ব্রিটেনের শরণার্থী-বিরোধী আন্দোলনের পেছনে

২০২৫ সালের ২৯ আগস্ট, শুক্রবার শরণার্থী-বিরোধী আন্দোলনকারীরা বড় ধরণের এক আইনি পরাজয়ের মুখে পড়ে। সরকার আদালতে জয়লাভ করে—ফলে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের এক হোটেল থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের উচ্ছেদ ঠেকানো যায়। মন্ত্রীরা একে “কমন সেন্সের বিজয়” বলে প্রশংসা করেন। আর বিক্ষোভকারীরা এটিকে আবারও নতুন প্রতিবাদের হাতিয়ার বানাতে শুরু করে—তাদের দাবি, এমনকি আদালত পর্যন্ত “সাধারণ মানুষের” বিরুদ্ধে চলে গেছে।
সেই রাতেই অনলাইনে বড় বড় সমাবেশের ডাক ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে আশ্রয়প্রার্থীদের হোটেলগুলোই ব্রিটেনজুড়ে উত্তেজনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে—যেখানে মিছিল, হাতাহাতি এমনকি কখনো সহিংসতাও দেখা দিচ্ছে। আন্দোলনকারীরা দাবি করে তারা স্থানীয় জনগণের পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—তাদের আসল স্বার্থে কারা লাভবান হচ্ছে?
সাজানো ক্ষোভ:
ঘটনার ধরণ এখন অনেকটাই স্পষ্ট। ২০২৪ সালের সাউথপোর্ট দাঙ্গাই এর বড় প্রমাণ। একটি মিথ্যা গুজব—যে নাকি একজন শরণার্থী শিশুদের নাচের ক্লাসে ছুরি মেরেছে—সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ জানায়, খবরটি পুরোপুরি ভুয়া। কিন্তু তার আগেই মসজিদ ও হোটেলে হামলা হয়ে গেছে।
এটাই আসল কৌশল। ব্রিটেইন ফার্স্ট এবং হোমল্যান্ড নামের ডানপন্থী সংগঠন, আর টমি রবিনসনের মতো চেহারাগুলো দ্রুত এসব গুজবকে ধরে, অনলাইনে বড় করে ছড়ায় এবং রাস্তায় নামিয়ে আনে। দেখলে মনে হয় স্বতঃস্ফূর্ত রাগ, আসলে তা অনেক সময় পূর্বপরিকল্পিত।
মিডিয়া ও রাজনীতির জ্বালানি:
ব্রিটিশ মিডিয়া ও রাজনীতি এই কৌশলকে আরও সফল করে তোলে। পত্রিকার চটকদার শিরোনাম কিংবা অনলাইন ক্লিকবেইট—সবখানেই অভিবাসনবিরোধী গল্প বিক্রি হয় সহজে। আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে জড়িত কোনো অপরাধ হলে তা বারবার তুলে ধরা হয়, অথচ একই অপরাধ যদি ব্রিটিশ নাগরিক করে তবে সে খবর প্রায় অদৃশ্য থেকে যায়।
রাজনৈতিকভাবে, রিফর্ম ইউকে দলের উত্থান অভিবাসনবিরোধী বক্তব্যকে মূলধারায় টেনে এনেছে। “বাসস্থান নেই, হাসপাতাল ভিড়, মজুরি কম—সবকিছুর জন্য শরণার্থীই দায়ী”—এই সহজ স্লোগান জনরোষকে উসকে দিচ্ছে।
ইসলামভীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব:
বিশেষত মুসলিম শরণার্থীদের “অসংস্কৃত, একীভূত হতে অক্ষম” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটি ব্রিটিশ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীর্ঘদিনের ইসলামভীতিকে প্রতিফলিত করে।
শুধু দেশীয় নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও আছে। কিছু ডানপন্থী নেতা প্রকাশ্যে ইসরায়েলপন্থী অবস্থান নিয়েছেন এবং মুসলিম—বিশেষত ফিলিস্তিনিদের—অস্তিত্বগত হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এর ফলে বোঝা যায়, আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বৈরিতা কেবল অভ্যন্তরীণ সংকট নয়, আন্তর্জাতিক আদর্শগত লড়াইয়েরও অংশ।
হারিয়ে যাওয়া মানবজীবন:
শিরোনাম আর হ্যাশট্যাগের ভিড়ে হারিয়ে যায় আসল মানুষগুলো। শরণার্থীরা কেবল সংখ্যা হয়ে যায়—কত নৌকা, কত হোটেল, কত বিতাড়ন। অথচ প্রতিটি সংখ্যার পেছনে আছে একেকটি গল্প।
ধরা যাক সুদানের ১৯ বছরের এক তরুণের কথা—যে চিকিৎসক হতে চেয়েছিল। পরিবারকে পিছনে রেখে সে পাড়ি দেয় ব্রিটেনে। এখন সে উত্তর ইংল্যান্ডের এক হোটেলেই বন্দি, দিন গুনছে সিদ্ধান্তের জন্য—যেটি তার পুরো ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সে ব্যতিক্রম নয়।
অভিবাসী বনাম অভিবাসী:
অস্বস্তিকর সত্য হলো—শরণার্থী-বিরোধী অবস্থান শুধু ডানপন্থীদের কাছ থেকে আসে না। অনেক পুরোনো অভিবাসীও নতুনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বানাচ্ছে “কঠোর সীমান্তনীতি”র প্রচারে। এতে বোঝা যায় কত দ্রুত স্মৃতি ফিকে হয়—এবং রাগ গিয়ে পড়ে সবচেয়ে অসহায় মানুষের ওপর।
ব্রিটেন কোন পথে?
শেষমেশ, এসব বিক্ষোভ হোটেল বা আদালতের রায় নিয়ে নয়—বরং একটি গভীর প্রশ্ন নিয়ে: কেমন ব্রিটেন গড়ে উঠছে? এক পথ অতীত সাম্রাজ্যের নস্টালজিয়ায় আটকে থেকে জাতীয় পরিচয়কে নির্ধারণ করে বাদ দেওয়ার নীতিতে। আরেক পথ স্বীকার করে যে বৈচিত্র্যই ব্রিটেনের শক্তি—স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ব্যবসা, সংস্কৃতি—সবখানেই অভিবাসীরা অবদান রেখেছে।
আজ আসল বিপদ হলো—মিথ্যা ও ভয়ের রাজনীতি যেন সত্যিকেই ঢেকে না ফেলে। এর বিকল্প কঠিন হলেও প্রয়োজনীয়: মিথ্যার জবাব দিতে হবে তথ্য দিয়ে, ভয়ের রাজনীতির জবাব দিতে হবে ন্যায়ের রাজনীতিতে। শরণার্থীরা হুমকি নয়—সুযোগ। সুযোগ, যা তাদের দিলেই তারা সমাজে অবদান রাখতে সক্ষম। -আদনান হুমায়দান

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button