আল আজহারের সাহস প্রত্যাহার: গাজা নিয়ে গভীর নৈতিক সংকটে মুসলিম বিশ্ব

প্রায় দুই বছর ধরে সরাসরি সম্প্রচারিত এক গণহত্যা চলছে, যার নজির ইতিহাসে বিরল—দৃশ্যমানতাও নজিরবিহীন, দায়মুক্তিও অসীম। তা সত্ত্বেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে একে থামানোর জন্য এখনো কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের প্রতি সরাসরি এবং পরোক্ষভাবে গণহত্যার মাধ্যমে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তা সংস্থা ইউএনআরডবলিউএ বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, তাদের তিন মাসের খাদ্য সরবরাহ মজুদ রয়েছে গাজার সীমান্তের ঠিক পাশেই, মিশরের ভেতরে।
মিশর—যেখানে অবস্থিত হাজার বছরের পুরোনো আল-আজহার মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়—বছরের পর বছর ধরে গাজার দক্ষিণ সীমান্তে ইসরায়েলি অবরোধ বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আজ তারা এই অবরোধকে আরও মজবুত করে তুলছে, ইসরায়েলের ইচ্ছা অনুযায়ী সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে অবদান রাখছে।
২০১৩ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি, যেটি প্রকাশ্যে ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের সমর্থনে হয়েছিল। তাই পারস্পরিক প্রতিশ্রুতির এই সম্পর্ক গভীর হওয়াই স্বাভাবিক।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আল-আজহারের গ্র্যান্ড শেখ আহমেদ আল-তাইয়েব সিসির থেকে কিছুটা স্বাধীনতা দেখিয়েছেন, সময় সময় গাজার জনগণের পক্ষে উদ্বেগ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। যদিও তার হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই, কিন্তু তিনি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ইসলামি ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান হিসেবে ব্যাপক নৈতিক কর্তৃত্ব রাখেন। তিনি যদি উদ্যোগ নেন, তাহলে শুধু মিশরীয়দের নয়, পুরো মুসলিম উম্মাহর পক্ষ থেকে কথা বলার ক্ষমতা তার রয়েছে।
তার এসব বিবৃতি লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি থামাতে পারেনি, তবে অন্তত গত ২২ মাসে মিশরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মিশরীয় রাষ্ট্রের এই গণহত্যায় মৌন সমর্থন প্রদান থেকে বিরত ছিলেন।
কিন্তু এই সপ্তাহে একটি পরিবর্তন ঘটে। আল-তাইয়েব গণহত্যার বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে কঠোর নিন্দা প্রকাশ করলেও, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাষ্ট্রীয় চাপে সেটি প্রত্যাহার করে নেন।
সাহস প্রত্যাহার:
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আল-আজহারের গ্র্যান্ড শেখ এক শক্তিশালী বিবৃতি দেন, যেখানে তিনি সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের প্রতি আহ্বান জানান—ইসরায়েলি দখলদারদের দ্বারা পরিচালিত “বর্বর ও নৃশংস গণহত্যা” বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে।
এই দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি শুধু ইসরায়েলের “পদ্ধতিগত গণহত্যা”র নৃশংসতা নয়, বরং ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর নীরবতাকেও তীব্রভাবে সমালোচনা করেন—এমনকি মিশরীয় রাষ্ট্রেরও।
এতে বলা হয়, “বিশ্বের সমস্ত মুক্ত ও সম্মানিত মানুষদের প্রতি জোরালো আহ্বান জানানো হচ্ছে, যেন তারা নীরবতা ভেঙে সাহসিকতার সাথে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয় এবং তাদের সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করে রাফা সীমান্ত এবং অন্যান্য সব পারাপার পথ খুলে দেওয়ার জন্য, যেন মানবিক, চিকিৎসা, ও খাদ্য সহায়তা প্রবেশ করতে পারে।”
যেহেতু রাফা সীমান্তের মিশরীয় পাশে বহু মাস ধরে জাতিসংঘের সহায়তা ট্রাক ও সরঞ্জাম জমা রয়েছে, তাই এই বক্তব্য মিশরীয় রাষ্ট্রের দায়ভার ও সহায়তা বন্ধ রাখাকে একটি প্রচ্ছন্ন সমালোচনাই বলা যায়। কিন্তু যদি সেটাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তা বেশিক্ষণ টিকেনি।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিবৃতিটি সরিয়ে ফেলা হয়, যা বহু মানুষের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করে। তারা এটি এক বিরল নৈতিক স্পষ্টতার মুহূর্ত হিসেবে দেখেছিলেন। অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
গণহত্যার এমন এক ভয়াবহ মুহূর্তে, যখন নেতাদের পক্ষ থেকে নৈতিক দৃঢ়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন মিশরের একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান থেকে আসা একটি ক্ষণিকের আশার আলো হঠাৎ করেই নিভে যায়।
কয়েক ঘণ্টা পরে আল-আজহারের মিডিয়া অফিস থেকে একটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রদের মতো ভাষায় বলা হয়, বিবৃতিটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে “ঈশ্বরের সামনে সাহসিকতা ও দায়িত্ববোধের সাথে”, যেন এটি মিশরের যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টাকে ব্যাহত না করে।
