যুক্তরাজ্যে মুসলিম চ্যারিটিগুলো বৈষম্যের শিকার
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দুইটি দাতব্য সংস্থা—ক্যাসনার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট এবং ইউকে তোরেমেট—২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৫.৭ মিলিয়ন পাউন্ড (৭.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) দান করেছে পশ্চিম তীরের অধিকৃত ইসরাইলী বসতি সুশিয়া অঞ্চলে অবস্থিত একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়ে, যা গার্ডিয়ানের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন এবং যুক্তরাজ্যের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই বসতি অবৈধ। এই অর্থায়ন বনে আকিভা ইয়েশিভা উচ্চ বিদ্যালয়ের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে এবং সুশিয়া বসতিতে এটিকে একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এই ঘটনা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং মানবাধিকার কর্মীদের কাছ থেকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে, যারা যুক্তি দিচ্ছেন যে দাতব্য মর্যাদা এমন সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয় যারা আন্তর্জাতিক আইনকে দুর্বল করতে পারে এমন বসতিতে অর্থ প্রবাহিত করে।
আরও বিস্ময়কর বিষয় হলো, পুরো বিতর্কিত প্রক্রিয়াটি যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থা নিয়ন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছে। চ্যারিটি কমিশন অনুমোদন দিয়েছে এই দানগুলোকে এই যুক্তিতে যে অধিকৃত অঞ্চলে অবস্থিত একটি বিদ্যালয়ে অনুদান শিক্ষা অগ্রগতির জন্য প্রদত্ত অনুদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এবং তাই এটি “বৈধ” দাতব্য কার্যক্রম।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্পষ্ট করেছে যে অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে একটি দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করা নিজেই কোনো অপরাধ বা দাতব্য আইনের লঙ্ঘন নয়।
যদিও এই বসতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ এবং যুক্তরাজ্য সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বীকার করে, তবুও দাতব্য সংস্থা নিয়ন্ত্রক এই দানগুলো অনুমোদন করেছে শিক্ষামূলক কারণ দেখিয়ে—যা একটি আইনি পর্যালোচনায় যথাযথভাবে পর্যালোচিত হওয়া উচিত।
এদিকে, এই ঘটনাটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ ও অভিযোগকে আরও দৃঢ় করেছে, বিশেষ করে মুসলিম দাতব্য সংস্থার ক্ষেত্রে।
কঠোর তদারকি:
উপরোক্ত দুটি দাতব্য সংস্থার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রকের আচরণ পশ্চিম লন্ডনের শিয়া মুসলিম কেন্দ্র ‘ইসলামিক সেন্টার অব ইংল্যান্ড’ (আইসেল)-এর সাথে তার আচরণের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। এই কেন্দ্রটি মেইডা ভেল এলাকায় বসবাসরত ইরানি প্রবাসীদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিকভাবে সংযুক্ত এবং বিভিন্ন জাতিগত পটভূমির শিয়া মুসলিমরা এখানে আসেন।
২০২০ সালে, যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা তালিকাভুক্ত ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানির হত্যার পর আয়োজিত এক শোকসভা উপলক্ষে চ্যারিটি কমিশন আইসেলকে সতর্কবার্তা দেয়।
২০২২ সালের নভেম্বরে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রটির বিরুদ্ধে একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে, যেখানে শোকসভা, অনলাইন কনটেন্ট এবং ট্রাস্টিদের সম্ভাব্য স্বার্থের সংঘাতসহ বড় ধরনের প্রশাসনিক উদ্বেগের কথা বলা হয়। তদন্তটি ২০২৫ সালের মে মাসে শেষ হয়, এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসেলের ট্রাস্টিদের বক্তা, ধর্মীয় সেবা, অনুষ্ঠান এবং অনলাইন কনটেন্টের ওপর কঠোর নজরদারি চালানোর নির্দেশ দেয়।
