যুক্তরাজ্য সরকারের নথিপত্র ইন্টারপ্যাল-এর পুরো কাহিনী তুলে ধরে না

আমি আমের সুলতানের একটি প্রবন্ধ পড়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম, যেখানে টনি ব্লেয়ার সরকার ইসরায়েলি চাপের মুখে ‘দ্য প্যালেস্টিনিয়ানস রিলিফ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফান্ড’—ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা ইন্টারপ্যাল—নিষিদ্ধ না করার বিষয়ে অবস্থান নিয়েছিল। অবশ্য যুক্তরাজ্য সরকারের ফাইলগুলো ইন্টারপ্যাল সম্পর্কে পুরো সত্য তুলে ধরে না। যদিও সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তারা এবং এমনকি কিছু জুনিয়র মন্ত্রী ইন্টারপ্যালের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছিলেন, সরকার দ্বিধাগ্রস্ত ছিল এবং একটি বৈধভাবে নিবন্ধিত দাতব্য সংস্থাকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
আমি ১৯৯৬ সাল থেকে এই সংস্থার একজন ট্রাস্টি এবং ১৯৯৭ সাল থেকে ২০২০ সালে অবসর নেওয়া পর্যন্ত চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমের সুলতান যে সময়কাল তুলে ধরেছেন, সেটি আমি প্রত্যক্ষভাবে কাটিয়েছি। এর অন্যতম প্রধান মুহূর্ত ছিল ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ কর্তৃক ইন্টারপ্যালকে একটি “বিশেষভাবে চিহ্নিত বৈশ্বিক সন্ত্রাসী সংস্থা” হিসেবে তালিকাভুক্ত করা।
এই সংবাদটি আমরা অনলাইনে পড়ে জানতে পারি, কারণ মার্কিন প্রশাসনের কেউই আমাদের জানাতে প্রয়োজন মনে করেনি যে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হঠাৎ একগুচ্ছ ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তাদের সম্পদ জব্দ করছেন। এখানে “অভিযোগ” শব্দটির দিকে খেয়াল করুন। এর পেছনে কোনো প্রমাণ বা বিচারিক প্রক্রিয়া ছিল না। ইসরায়েল শুধু একটি তালিকা দিয়েছিল যাদের তারা অভিযুক্ত করতে চায়, আর বুশ তাতে সায় দেন। আমি যখন ২০০৩ সালের ২২ আগস্ট বিবিসি-র ওয়েবসাইটে এটি পড়ি, তখনই প্রথম জানি যে “দ্য প্যালেস্টিনিয়ানস রিলিফ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, বা ইন্টারপ্যাল, ব্রিটেনে অবস্থিত” সংস্থাটি সেই তালিকায় রয়েছে।
বলা বাহুল্য, আমি হতবাক হয়েছিলাম। সেই দিন থেকে আজ পর্যন্ত, এমন গুরুতর অভিযোগ সত্ত্বেও—যার ফলে ইন্টারপ্যাল স্বাভাবিক ব্যাংকিং সুবিধা হারায়, যা একটি দাতব্য সংস্থার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়—মার্কিন বা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কখনোই এই অভিযোগের পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করেনি। মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই এই “সন্ত্রাসবাদ” তকমাকে অগ্রাহ্য করেন। এমনকি একজন অ-মুসলিম ইমেইলে লেখেন, “যদি জর্জ বুশ আপনাদের সন্ত্রাসী তালিকায় রাখেন, তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই ভালো কাজ করছেন। তাই আমি অনুদান পাঠাচ্ছি।” এবং তিনি পাঠিয়েছিলেন। এমনকি আমরা একজন অজ্ঞাতনামা ইহুদি দাতার কাছ থেকেও দুটি বড় অংকের অনুদান পেয়েছিলাম। অর্থপাচারের সন্দেহে আমরা ঐ টাকা চারিটি কমিশন এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে রিপোর্ট করি, যারা সেটি গ্রহণের অনুমতি দেয়।
নিবন্ধনের পর থেকেই ডানপন্থী গণমাধ্যম বারবার ইন্টারপ্যাল সম্পর্কে অভিযোগ তুলেছে। একবার বলা হয়েছিল, আমরা হামাসকে ১০০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছি। আরেকটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, আমরা হামাসের কাছ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার চুরি করেছি। অথচ তখন ইন্টারপ্যালের বার্ষিক গড় আয় ছিল প্রায় ৩ মিলিয়ন পাউন্ড, যা পয়সা পয়সা হিসাবের মধ্যে ছিল। এসব অভিযোগের অবাস্তবতা সেই মিডিয়াগুলোর নজরে আসেনি।