নৈতিক দায়িত্ব:
প্রতিবেদনগুলো বলছে, শুরুতে দেওয়া বিবৃতিটি প্রত্যাহার করা হয় মিশরীয় রাষ্ট্রের চাপে। স্বাভাবিকভাবেই, এই প্রত্যাহার গণহত্যার অবসান ঘটাতে কোনো ভূমিকা রাখেনি এবং তেমন কিছু আশা করাও অমূলক।
সিসি বহু বছর ধরে আল-তাইয়েবের সাথে ধর্মীয় ও নৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে রয়েছেন, কিন্তু তাকে সরানোর মতো রাজনৈতিক সাহস এখনো অর্জন করতে পারেননি।
আল-তাইয়েব আধ্যাত্মিক এক ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন ভূমিকা তৈরি করেছেন, যেখানে সিসি অসন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেন না।
তবে গাজার মতো একটি ক্ষেত্রে, যেখানে রাজনীতি, ধর্ম, ও নৈতিকতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, সেখানে ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব—মুসলমানদের হত্যা ঠেকাতে কথা বলা—এই রাজনৈতিক চক্রান্তের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। আল-আজহারের এই আপাত বিচ্যুতি ছিল অঞ্চলটির সহায়তামূলক ভূমিকার একটি বড় ছেদ।
আল-তাইয়েবের পিছু হটা একেবারেই বিপরীত এক চিত্র তুলে ধরে আরব বিশ্বের আরেক বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের: মরক্কোর শেখ মুহাম্মাদ আল-হাসান আল-দাদাও।
এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর:
সেই একই দিনে, যেদিন আল-তাইয়েব তার পরবর্তী প্রত্যাহারযোগ্য বিবৃতি দেন, শেখ আল-দাদাও সামাজিক মাধ্যমে একটি পাঁচ মিনিটের ভিডিও প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি গণহত্যা বন্ধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি সেই গুটিকয়েক জ্যেষ্ঠ আলেমদের একজন, যারা বরাবরই অঞ্চলের ক্ষমতাবানদের সমালোচনা করে বলেছেন, তারা এই গণহত্যার একটি “চূড়ান্ত সমাধান” বাস্তবায়নে সহায়তা করছে।
গণহত্যার প্রথমদিকেই তিনি দৃঢ়ভাবে সতর্ক করে দেন যে, মুসলিম শাসক ও তাদের সেনাবাহিনী, প্রায় সর্বাংশে, গাজায় মুসলিমদের রক্তপাতের জন্য আল্লাহ্‌র সামনে জবাবদিহি করতে বাধ্য হবেন।
২০২৪ সালের শুরুতে দেওয়া এক ভাষণে তিনি বলেন, মুসলিম বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রপ্রধান—তুরস্ক, সৌদি আরব বা অন্য কোথাও—ইচ্ছা করলেই গাজা সংকটের অবসান ঘটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি তুলে ধরেন মিশরের একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোরসির কথা, যিনি ২০১২ সালে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগে সফল হয়েছিলেন।
তার মন্তব্য সরাসরি মুসলিম শাসকদের উদ্দেশ্যে—যারা যতই গণহত্যার নিন্দা করুক না কেন, কার্যত তারা কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেয়নি।
একজন সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী, নাকস বিলাল, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর একটি ভিডিওর জবাবে বলেন: স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, আমি—আর মনে করি আমরা—এখন এসব কথার ঊর্ধ্বে চলে গেছি। রাষ্ট্রনেতারা এখনো গাজা নিয়ে শুধুই প্রার্থনা ও সমবেদনা জানাচ্ছেন, কিন্তু কেউই মানবিক সামরিক সহায়তা পাঠাতে রাজি নন। ৪৮টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, ২২টি আরব রাষ্ট্র—সবাই নেটোকে ভয় পায়, কিন্তু কেউ সঠিক কাজটি করে না।
সবাই মিলে যদি চায়, তাহলে ইসরায়েলের উপর সর্বনাশা আগুন নামিয়ে আনতে পারে, কিন্তু তার বদলে চলতে থাকে বৈঠক, সভা, আলোচনা—আর ফিলিস্তিনিরা হাজার ডলার দিয়ে আটা কিনে প্রাণ হারাচ্ছে সহায়তার লাইনে দাঁড়িয়ে।
আল-দাদাওয়ের কথা আল-তাইয়েবের মতো ধর্মীয় নেতাদেরও স্মরণ করিয়ে দেয়, যারা গাজার নিরীহ জনগণের পক্ষ থেকে কথা বলার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না—যদি না তারা রাষ্ট্রের চাপের কাছে নতিস্বীকার করেন।
রাজনীতিকদের বলার মতো কিছু আর নেই—এখন কেবল কাজ করার পালা। ধর্মীয় নেতাদের জন্য, বিশেষ করে আল-তাইয়েবের মতো ব্যক্তিদের জন্য, গাজার জন্য এখনই দাঁড়ানোর সময়।
তার এই ব্যর্থতা—একজন মুসলিম শাসকের চাপে দাঁড়িয়ে না থাকা—এই গণহত্যার গভীর প্রোথিত শিকড়ের এক বাস্তব চিত্র।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি যা দরকার, তা হলো সত্যিকারের সাহস—কাপুরুষতা নয়—যা মুসলিম বিশ্বে এই মর্মান্তিক জটিলতার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াতে পারে। -উসামা আল-আজামী, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক। তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং একইসাথে একজন সনাতন মাদ্রাসাশিক্ষিত ইসলামী ধর্মতত্ত্ববিদ।

[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button