত্ব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনকে বৈধতা দেয়।
এই হামলাগুলো আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞকে ন্যায্যতা দিতে ব্যবহৃত হয়েছিল “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ”-এর নামে, যা শেষ পর্যন্ত আরব ও মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রূপ নেয়।
গাজার সঙ্গে তুলনা অনিবার্য। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে কয়েক ঘণ্টায় প্রায় তিন হাজার জীবন হারিয়েছিল ১১ই সেপ্টেম্বর, সেখানে “ইসরায়েল” প্রতিদিন সেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে “বর্ধিত ও প্রকাশ্য নিষ্ঠুরতা” দিয়ে। আর পশ্চিমা শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে শুধুই কথার ফুলঝুরি ছড়াচ্ছে।
প্রতিটি নতুন বোমা হামলায়— স্কুল, শরণার্থী শিবির, হাসপাতাল, কিংবা মসজিদ ও গির্জায়— রক্তাক্ত শিশু, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া পরিবার, এবং ধ্বংসস্তুপের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলা বেঁচে যাওয়াদের ছবি পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। যা পশ্চিমাদের কাছে ছিল একবারের ট্র্যাজেডি, ফিলিস্তিনিদের কাছে তা প্রতিদিনের নিয়মিত বাস্তবতা।
দীর্ঘ ৭৭ বছরের ট্র্যাজেডি:
তবে গাজার ট্র্যাজেডি কেবল ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শুরু হয়নি। এটি দীর্ঘ ৭৭ বছরের একটি ইতিহাসের অংশ— ১৯৪৮ সালের নাকবা থেকে। সেই সময় শত-সহস্র ফিলিস্তিনিকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল “ইসরায়েল রাষ্ট্র” গঠনের জন্য।
তারপর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে জন্মেছে ও মরেছে, সামরিক দখল, অর্থনৈতিক অবরোধ, জমি দখল, আর নিয়মিত সামরিক অভিযানে বিপর্যস্ত হয়েছে। বর্তমান গণহত্যা হলো “ইসরায়েলি” জাতিগত নিধননীতির সবচেয়ে নির্মম রূপ, যা কখনো থেমে থাকেনি।
কেন এই ভেদাভেদ?
প্রশ্ন জাগে— কেন ১১ই সেপ্টেম্বরকে তাৎক্ষণিকভাবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো, অথচ গাজার জন্য বিশ্বব্যাপী একই প্রত্যাখ্যান দেখা যায় না?
কেন হাজারো ফিলিস্তিনির বেদনা সরকার, আদালত ও সংগঠনগুলোকে একই তীব্রতায় নাড়িয়ে দিতে পারে না, যেমনটা ২০০১ সালে আমেরিকানদের ক্ষেত্রে হয়েছিল?
উত্তর লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নৈতিক নির্বাচনী মনোভাবের ভেতর। যখন ভুক্তভোগীরা ফিলিস্তিনি হয়, তখন ক্ষোভ কৌশলগত অজুহাত, ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ এবং “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ”-এর কথাবার্তায় ম্লান হয়ে যায়, যা অগ্রহণযোগ্যকেও বৈধতা দেয়।
প্রতিদিনই ১১ সেপ্টেম্বর:
“গাজায় প্রতিদিনই ১১ই সেপ্টেম্বর।” এটি শুধু অলঙ্কারমূলক বাক্য নয়, বাস্তবতার সরল বিবরণ। যুক্তরাষ্ট্রে যা একবারের ব্যতিক্রম ছিল, তা ফিলিস্তিনে রুটিনে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি সকাল নিয়ে আসে নতুন শোক, প্রতিটি রাত শেষ হয় নতুন ধ্বংসস্তূপে।
কিন্তু পার্থক্য হলো— নিউইয়র্কে হামলা বৈশ্বিক সংহতির প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছিল, অথচ গাজার গণহত্যা তৈরি করেছে এক “সহযোগী নীরবতা।” যেন মানবতা ফিলিস্তিনিদের গণহত্যাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে, ৭৭ বছরের দখলদারিত্বের সঙ্গে আরও ৭০৬ দিনের ভয়াবহতাকে যুক্ত করে দিয়েছে, অথচ এই প্রক্রিয়ার অপরাধমূলক চরিত্র পুরোপুরি স্বীকার করছে না।
এদিকে প্রতিটি আমেরিকান বোমা, যা “ইসরায়েল” গাজায় ফেলছে, মানব বিবেকের ক্ষতকে আরও গভীর করছে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়— জীবন কতটা মূল্যবান হবে, তা এখনো অনেক সরকারের কাছে নির্ভর করছে নিহত ব্যক্তির পাসপোর্ট ও জাতিগত পরিচয়ের ওপর। -সাইয়িদ মার্কোস তেনোরিও একজন ইতিহাসবিদ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ। তিনি ব্রাজিল-ফিলিস্তিন ইনস্টিটিউট (ইব্রাসপাল)-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-সভাপতি। তিনি “পালেস্তিনা: প্রতিশ্রুত ভূমির মিথ থেকে প্রতিরোধের ভূমি” (আনিতা গারিবালদি/ইব্রাসপাল) গ্রন্থের লেখক।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



