শান্তি পুরস্কারের প্রহসন: একনায়কেরা যখন আরেক একনায়ককে মনোনীত করে
বিশ্ব রাজনীতিতে কিছু কিছু মুহূর্ত এতটাই নির্লজ্জ ও ধৃষ্টতাপূর্ণ যে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও হার মানে। এমনই এক মুহূর্ত এসেছে: বিশ্বের দুই বিতর্কিত নেতা—ইসরায়েলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও পাকিস্তানের জেনারেল আসিম মুনির—একত্র হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তির নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন। বিশ্বাস করুন বা না করুন, একজন যুদ্ধবাজকে দুইজন সামরিক একনায়ক শান্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। জর্জ অরওয়েল, তোমার লেখাকে হার মানাল বাস্তবতা।
কিন্তু বিষয়টিকে কৌতুক ভেবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এটা নিছক হাস্যকর নয় বরং এক ধরনের রাজনৈতিক আনুগত্যের আনুষ্ঠানিকতা, যেখানে ক্ষমতাকে চাটুকারিতা দিয়ে সম্মানিত করা হয়, সাম্রাজ্যবাদকে পুরস্কৃত করা হয়, আর ‘শান্তি’ শব্দটিকে বিকৃত করে এর অর্থবোধকে ধ্বংস করা হয়।
নেতানিয়াহুর রক্তমাখা মনোনয়ন:
নেতানিয়াহুর প্রসঙ্গ তুলতে গেলে অনেক বলার থাকে। তিনি গাজার উপর নিরবচ্ছিন্ন গণহত্যামূলক হামলা চালিয়েছেন, পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন বাড়িয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের জীবন ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাঁর শাসনামলে ইসরায়েল সুস্পষ্টভাবে একটি বর্ণবাদী, ঘেরাটোপযুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে।
তবুও তিনিই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তির পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিচ্ছেন। কেন? কারণ ট্রাম্পই তো জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, ফিলিস্তিনি স্বাধিকার আন্দোলনকে কার্যত মুছে দিয়েছেন, এবং অবাধে ইসরায়েলি আগ্রাসনকে অনুমোদন দিয়েছেন। ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ নামে পরিচিত তথাকথিত শান্তি চুক্তিগুলো আসলে ছিল অস্ত্র বিক্রি, নজরদারি প্রযুক্তি আর জনপ্রিয় প্রতিরোধের প্রতি ঘৃণার বিনিময়ে করা লেনদেন।
মুনিরের খাকি ষড়যন্ত্র:
নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্য স্পষ্ট হলেও, জেনারেল আসিম মুনিরের উদ্দেশ্য কিছুটা ঘোলাটে। পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে পদদলিত করে, রাজনৈতিক কর্মীদের গুম করে, বিরোধীদের দমন করে তিনি নিজেকে কেবল একজন সেনাপ্রধান নয়, বরং আমেরিকার অনুগত এক ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছেন।
তিনি ট্রাম্পের প্রশংসা করছেন দক্ষিণ এশিয়ায় ‘শান্তি প্রতিষ্ঠায়’ অবদান রাখার জন্য। কিন্তু আসলে এই প্রশংসা একধরনের কৌশলী তোষামোদি, যাতে ভবিষ্যতের ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে অনুগ্রহ লাভ করা যায়।
ট্রাম্প: ‘মেনুফ্যাকচার্ড পিস’-এর মাসকট:
