রাজধানী ঢাকায় এখন মদের ব্যবসা জমজমাট : শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজ বিপথগামী হয়ে পড়েছে

মাহমুদা ডলি: রাজধানী ঢাকায় এখন অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বার বা মদের দোকান। শুধু গুলশান বনানীতেই বারের সংখ্যা দুইশ’ ছাড়িয়ে গেছে। এরপরই বার রয়েছে মতিঝিল, গুলিস্তান এলাকায়। শাহবাগ, মগবাজার, পরীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায়ও দেখা গেছে বেশ কয়েকটি অনুমোদনবিহীন বার।
রেস্তোরাঁ, কফি হাউস, পিত্জা হাউস, কাবাব হাউস, গেস্ট হাউসের আড়ালে চলছে এসব বার ব্যবসা। এখন নামি-দামি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও তরুণরাই এসব বারে বেশি যাচ্ছে। কোনো কোনো বারে ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নে ডিস্কো ড্যান্সেরও আয়োজন করা হচ্ছে। ফলে সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। বিপথগামী হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা, যা মা-বাবার জন্য উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসব চিত্র পাওয়া গেছে। তবে এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরাও। তারা খুব দ্রুত এসব বার এবং মাদক ব্যবসা বন্ধসহ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তি দাবি করেছেন সরকারের কাছে।
সরেজমিন জানা গেছে, সরকারি হিসেবের তুলনায় শতগুণ বেশি বার বা মদের দোকানে মাদক ব্যবসা চলছে। ৯০ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে প্রকাশ্যে মদের ব্যবসা এবং মদ খাওয়া নিষিদ্ধ। শুধু বিদেশিদের প্রয়োজনেই কিছু বারের অনুমোদন ছিল। কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যেই চলছে মদের ব্যবসা এবং মদপান। শুধু রাতে নয়, দিনেও এসব বারে মদ ও নেশাসামগ্রী কেনাবেচা হচ্ছে। এসব বারে দেশি মদ থেকে শুরু করে বিদেশি মদ এবং নানা ধরনের মাদক বেচাকেনা চলছে। বারের এজেন্টরা রাস্তাঘাট, হোটেল, রেস্তোরাঁয় ফেরি করেও বিক্রি করে নেশা করার সামগ্রী। এর সঙ্গে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার কারবার চলছে। যা হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কাছে। মোটা অংশ পাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা।
রাজধানীতে উদ্বেগজনক হারে অবৈধ বার : সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, অভিজাত গুলশান বনানী এলাকায় এখন পশ্চিমা দেশগুলোর মতো অবাধে চলছে কয়েকশ’ অবৈধ বার। অভিজাত ওই দুই এলাকায় পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিন ছাড়াও লা ডিপ্লোমা বার, রুচিতা ও জাকারিয়া বারসহ তিনটি বার সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া। কিন্তু ওই এলাকাগুলোতে হোটেল, রেস্তোরাঁসহ অন্য বারগুলো সম্পূর্ণ অবৈধভাবে চলছে। এমনকি ক্লাবগুলোকেও এখন বার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, গুলশান-বনানীতে বিভিন্ন হোটেল, ক্লাব, রেস্তোরাঁয় অবৈধভাবে বার হিসেবে মদের ব্যবসা চলছে। যেসব বার বা মদের দোকান রমরমাভাবে চলছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, গুলশানের নেস্ট বার, কোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব অ্যান্ড রেস্তোরাঁ, অল কমিউনিটি ক্লাব, আমেরিকান ক্লাব, দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব, কোরিয়া-বাংলাদেশ ক্লাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, ক্যাপিটাল রিক্রিয়েশন ক্লাব, আমাজন ক্লাব ও ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে অলকমিউটি ক্লাবসহ প্রায় শতাধিক বার। ক্লাবগুলোতে বার বা মদের দোকানের নিয়ম নেই। এসব ক্লাব গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার তা চালু হয়। এসব ক্লাব থেকে মাদক এজেন্টরা বিয়ার, হুইস্কি, স্কচসহ দেশি-বিদেশি মদ হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও সরেজমিন দেখা যায়, কোরিয়া বাংলাদেশ ক্লাবে যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে গুলশানের পুলিশ কর্মকর্তারা (কে এন্ড বি) মদপানের আড্ডায় বসেন। এছাড়াও বনানীতে রয়েছে ১৫০টিরও বেশি অনুমোদনবিহীন বার। এর মধ্যে বনানী প্যাসিফিক বার, ব্লু মুন, ডিপিএল বারে (ভিআইপি) নারী ও শিক্ষার্থীদের আনাগোনা ব্যাপক হারে রয়েছে। বনানী ২৭ নম্বর রোডে পিয়াং-ইয়াং বার আর্কষণীয় করার জন্য বিদেশি নারী কর্মীদের দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে। হোটেল সুইট ড্রিম, শরমা হাউসে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইংলিশ মিডিয়ামের টিনেজদের আনাগোনা বেশি। শুধু বনানী ১১ নম্বর রোডেই ১০টি সিসা ও হুক্কা বার রয়েছে। ওইসব বারে হুক্কার সঙ্গে