মার্কিন এই তালিকাভুক্তি যুক্তরাজ্যের চ্যারিটি কমিশনকে ইন্টারপ্যালের ওপর তদন্ত চালাতে বাধ্য করেছিল। তবে তারা আমাদের বিরুদ্ধে কোনো অবৈধ কার্যকলাপের প্রমাণ পায়নি। আমরা সবসময় কমিশনের তদন্তকে স্বাগত জানিয়েছি, এবং বিশ্বাস করতাম এতে আমাদের নীতিমালা ও কার্যপদ্ধতি আরও শক্তিশালী হয়েছে যাতে কোনো অনুদান অপব্যবহার না হয়।
তবুও, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ ইন্টারপ্যালকে তালিকা থেকে সরায়নি। তারা যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল, আমাদের মার্কিন আইনজীবী জানতে চাইলেন, আমি আমেরিকায় নামার পর আটক বা তলব হব কি না। ট্রেজারি বলল, “আমাদের আইনজীবীদের এতে সমস্যা আছে।” আমরা প্রস্তাব দিলাম তারা চাইলে যুক্তরাজ্যে এসে আমাদের ১৯৯৪ সাল থেকে সমস্ত নথি পর্যালোচনা করতে পারে। তারা বলল, “আমরা ওভাবে কাজ করি না।”
অবশেষে, অফ দ্য রেকর্ড, আমাদের নিউ ইয়র্কের আইনজীবীর মাধ্যমে তারা জানায়, এই সিদ্ধান্তটি এসেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে। “এটি সম্পূর্ণ একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল এবং তা বাতিল করতেও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।” যা কখনোই বাস্তবে হবে না।
এই অবস্থায় ইন্টারপ্যাল বছরের পর বছর “সন্ত্রাসী সত্তা” তকমা নিয়েই কাজ করেছে, এবং তবুও একটি একমুখী লক্ষ্যসম্পন্ন দাতব্য সংস্থা হিসেবে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করে গেছে। চেয়ার হিসেবে আমি বিশ্বব্যাপী সফর করেছি—যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা (তালিকাভুক্তির আগে), ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও নিউজিল্যান্ড। আমি রাজপরিবার, মন্ত্রীদের সাথে দেখা করেছি এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে দেশ-বিদেশে বক্তব্য রেখেছি। সত্যিই যদি কোনো ভিত্তি থাকত ইসরায়েল-মার্কিন অভিযোগে, তাহলে কি এসব সম্ভব হতো? এক সিনিয়র স্পেশাল ব্রাঞ্চ কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল, “ইন্টারপ্যালের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশি হস্তক্ষেপ না থাকা নিজেই একটি বড় বার্তা।”
আমাদের ছোট্ট সংস্থাটি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সমর্থন পেয়েছিল—রাজনীতিবিদ, সার্জন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, অধিকারকর্মী—সবাই ইন্টারপ্যালের বন্ধু ছিলেন। তারা জানতেন, আমাদের সাহায্য কেমন পরিবর্তন এনে দেয় শরণার্থী শিবিরে থাকা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের জীবনে। রাজনৈতিক কারণে আমরা সিরিয়ার শিবিরগুলো এড়িয়ে চলতাম।
ইন্টারপ্যাল এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় কাজ করছিল, যেখানে আমাদের সরাসরি রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিষিদ্ধ ছিল। আমাদের অনেক সময় ও সম্পদ ব্যয় হতো সন্ত্রাসবাদী অভিযোগ খণ্ডনে, যা ডানপন্থী মিডিয়া বারবার ছড়াতো—এতে আমাদের আসল কাজ, অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করা, ব্যাহত হতো।