যাকে ঘিরে এই সার্কাস, তিনি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প—যাঁর ‘শান্তি’ নিয়ে ধারণা তাঁর রঙিন ত্বকের মতোই কৃত্রিম। তিনি ইরান চুক্তি বাতিল করেছেন, প্রায় যুদ্ধের মুখোমুখি এনেছেন বিশ্বকে, মোদিকে উসকে দিয়েছেন কাশ্মীরে আগ্রাসনের জন্য, আর ফিলিস্তিনে গণহত্যাকে ‘শান্তির কূটনীতি’ হিসেবে বৈধতা দিয়েছেন। তাঁর বহুল প্রচারিত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ ছিল একাধিক স্বৈরশাসকের মধ্যে গোপন সমঝোতা—ফিলিস্তিনিদের অধিকার বিক্রি করে আঞ্চলিক অস্ত্র বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা।
শান্তির নামে গ্যাংস্টার রাজনীতি:
তাহলে প্রশ্ন আসে—এই পুরস্কার কেন? কারণ আজকের বিশ্বে নোবেল শান্তি পুরস্কার হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মুদ্রা। এর মাধ্যমে স্বৈরশাসকদের বৈধতা দেওয়া হয়, যুদ্ধাপরাধকে ধোয়ামোছা করে ‘কূটনীতি’র নামে পুনর্গঠিত করা হয়।
নেতানিয়াহু চায় ভবিষ্যত ট্রাম্প সরকারের কাছ থেকে আরও সমর্থন। মুনির চায় তাঁর ক্ষমতা ধরে রাখতে ট্রাম্পের আনুগত্য। আর ট্রাম্প চায় একটি পুরস্কার—যেকোনো পুরস্কার, যা প্রমাণ করবে তিনি শুধু একাধিক মামলার আসামি নন, বরং ‘বিজয়ী’।
গণতন্ত্র ও মর্যাদার ওপর হামলা:
এই মনোনয়ন প্রহসনের আসল শিকার কারা? পাকিস্তানে, যেখানে গণতন্ত্র প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। ফিলিস্তিনে, যেখানে প্রতিরোধকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ইমরান খান এখনো বন্দি—শুধু এই অপরাধে যে তিনি সেনাবাহিনীর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
ফিলিস্তিনে ‘শান্তির’ নামে চলছে বোমা বর্ষণ, খাদ্য অবরোধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত। আর এই সময়েই ট্রাম্প শান্তির দূত হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছেন!
শেষ অপমান:
শান্তি পুরস্কার একসময় ছিল আশার প্রতীক। এখন তা হয়ে উঠেছে এক নির্লজ্জ প্রহসন। নেতানিয়াহু ও মুনির কেবল একজন অনুপযুক্ত মানুষকে মনোনয়ন দেননি বরং ‘শান্তি’ শব্দটির মানেই পাল্টে দিয়েছেন। এটা নিছক দ্বিচারিতা নয়। এটা দুনিয়াজুড়ে নিপীড়িতদের মুখের উপর থুতু দেওয়ার মতো।
প্রতিবাদের সময় এখন: তাহলে আমাদের করণীয় কী?
আমাদের উচিত শান্তির আড়ালে ক্ষমতার এই নাটককে প্রত্যাখ্যান করা। আমাদের উচিত পাকিস্তানে সামরিক একনায়কতন্ত্র, ফিলিস্তিনে বর্ণবাদী আগ্রাসন, ও আমেরিকায় ফ্যাসিবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে একত্র হয়ে লড়াই করা। কারণ এই সংগ্রামগুলো আলাদা নয়, তারা একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
যখন একনায়কেরা একে অপরকে পুরস্কৃত করে, তখন এটা শক্তির নয়, বরং ভয়ের প্রতীক। তারা জানে, মানুষ জেগে উঠছে। তারা জানে, ইতিহাস সব কিছু মনে রাখে।
সুতরাং, তারা যাক মনোনয়ন দিতে। তারা যাক একে অপরের প্রশংসা করতে। ইতিহাস মনে রাখবে, কে অন্যায় করেছিল—আর কারা প্রতিবাদ করেছিল। -জুনায়েদ এস. আহমদ, প্রফেসর জুনায়েদ এস. আহমদ আইন, ধর্ম এবং বৈশ্বিক রাজনীতি বিষয়ে শিক্ষকতা করেন এবং ইসলামাবাদ, পাকিস্তানে অবস্থিত সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ইসলাম অ্যান্ড ডিকোলোনাইজেশন (CSID)-এর পরিচালক। তিনি আন্তর্জাতিক ন্যায়ের আন্দোলন (International Movement for a Just World), নাকবা থেকে মুক্তির আন্দোলন (Movement for Liberation from Nakba), এবং মানবতা ও পৃথিবী রক্ষার আন্দোলন (Saving Humanity and Planet Earth)-এর সদস্য।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



