গাজায় গণহত্যা: একটি লাভজনক ব্যবসা

ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ, যিনি জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিনে মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক, ‘ক্ষমতা’র মুখোমুখি হয়ে সত্য বলার সাহসিকতার প্রতীক। এই “ক্ষমতা” কেবল ইসরায়েল বা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বোঝায়, যাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা গাজার চলমান গণহত্যা থামাতে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়েছে। ৩ জুলাই জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে জমা দেওয়া তাঁর সর্বশেষ প্রতিবেদন ‘অকুপেশনের অর্থনীতি থেকে গণহত্যার অর্থনীতি’ একটি প্রভূত গুরুত্ব বহনকারী হস্তক্ষেপ। এই প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে নাম প্রকাশ করে এবং সেইসব কোম্পানিগুলোর ভূমিকা তুলে ধরে যারা ইসরায়েলের যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যা চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছে, এমনকি যারা নীরব থেকেছে তাদেরকেও। আলবানিজের এই প্রতিবেদন কেবল একটি একাডেমিক অনুশীলন বা নৈতিক বিবৃতি নয়—বিশ্ব যেখানে গাজার বর্বরতা সামনে রেখে বিবেকের চরম পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে—এই প্রতিবেদন অনেক বেশি কিছু। এটি কূটনৈতিক ও আইনি বাগাড়ম্বর ছাড়িয়ে জবাবদিহিতার বাস্তব পথ নির্দেশ করে। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি এটি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থাপন করে, যেখানে আইনকে কেবল রাজনৈতিক ভারসাম্য নয়, বরং যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার বিরুদ্ধে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে এবং গাজার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক কাঠামোর ব্যর্থতাও প্রকাশ পায়।
এই প্রতিবেদনের গুরুত্ব বুঝতে দুটি প্রেক্ষাপট জরুরি, যা ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা এবং সামগ্রিক বসতি ঔপনিবেশিক প্রকল্পে কর্পোরেট সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে এক কড়া অভিযোগপত্র। প্রথমত, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বহু বছর বিলম্বের পর, জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল এমন একটি ডেটাবেইস প্রকাশ করে যেখানে ১১২টি কোম্পানির নাম তালিকাভুক্ত করা হয় যারা অধিকৃত ফিলিস্তিনের বেআইনি ইসরায়েলি বসতিতে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে জড়িত। এই ডেটাবেইসের মাধ্যমে এয়ারনব, বুকিং ডট কম, মটোরোলা সলিউশন্স, জেসিবি এবং এক্সপাডিয়া-র মতো বড় কোম্পানিগুলোর নাম উঠে আসে যারা ইসরায়েলের সামরিক দখলদারি ও বর্ণবাদের ধারাকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। এই ঘটনা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ জাতিসংঘ বরাবরই ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে বা তাদের সহযোগীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেনি। এই তালিকা নাগরিক সমাজকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সংগঠিত হতে সহায়তা করে, যার ফলে কোম্পানি এবং বিভিন্ন সরকারদের নৈতিক অবস্থান নিতে চাপ সৃষ্টি করা যায়। এই কৌশল কতটা কার্যকর ছিল, তা বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অতিমাত্রায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া থেকে—যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল এটি একটি “অবিশ্বস্ত” কাউন্সিলের পক্ষ থেকে “অর্থনৈতিক প্রতিশোধকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা”, আর ইসরায়েল একে বলেছিল “চাপের কাছে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ”।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া গাজার ইসরায়েলি গণহত্যা দেখিয়েছে যে জাতিসংঘের বিদ্যমান সকল কাঠামো কতটা ব্যর্থ—এমনকি একটুখানি খাদ্য সহায়তা পৌঁছাতেও ব্যর্থ। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরেই বলেন, “বিশ্ব গাজার মানুষকে ব্যর্থ করেছে।” এই ব্যর্থতা আরও বহু মাস ধরে চলেছে এবং জাতিসংঘের পক্ষ থেকে গাজায় সহায়তা বিতরণ পরিচালনায়ও ব্যর্থতা দেখা গেছে, যখন তারা দায়িত্ব দেয় তথাকথিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামের এক ভাড়াটে সহিংস সংগঠনকে, যারা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও আহত করেছে। আলবানিজ নিজেও ২০২৩ সালের নভেম্বরে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই যুদ্ধে “মহাব্যর্থতা” দেখিয়েছে এবং “নিরপরাধ বেসামরিকদের নির্বোধ হত্যাকাণ্ড” বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আলবানিজের নতুন প্রতিবেদন আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়—এবার তিনি পুরো মানবতাকেই একটি নৈতিক অবস্থান নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, যারা এই গণহত্যাকে সম্ভব করেছে, তাদের মুখোমুখি হতে হবে। তিনি স্পষ্ট করে লেখেন: “নিরপরাধ মানুষের জীবন ধ্বংসে যে সব বাণিজ্যিক উদ্যোগ অংশ নিচ্ছে এবং লাভবান হচ্ছে, তা বন্ধ করতে হবে।” এবং “মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক অপরাধে সহায়তা করা থেকে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে বিরত থাকতে হবে, অথবা তাদের জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে।”
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এই গণহত্যায় সহযোগিতার ধরনগুলো বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত: অস্ত্র নির্মাতা, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ কোম্পানি, খনিজ ও সেবা খাত, ব্যাংক, পেনশন ফান্ড, বীমা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমনকি দাতব্য প্রতিষ্ঠানও। এই তালিকায় রয়েছে লকহীড মার্টিন, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, প্যালান্তির, আইবিএম এবং ডেনিশ শিপিং জায়ান্ট মায়ারস্ক মোট প্রায় ১০০০টির মতো কোম্পানি। এদের প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, ও তথ্যভাণ্ডারের উপর ভিত্তি করেই ইসরায়েল গাজায় আজ পর্যন্ত ৫৭,০০০-এর বেশি মানুষকে হত্যা ও ১,৩৪,০০০-এর বেশি মানুষকে আহত করেছে, আর পশ্চিমতীরেও বর্ণবাদী শাসন বজায় রেখেছে।
আলবানিজের এই প্রতিবেদন কেবল ইসরায়েলের গণহত্যার সহযোগীদের “নেম অ্যান্ড শেইম” করার উদ্দেশ্য নয় বরং নাগরিক সমাজকে বলছে, এখন আমাদের হাতে একটি সম্পূর্ণ কাঠামো রয়েছে যেটির ভিত্তিতে আমরা দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত নিতে পারি, কর্পোরেট জায়ান্টদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি এবং তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারি। তিনি লিখেছেন, “চলমান গণহত্যা একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।” শুধুমাত্র ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক বাজেট প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৫ বিলিয়ন ডলারে।
এই সামরিক বাজেট একটি অদ্ভুত চক্রের মতো—যার অর্থ মার্কিন সরকার সরবরাহ করে, যা আবার মার্কিন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়, ফলে সরকার, রাজনীতিক, কোম্পানি এবং অসংখ্য ঠিকাদারের মধ্যে এই অর্থ ছড়িয়ে পড়ে। আর এই টাকার বদলে ফিলিস্তিনি মৃতদেহ জমা হচ্ছে হাসপাতালের মর্গে, গণকবরে, কিংবা ছড়িয়ে আছে জাবালিয়া ও খান ইউনিসের রাস্তায়।
এই উন্মাদনা বন্ধ হওয়া দরকার। আর যেহেতু জাতিসংঘ এটি থামাতে ব্যর্থ, তাহলে ব্যক্তিগত সরকার, নাগরিক সমাজ এবং সাধারণ মানুষেরই সেই কাজ করা উচিত। কারণ ফিলিস্তিনিদের জীবন কর্পোরেট মুনাফা ও লোভের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হওয়া উচিত। -রামজি বারউদ একজন সাংবাদিক ও Palestine Chronicle-এর সম্পাদক। তিনি পাঁচটি বইয়ের লেখক। তাঁর সর্বশেষ বই হলো ‘These Chains Will Be Broken: Palestinian Stories of Struggle and Defiance in Israeli Prisons’ (Clarity Press)। বারউদ Center for Islam and Global Affairs (CIGA) এবং Afro-Middle East Center (AMEC)–এর একজন অনাবাসী সিনিয়র গবেষণা সহযোগী। তাঁর ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট হলো: www.ramzybaroud.net

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button