দাতব্য সংস্থাটির শুরুর দিকে ছিল আশাবাদী সময়, যখন অসলো চুক্তিকে অনেকেই সম্ভাবনার আলো হিসেবে দেখতেন। তারপর এল ভুল তথ্য, অপবাদ, আবার মানুষের সমর্থন। ইন্টারপ্যালের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা ছোট উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পরিণত হয়েছে অনেক শিবির এবং দরিদ্র সম্প্রদায়ের জন্য মূল ভিত্তিতে—স্কুল, ক্লিনিক, কর্মসংস্থান প্রকল্প, বিশ্ববিদ্যালয়—সবই ইন্টারপ্যালের অনুদানে নির্মিত এবং স্থানীয়দের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিল। গাজায়, এসব প্রকল্পের অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর হামলায়। এমনকি ইন্টারপ্যালের গাজা অফিস ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পরপরই ইসরায়েলি বোমার প্রথম লক্ষ্যবস্তু ছিল।
এক সময় যেখানে আমরা ছিলাম গুটিকয়েক আন্তর্জাতিক এনজিওর একটি, সেখানে এখন অনেকেই এসেছে। অনেক সময় দেখা যেত, আমাদের সহায়তাপ্রাপ্ত প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএইড-এর মতো অন্য এনজিওদের লোগোও দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ, যেসব প্রকল্পে ইন্টারপ্যাল কাজ করেছে, সেগুলোর অনেকগুলোতেই মার্কিন সরকারও অর্থায়ন করেছে—তবুও তারা আমাদের “সন্ত্রাসী সত্তা” বলেছে। বাস্তবতা কতটা অসঙ্গত তা এখানেই স্পষ্ট। আমরা ইউএনআরডবলিউএ’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতাম, তাদের হোস্ট ও দাতাদের বৈঠকেও অংশ নিয়েছি, যেখানে রাষ্ট্র প্রতিনিধিরাও থাকতেন। একবার আমাকে বক্তৃতার সুযোগ দেওয়ার পর মার্কিন প্রতিনিধিরা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
তবে আমাদের ফান্ড সংগ্রহ ও বিতরণের সময় আমরা রাজনীতি থেকে দূরে থেকেছি। ইন্টারপ্যালের ট্রাস্টি ও কর্মীরা সর্বদা চেষ্টা করেছেন সংস্থার অরাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণ করতে এবং ফিলিস্তিনিদের যতটা সম্ভব সহায়তা দিতে। রাজনীতিবিদরা আসেন-যান, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রয়োজন দিন দিন বেড়েছে—অধিকাংশ সময় সেই রাজনীতিবিদদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই, যারা চাইলে পরিস্থিতি পাল্টাতে পারতেন কিন্তু করেননি।
আজ আমরা এমন এক গণহত্যার সাক্ষী, যেখানে ৬০,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধের তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘতর হচ্ছে।
ইন্টারপ্যাল ও এর ট্রাস্টিদের নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে—কিছু সত্য, অনেক কিছু মিথ্যা। আমরা আমাদের কাহিনী ২০১৯ সালে প্রকাশ করেছি—’বিশ্বাস, আশা ও দাতব্য’ শিরোনামে। উদ্দেশ্য ছিল, পাঠকেরা যেন নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন ইসরায়েল-মার্কিন অভিযোগ কতটা সত্য বা মিথ্যা।
আমরা আরও চেয়েছি পাঠকেরা যেন বুঝতে পারেন মাঠপর্যায়ে ইন্টারপ্যালের কর্মীরা কী ধরনের কাজ করতেন, কেমন করে তারা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতেন। মার্কিন তকমা সত্ত্বেও সংস্থাটি এগিয়ে গেছে, যা আমাদের কর্মী ও সমর্থকদের নিবেদিত প্রচেষ্টা এবং সেইসব ভিত্তিহীন অভিযোগের বিরুদ্ধে আমাদের নৈতিক জয়ের প্রমাণ।
আমি গর্বিতভাবে বলেছিলাম, জর্জ বুশ এখন সাবেক প্রেসিডেন্ট, অথচ আমি তখনও ছিলাম ইন্টারপ্যালের চেয়ার—যে দাতব্য সংস্থাকে তিনি ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন তার জায়নিস্ট প্রভুদের খুশি করতে।
আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন আর ইন্টারপ্যালের মতো এনজিও প্রয়োজন হবে না, কারণ তখন ফিলিস্তিনিরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ভূমিতে বাস করছে। কিন্তু এখন, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি প্রয়োজন রয়েছে মানবিক সহায়তার—ইসরায়েলি দখলে থাকা জমিতে বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য। -ইব্রাহিম হিউইট

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button