আইসেলের কার্যক্রম ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণকারীদের মধ্যে সাধারণ ধারণা হলো, কেন্দ্রটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সমালোচনামূলক অবস্থানের কারণে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। যদিও নিয়ন্ত্রক সংস্থা তা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেনি, ডানপন্থী গণমাধ্যম প্রায়শই আইসেলকে ইরান সরকারের “নার্ভ সেন্টার” হিসেবে উপস্থাপন করেছে, মূলত আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির সাথে কেন্দ্রটির যোগসূত্রের কারণে। এই বৈষম্য চ্যারিটি কমিশনের দ্বৈত নীতির ইঙ্গিত দেয়, বিশেষত মুসলিম সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে।
আসন্ন এক একাডেমিক প্রতিবেদনে—“দ্য ইসলামিক সেন্টার অব ইংল্যান্ড: আন্ডারস্ট্যান্ডিং ইটস রোল উইদিন মুসলিম কমিউনিটিজ অ্যাক্রস ব্রিটেন”—প্রফেসর অলিভার শারব্রড্ট (লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়) এবং অ্যালিসন স্কট-বাউম্যান (সোয়াস) উল্লেখ করেছেন যে আইসেল আর্থিকভাবে স্বনির্ভর, ইরানি তহবিলের সাথে এর কোনো যোগসূত্র নেই, এবং এটি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে সহায়তায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। প্রতিবেদনে আইসেলের বাসিন্দা ইমামের খামেনির সাথে সম্পর্ক স্বীকার করা হলেও, তাকে রাজনৈতিক প্রতিনিধি নয় বরং স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে নিয়ন্ত্রকের কঠোর বিধিনিষেধ “অনিচ্ছাকৃতভাবে মুসলিমদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সীমিত করতে পারে।”
যদিও সোলেইমানি স্মরণ অনুষ্ঠানের জন্য আইসেলকে সতর্কবার্তা দেওয়ার নিয়ন্ত্রকের যুক্তি গ্রহণ করাও সম্ভব, একটি মৌলিক প্রশ্ন থেকে যায়: কেন অবৈধ বসতিতে—যা জাতিসংঘ ও যুক্তরাজ্য উভয়ের দ্বারাই নিন্দিত—প্রকল্পে অর্থায়ন বৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়, অথচ যা শেষ পর্যন্ত ওই বসতিগুলো সম্প্রসারণ ও স্থায়ীকরণে সহায়তা করে, এবং যা যুক্তরাজ্য সরকার নিজেই বিরোধিতা করে ও নিন্দা জানায়?
এই বৈষম্য দেখায় যে চ্যারিটি কমিশন মুসলিম সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে দ্বৈত মানদণ্ড প্রয়োগ করে।
দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সংস্থাগুলো অভিযোগ করে আসছে যে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি কাঠামোগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট। যেখানে প্রো-ইসরায়েল দাতব্য সংস্থাগুলোর বসতিতে অর্থায়ন অনুমোদিত হয়, সেখানে মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলো প্রায়শই অস্পষ্ট বা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উদ্বেগের ভিত্তিতে অস্বাভাবিক মাত্রার তদন্তের মুখে পড়ে।
সংহতি নীরব করা:
হিউম্যান এইড ইউকে, একটি ব্রিটিশ মুসলিম দাতব্য সংস্থা, ২০১৯ সালে পুলিশের তল্লাশি ও তহবিল জব্দের পর চ্যারিটি কমিশনের দুই বছরের তদন্তের মুখে পড়ে। কয়েক মাস পর অর্থ ফেরত দেওয়া হলেও এবং কোনো অনিয়ম প্রমাণিত না হলেও, নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদন্ত চালিয়ে যায়। এতে হিউম্যান এইড ইউকে নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে মুসলিম দাতব্য সংস্থার প্রতি পক্ষপাত এবং “পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থার হয়রানি নীতির সম্প্রসারণ” হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনে।
২০১২ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত চ্যারিটি কমিশনের ৭৬টি আনুষ্ঠানিক তদন্তের মধ্যে এক-চতুর্থাংশেরও বেশি—২০টি—ছিল মুসলিম দাতব্য সংস্থার বিরুদ্ধে, গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে। এসব তদন্তের অনেকগুলো ছিল মসজিদ পরিচালনা, মানবিক সহায়তা প্রদান, বা সিরিয়ায় কার্যক্রম সম্পর্কিত।
২০১৭ সালের রিঅরিয়েন্ট জার্নালে প্রকাশিত এক একাডেমিক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে কমিশনের কাঠামোগত পরিবর্তন ও কার্যপদ্ধতি মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলোর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে। নিবন্ধে দেখা যায় যে মুসলিম সংস্থাগুলো পুরো খাতের মাত্র ১.২১ শতাংশ হলেও, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকাশিত সকল তদন্তের ৩৮ শতাংশ তাদের বিরুদ্ধে ছিল—যা প্রাতিষ্ঠানিক পক্ষপাতের গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করে।