আফিম মেশানো থাকে। গুলশান বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে, এলাকাবাসী ও বারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টার্গেট অনুযায়ী এসব বারের দিকে ঝুঁকছে সরকারি, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের টিনেজ শিক্ষার্থীরাও। গুলশান বনানী এলাকায় ৩০টিরও বেশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্ধশত নামি-দামি স্কুল-কলেজ রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষার্থী, বিশেষ করে যারা বাইরে থেকে আসে, তারাই বারে ছুটে যাচ্ছে। কোনো কোনো বারে রয়েছে ওয়েস্টার্ন প্যাটার্নের ডিস্কো ড্যান্স। একই সঙ্গে চলছে যৌন ব্যবসাও। এসব বারে বিপথগামী শিক্ষার্থীরা যাওয়ায় মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। তবে অভিজাত এলাকার গৃহিণীরাও যাচ্ছেন বারে। শুধু রাতেই নয়, দিনের বেলায়ও এসব চলে। বনানী মসজিদ কমিটির কয়েকজন দৈনিক আমার দেশকে জানান, বিকাল থেকেই বনানীর বিভিন্ন মসজিদের আশপাশে এবং অলি-গলিতে দাঁড়িয়ে থাকে মাদকের এজেন্টরা। বনানী সুপার মার্কেট এলাকার মসজিদ কমিটি সাম্প্রতিক সময়ে বার উচ্ছেদের দাবিতে মিছিল করলেও কোনো সুরাহা হয়নি।
গুলশান-বনানী থেকে শুরু করে নগরীর মতিঝিল, মগবাজার, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এলাকায় হোটেল, রেস্তোরাঁ, আবাসিক এলাকার ফ্ল্যাট, পিত্জা হাউস, কফি হাউসেও বসছে বারের নামে মাদকের হাট। মতিঝিল এলাকার কয়েকটা সিসা বারের কথা উল্লেখপূর্বক একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এছাড়াও ধানমন্ডির বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাটে বারের ব্যবসা চলছে প্রশাসন ও রাজনীতিকদের ছত্রছায়ায়।
এসব বারে বেশি মাদক সরবরাহ করছে বারমিজ হাউসগুলো। এছাড়াও কয়েকজন জানান, রুচিতা বার হাউসের মালিকের সিঙ্গাপুরে কারখানা রয়েছে। সেখান থেকে পাঠানো বিদেশি মদও এসব অবৈধ বারে সরবরাহ করা হচ্ছে। কোন বার হাউস কতটা মাদক সরবরাহ করলো সে ব্যাপারেও কোনো মনিটরিং নেই সরকারের।
অবৈধ বার ব্যবসার নেপথ্যে : সরেজমিন বার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর কয়েক হাজার অবৈধ বার ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার ও একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ। প্রতিদিনের কোটি কোটি টাকার মাদক ব্যবসার ভাগ পায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের একশ্রেণীর কর্মকর্তা। রাজধানীর বার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বারের অনুমোদন নেই বলেই পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ প্রভাবশালীদের মোটা অংকের টাকা দিতে হচ্ছে। তবে পুরো এলাকার বারের একটি নির্দিষ্ট অর্থ যাচ্ছে প্রভাবশালীদের কাছে। প্রতি মাসে গুলশান ও বনানী থানায় গেস্ট হাউস ও বারগুলোকে ৩০/৪০ হাজার টাকা করে দিতে হচ্ছে চাঁদা। এছাড়াও বারের আয় বুঝে সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে থানায়। রাত ১১টার পরে চাঁদা দেয়ার জন্য গেস্ট হাউস ও বার ম্যানেজারদের ভিড় থাকে থানাগুলোতে। এছাড়াও এলাকাভিত্তিক জায়গা বুঝে প্রতিটি বার থেকে প্রত্যেক এলাকার থানায় সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।
বৈধ বারেরও তালিকা নেই মন্ত্রণালয় কিংবা ডিএমপি’র কাছে : অবৈধ বারের তালিকা তো নেই-ই, বৈধ বারের তালিকাও নেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে। মিডিয়া সেন্টারে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তাদের কাছে কোনো তালিকা নেই। কোথাও থাকলে তা বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে। তবে সেগুলো দেয়ার মতো নয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভূমিকা : মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে মাত্র ১৯টি বারের তালিকা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, হোটেল রেডিসনে ১০টি বার, সোনারগাঁয়ে ৭টি, ওয়েস্টিনে ৬টি ও রূপসী বাংলাসহ ১৯টি বারের তালিকা তাদের রয়েছে। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যায়, রাজধানীতে প্রায় অর্ধশত বারের লাইসেন্স দিয়েছে তারা। শুধু গত দুই বছরেই তাদের বারের লাইসেন্সের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রতিষ্ঠানটি বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পাঁচতারকা হোটেল ছাড়াও রেস্তোরাঁ, পিত্জা হাউসেও বারের লাইসেন্স দিয়েছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কাছে অবৈধ কোনো বারের তালিকা নেই বলেও জানান। কর্মকর্তারা একবাক্যে জানান, কোনো অবৈধ বার ঢাকায় নেই!

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button