গাজায় ত্রাণ ফেলা: শুধুমাত্র প্রতীকী তৎপরতা!
গাজায় ক্ষুধার কারণে ফোলা চোখ, পাঁজরের হাড় বের হয়ে যাওয়া মানুষ এবং শিশুদের কান্না এখন আর বিরল দৃশ্য বা শব্দ নয়; বরং তা নিত্যনৈমিত্তিক। কিন্তু এই দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবের কারণে নয়; বরং তা রাজনীতি, অবরোধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সহায়তা আটকে দেওয়ার ফল।
আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলা গাজার ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য সামান্য স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু এর পেছনে আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। পশ্চিমা সরকারগুলো—যাদের অনেকেই পুরো সংঘাত জুড়ে ইসরায়েলকে সমর্থন করে এসেছে—এমন প্রতীকী পদক্ষেপের মাধ্যমে বাড়তে থাকা সমালোচনা এড়ানোর চেষ্টা করছে।
আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলার মাধ্যমে তারা মানবিক উদ্বেগ প্রদর্শন করতে পারে, অথচ এড়িয়ে যেতে পারে সেই অস্বস্তিকর সত্যকে যে তাদের মিত্রদের নীতিই ব্যাপক দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসাথে, এই পদ্ধতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে সুযোগ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে ছাড় দেওয়ার মতো করে ত্রাণ প্রদর্শন করতে, যেন তা ইসরায়েলের সরাসরি অনুমোদিত কার্যক্রম নয়।
মাসের পর মাস নেতানিয়াহু তার মন্ত্রিসভার কট্টর-ডানপন্থী সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে নিজেকে একীভূত করেছেন—একদিকে ক্ষমতাসীন জোট ধরে রাখার জন্য, অন্যদিকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে। এই বিশ্বাস তার দলের নির্বাচনী জোটে প্রতিফলিত হয়েছে “ইউনিয়ন অব রাইট-উইং পার্টিজ” ব্যানারের অধীনে ‘জিউয়িশ পাওয়ার’ নামক এক উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে, যার শিকড় নিষিদ্ধ কাহানিস্ট আন্দোলনে।
পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের প্রভাব ব্যবহার করে ইসরায়েলকে গাজার সামরিক অভিযান থামাতে রাজি করাতে দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছে, যদিও মৃত্যুর সংখ্যা ৬০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে—যার মধ্যে রয়েছে ১৬,০০০ এরও বেশি শিশু। মৃত্যু এখন আর শুধু বিমান হামলা বা যুদ্ধক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়; ক্রমবর্ধমান সংখ্যক সাধারণ মানুষ এখন ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে, কারণ খাবার ও মানবিক সহায়তা স্থলে মারাত্মকভাবে সীমিত।
ঐকমত্যে ব্যর্থতা:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন গাজায় ত্রাণ সরবরাহে বাধা অব্যাহত রাখার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, যার মধ্যে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক পদক্ষেপও ছিল।
পরে ইইউ-এর পররাষ্ট্র কমিশনার কায়া কাল্লাস ঘোষণা করেন যে কূটনৈতিক আলোচনার পর ইসরায়েল ত্রাণ বণ্টন বাড়ানোর কিছু পদক্ষেপ নিতে সম্মত হয়েছে। তবে এই ঘোষণার পরও মানবিক প্রবেশাধিকার মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে এবং সঙ্কট লাঘবে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।
মানবাধিকার সংস্থা ও ত্রাণ কর্মকর্তারা স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন যে গাজায় খাদ্য ও মানবিক সহায়তার সংকট কোনো লজিস্টিক সমস্যার কারণে নয়; বরং এটি ইচ্ছাকৃত নীতির ফল।
যখন বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা হচ্ছে অথচ হাজারো ট্রাক সীমান্তে আটকে রয়েছে—এটি একটি ভয়ঙ্কর বিরোধাভাস প্রকাশ করে: দুর্ভিক্ষ এড়ানোর উপায় আছে, কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই।
একজন ইসরায়েলি সেনা হুইসেলব্লোয়ার প্রকাশ করেছেন যে ইসরায়েলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে প্রায় ১,০০০ ত্রাণবাহী ট্রাক ধ্বংস বা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি নাগরিকদের ত্রাণ সামগ্রীবাহী গাড়ি বহর আটকানো এবং ত্রাণবাহী চালান নষ্ট করতে দেখা গেছে।
এমন পদক্ষেপকে শক্তিশালী করেছে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের প্রকাশ্য বক্তব্য। যুদ্ধের শুরুর দিকে সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট গাজায় “সম্পূর্ণ অবরোধ” ঘোষণা করে বলেছিলেন, “এখানে কোনো বিদ্যুৎ থাকবে না, কোনো খাবার থাকবে না, কোনো পানি থাকবে না, কোনো জ্বালানি থাকবে না।”
অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ, যিনি কট্টর-ডানপন্থী জোটের প্রধান ব্যক্তিত্ব, বলেছিলেন গাজার নাগরিকদের ক্ষুধায় রাখা “ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিক হতে পারে” যতক্ষণ না জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় “এটি মেনে নেবে না”।