চ্যারিটি কমিশনের চাপের কারণে আইসেল প্রশাসকরা প্রায়শই আয়োজকদের ইসরায়েলের গাজায় যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা না করতে বা প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি না জানাতে অনুরোধ করতেন, আশঙ্কা করতেন যে এমন কাজগুলো সংস্থার আইনি অবস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম মুসলিম ছাতাসংগঠন, অভিযোগ করে যে কমিশন ফিলিস্তিনকে সমর্থনকারী মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। এর ফলে অভিযোগ উঠেছে যে কমিশন ক্রমশ মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলোকে নীরব করার এবং ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধের শিকারদের সাথে সংহতি প্রকাশ থেকে বিরত রাখার হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
দাতব্য সংস্থা নিয়ন্ত্রককে স্বাধীন এবং “অন্যের প্রভাবমুক্ত” থাকার কথা। কিন্তু উপরের উদাহরণগুলো দেখায় যে এর কর্মকাণ্ড যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রনীতির দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে—যেখানে মুসলিম দেশ বা ইরান সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিরূপতা এবং ইসরায়েল সংশ্লিষ্টদের প্রতি সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায়।
এই রাজনৈতিক প্রভাব জনআস্থা নষ্ট করে এবং সহযােগিতার ঝুঁকি তৈরি করে। মুসলিম দাতব্য সংস্থার ক্ষেত্রে নির্বাচিতভাবে নীতি প্রয়োগ করে কমিশন দাতব্য সততার দাবি করতে পারে না।
মিডল ইস্ট আই-এর প্রশ্নের জবাবে কমিশন বলেছে: “কমিশন পক্ষপাতের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। সমস্ত উদ্বেগ আইনগত কাঠামোর ভিত্তিতে ন্যায়সঙ্গত ও ধারাবাহিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়।” তারা আরও পুনর্ব্যক্ত করেছে যে “আমরা সরকারের কাছ থেকে স্বাধীন।” তবে কেন মুসলিম দাতব্য সংস্থাগুলো অসামঞ্জস্যভাবে অধিক তদন্তের মুখে পড়েছে, তা নিয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
কমিশন আরও বলেছে যে তারা “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে না… দাতব্য সংস্থাগুলো জনসমক্ষে বিবেক বা ধর্মসংক্রান্ত বিষয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতসহ, যতক্ষণ তা সংস্থার উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং সংস্থার স্বার্থে হয়।” তবে ভাষণ, খুতবা বা অন্যান্য বার্তা যেন উত্তেজনাকর বা বিভেদ সৃষ্টিকারী না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ইসরায়েলি বসতির সাথে যুক্ত দুটি দাতব্য সংস্থার বিষয়ে কমিশন বলেছে: “এমন সংস্থাগুলিতে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে, যুক্তরাজ্যের জেনেভা কনভেনশন আইন ১৯৫৭ লঙ্ঘনের মাধ্যমে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আমরা সংস্থার ট্রাস্টিদের আইনি দিকনির্দেশনা ও একটি কর্মপরিকল্পনা দিয়েছি, যেখানে জেনেভা কনভেনশন আইন ১৯৫৭ মেনে চলার গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।”
কিন্তু যদি কমিশন সত্যিই মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে আস্থা পুনর্গঠন করতে চায় এবং সকল ধর্মীয় ভিত্তিক দাতব্য সংস্থার ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত আচরণ প্রমাণ করতে চায়, তবে অবিলম্বে তাদের কার্যপদ্ধতির স্বাধীন পর্যালোচনা শুরু করতে হবে—যাতে প্রকৃত সমতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়। -জাফর এ মির্জা – ধর্ম, রাজনীতি ও অভিবাসন নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বর্তমানে কিংস কলেজ লন্ডনে পিএইচডি প্রার্থী, যেখানে তার গবেষণার বিষয় ব্রিটেনে শিয়া মুসলিমদের বসতি। এছাড়া তিনি ধর্ম, গণতন্ত্র ও দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকার বিষয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাট, ডন, দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল ও দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনসহ বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করেন।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



