ট্রাম্প ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত
ওয়াশিংটনে এবং ইসরায়েলের নেতানিয়াহু মন্ত্রিসভার আইন-ধ্বংসকারী সদস্যদের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)কে আক্রমণ করার উন্মাদনা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। গত মাসে ট্রাম্প প্রশাসন নির্বাহী আদেশ ১৪২০৩–এর মাধ্যমে কানাডার কিম্বারলি প্রস্ট এবং ফ্রান্সের নিকোলাস গুইলু সহ একাধিক বিচারককে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে। প্রসিকিউটররাও এর শিকার হন, যার মধ্যে ছিলেন ফিজির নাজহাত শামীম খান এবং সেনেগালের মামে মানদিয়ায়ে নিয়াং।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, যিনি এত প্রশাসনিক পদে আছেন যে নিজেও গুনতে পারেন না, তার বস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পের লাইন নিশ্চিত করেন। তার ভাষায়, আইসিসি ছিল “একটি জাতীয় নিরাপত্তা হুমকি, যা যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘ল’ফেয়ারের অস্ত্র।” ২০ আগস্টের এক বিবৃতিতে রুবিও বলেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি নাগরিকদের “তাদের দেশের সম্মতি ছাড়াই তদন্ত, গ্রেপ্তার, আটক বা বিচার করার চেষ্টা করেছেন।” যদিও রুবিও আদালতের এখতিয়ার সংক্রান্ত সম্মতির নীতি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখেন, তবুও জানা উচিত যে কিছু ক্ষেত্রে আইসিসি’র এখতিয়ার অ-স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
ইসরায়েলি বাহিনীর দ্বারা ফিলিস্তিনিদের উপর হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষেত্রে, আইসিসি এখতিয়ার পেয়েছে কারণ ফিলিস্তিন রোম সংবিধি অনুমোদন করেছে। যেহেতু অভিযোগিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়েছে, ইসরায়েল আদালতের তদন্ত ও বিচারিক পরিধির মধ্যে পড়ছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। তবুও রুবিও সেই একই অভিযোগ পুনরাবৃত্তি করে বলেন, “আমাদের সৈন্য, আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের মিত্রদেরকে আইসিসি’র অবৈধ ও ভিত্তিহীন পদক্ষেপ থেকে রক্ষা করতে” পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তার ভাষায়, রোম সংবিধির স্বাক্ষরকারীরা জানুক যে তাদের স্বাধীনতা “মার্কিনিদের বিশাল আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত।”
আইসিসি এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপকে “একটি নিরপেক্ষ বিচারিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার উপর নগ্ন আক্রমণ” বলে আখ্যা দেয়। আদালত এটিকে “রাষ্ট্রপক্ষ, আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নিরীহ ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে অপমান” বলেও উল্লেখ করে। দৃঢ়তার সাথে আদালত ঘোষণা করে যে তারা তাদের আইনগত কাঠামোর আওতায়, রাষ্ট্রপক্ষদের গৃহীত নিয়ম অনুযায়ী, “যেকোনো চাপ, হুমকি বা সীমাবদ্ধতা উপেক্ষা করে” তাদের ম্যান্ডেট পূরণ করে যাবে।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টেফান দুজারিক সাংবাদিকদের জানান যে ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত প্রসিকিউটরের অফিসের কার্যক্রমের ওপর “গুরুতর বাধা” সৃষ্টি করছে।
এ ধরনের চাপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে আইসিসি’র প্রভাববলয়ের বাইরে রাখতে চাওয়া নতুন কিছু নয়। “আমেরিকান এক্সেপশনালিজম” বা মার্কিন বিশেষত্ব সবসময়ই প্রধান যুক্তি হিসেবে আনা হয়, যদিও রোম সংবিধি প্রণয়নে মার্কিন আইনবিদদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ২০২০ সালের জুনে নির্বাহী আদেশ ১৩৯২৮ জারি করা হয়, যেখানে আইসিসি কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ভ্রমণ ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ২০২১ সালের এপ্রিলে এই আদেশ প্রত্যাহার করেন।
তবে গত বছর মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে ‘ইললেজিটিমেইট কোর্ট কাউন্টারেকশন অ্যাক্ট’ পাস হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করে এবং মার্কিন নাগরিকদেরকে সুরক্ষা দেয়। যদি আইসিসি কোনো “সুরক্ষিত” ব্যক্তিকে তদন্ত, গ্রেপ্তার, আটক বা বিচার করত, তবে প্রেসিডেন্টকে সংশ্লিষ্ট বিদেশি ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা ও সম্পত্তি অবরোধের ক্ষমতা দেওয়া হতো। এই আইন জানুয়ারি ২০২৫–এ সিনেটে ৫৪–৪৫ ভোটে ব্যর্থ হয়, যদিও সিনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার বলেন, “যতটা আমি আইসিসি’র ইসরায়েল–বিরোধী পক্ষপাতের বিরোধিতা করি, ততটাই চাই যে প্রতিষ্ঠানটি সংস্কার হোক, তবে এই বিলটি খারাপভাবে খসড়া করা হয়েছে এবং অত্যন্ত সমস্যাযুক্ত।”
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প আবার আইসিসি’র বিরুদ্ধে আক্রমণে নামে এবং নির্বাহী আদেশ ১৪২০৩ জারি করে বিলুপ্ত ‘ইললেজিটিমেইট কোর্ট কাউন্টারেকশন অ্যাক্ট’–এর বিধান পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি সতর্ক করে বলেন যে আদালতের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো “বিপজ্জনক নজির” সৃষ্টি করছে, যা মার্কিন সেনাসহ বর্তমান ও সাবেক মার্কিন নাগরিকদের “হয়রানি, নির্যাতন ও সম্ভাব্য গ্রেপ্তারের” মুখে ফেলতে পারে। তাই মার্কিন নাগরিক বা মিত্র দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইসিস’র যে কোনো পদক্ষেপে জড়িত বিদেশি ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে।
আইসিসি’র কার্যক্রমে যেকোনো সহায়তা প্রদানকারীদের—স্পন্সরশিপ, আর্থিক, উপাদান বা প্রযুক্তিগত—বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ জব্দ এবং ভিসা নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত। সবচেয়ে স্পষ্টভাবে নিশানায় আছেন আইসিসি প্রসিকিউটর করিম খান।
ট্রাম্পের এই প্রতিক্রিয়ার সমালোচনা কিছু রোম সংবিধির সদস্য রাষ্ট্র থেকে আসলেও, তা খুব সীমিত। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারব্যবস্থার প্রতি ট্রাম্পের বৈরিতা তার কিছু মিত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যেও শেয়ার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, নেতানিয়াহু জানেন যে কিছু দেশে আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করেছে যে তিনি গ্রেপ্তারযোগ্য নন, কারণ ইসরায়েল আইসিসি’র সদস্য নয়। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান প্রকাশ্যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অমান্য করে নেতানিয়াহুকে বুদাপেস্টে আমন্ত্রণ জানান এবং রোম সংবিধি থেকে তার দেশের প্রত্যাহার ঘোষণা করেন। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী পেত্র ফিয়ালা আইসিসি’র সিদ্ধান্তকে “দুঃখজনক” আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি “আদালতের কর্তৃত্বকে ক্ষুণ্ণ করছে, কারণ এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচিত নেতাদের সঙ্গে একটি ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাদের এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে।” এমন সমর্থন থাকলে আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রক্রিয়া দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক। -ড. বিনয় ক্যাম্পমার্ক, সেলউইন কলেজ, কেমব্রিজে কমনওয়েলথ স্কলার ছিলেন। বর্তমানে তিনি আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