২০২৫ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ মানবিক সীমাবদ্ধতাকে চাপ প্রয়োগের বৈধ উপায় বলে বর্ণনা করেন, আর জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গাভির প্রকাশ্যে ক্ষুধার খবর অস্বীকার করেন।
বর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল সরকার মানবিক প্রবেশাধিকার বাড়াতে সম্মত হয়। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্য সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, নেতানিয়াহুর পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “ওই শিশুদের খুব ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে”—যা ছিল বিশ্বব্যাপী ক্ষোভের মধ্যে একটি বিরল উদ্বেগ প্রকাশ।
কিন্তু স্থলপথে ক্রসিং খোলার পরিবর্তে পশ্চিমা মিত্ররা সমর্থন দেয় আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলার প্রচারণায়—যা বর্তমানে জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নেতৃত্ব দিচ্ছে।
কিন্তু এই পদ্ধতি বিপজ্জনক ও অপর্যাপ্ত প্রমাণিত হয়েছে। আকাশ থেকে পড়ে আসা প্যালেট অনেক সাধারণ মানুষকে আঘাত করেছে, আর প্রতিটি বিমান সাধারণত এক ট্রাকের সমপরিমাণ ত্রাণ নামায়—যা দৈনিক প্রয়োজনীয় ৫০০ ট্রাকের তুলনায় নগণ্য।
ইউএনআরডব্লিউএ কমিশনার-জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি জানিয়েছেন, মিশর ও জর্ডানে বর্তমানে ৬,০০০ এরও বেশি ট্রাক ছাড়পত্রের অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ বিমান থেকে ত্রাণ ফেলার মাধ্যমে যে বাস্তবতা প্রকাশ পাচ্ছে তা হলো: দুর্ভিক্ষ এড়ানোর উপায় রয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই।
নতুন প্রতিষ্ঠান ও সমালোচনা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল দাবি করছে হামাস মানবিক ত্রাণ লুট করছে। এর জবাবে তারা নতুন একটি সংস্থা গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন ( জিএইচএফ) গঠন করে, যা ডেলাওয়্যারে নিবন্ধিত।
এটি ইউএনআরডব্লিউএ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-এর মতো প্রতিষ্ঠিত সংস্থার বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
কিন্তু জিএইচএফ-এর কার্যক্রমকে ঘিরে সমালোচনা বাড়ছে—শুধু প্রচলিত ত্রাণচ্যানেলকে পাশ কাটানোর জন্য নয়, বরং এর মরণঘাতী পরিণতির জন্যও। জাতিসংঘ জানিয়েছে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে প্রায় ৯০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন খাবারের জন্য ভিড় জমাতে গিয়ে—যার বেশিরভাগই জিএইচএফ-এর বিতরণকেন্দ্রের কাছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর সতর্ক করেছে যে এই মৃত্যুগুলো জিএইচএফ-এর সরবরাহ ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করছে, যা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমর্থনে চলছে।
এদিকে হামাস কর্তৃক এইড ডাইভারশন বা লুটপাটের অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ইউএসএইড-এর সাম্প্রতিক মূল্যায়ন ও ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বক্তব্য এ বিষয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত কোনো নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা দেখায় হামাস পরিকল্পিতভাবে মানবিক সহায়তা লুট করছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, নতুন রাজনৈতিক সংস্থা যেমন জিএইচএফ-এর উপর নির্ভর করা মানবিক সহায়তার দুটি মূল নীতি—দক্ষতা ও নিরপেক্ষতাকে—হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
প্রকৃত সমাধান:
প্রতীকী পদক্ষেপ কোনো প্রকৃত সহায়তার বিকল্প হতে পারে না। সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো পরীক্ষিত মানবিক সংস্থাগুলোকে আবারও প্রবেশাধিকার দেওয়া।
ইউএনআরডব্লিউএ এবং ও ডব্লিউএফপি-এর মতো সংস্থাগুলো কয়েক দশক ধরে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহ করে আসছে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া গাজার মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর পথ এবং অভিনয়ধর্মী প্রতিক্রিয়া থেকে সরে এসে প্রকৃত জবাবদিহি ও জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপ নেওয়ার উপায়। -ইয়াদ ইউসুফ, একজন সিরিয়ায় জন্মগ্রহণকারী অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়াবলীতে মনোনিবেশ করেন। তিনি সিরিয়ায় প্রায় দুই বছর একটি মানবিক সহায়তা সংস্থার নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন, চ্যাথাম হাউস ও অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল–এ প্রবন্ধ লিখেছেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



