আমেরিকার ভ্রান্ত ধারণা ও গাজার কঠিন বাস্তবতা
মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরে নিজেদের ভূমিকা ঘিরে একগুচ্ছ সান্ত্বনাদায়ক মিথ তৈরি করেছে। এই বর্ণনাগুলো ওয়াশিংটনকে বৈশ্বিক নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতার প্রতীক হিসেবে ধরে রাখতে সহায়তা করেছে। কিন্তু গাজায় চলমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এই মিথগুলো ক্রমশ ভেঙে পড়ছে—যা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। ওয়াশিংটনের কথার সাথে বাস্তবতার ফারাক এখন আর উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।
আমেরিকা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে যে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সে-ই অপরিহার্য শক্তি। রাজনৈতিক দল যেই হোক না কেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা নিজেদের শান্তির মধ্যস্থতাকারী ও সংঘাত নিয়ন্ত্রক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন—হোক সেটা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্ন কিংবা আঞ্চলিক নিরাপত্তা। কিন্তু বর্তমান গাজা সংঘাত দেখাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্লেষক আগা ও ম্যালির মতে, মার্কিন কূটনীতি দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়ছে। ইসরায়েলও আর শুধু আমেরিকার উপর নির্ভর করছে না; বরং রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। এটা নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা, যেখানে আমেরিকা আর একক মহাশক্তি নয়।
দশকের পর দশক ধরে আমেরিকা নিজেকে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছে, যারা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে কাজ করছে। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে—সামরিক সহায়তা ও রাজনৈতিক সুরক্ষা দিয়ে এসেছে, এমনকি ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ উপেক্ষা করেও। জাতিসংঘে প্রস্তাব ভেটো দিয়ে, যুদ্ধবিরতি বা সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্ত ঠেকিয়ে ওয়াশিংটন প্রমাণ করেছে যে তারা নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষতার মিথ আসলে আমেরিকার ভাবমূর্তি রক্ষার উপায় মাত্র, বাস্তবে তারা সহিংসতার সহযোগী।
আরেকটি প্রচলিত মিথ হলো, শান্তি যেন একেবারেই কাছাকাছি। মার্কিন কর্মকর্তারা বারবার এই বয়ান দিয়েছেন, যে একটু কূটনৈতিক চাপ দিলেই শান্তি আসবে। অথচ গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ ও মানবিক বিপর্যয় যত বাড়ছে, এই ধারণা ততই অবাস্তব হয়ে উঠছে। আমেরিকার শান্তি উদ্যোগগুলো বারবার ব্যর্থ হয়েছে—যা বাস্তবসম্মত কূটনীতির বদলে কেবল কল্পনার প্রতিফলন। মানবিক বিরতির আহ্বান বা সাময়িক পদক্ষেপগুলো সহিংসতা থামাতে কিছুই করতে পারেনি। ফলে শান্তির প্রতিশ্রুতি এখন শূন্য বাগাড়ম্বর মনে হচ্ছে।
জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি বা স্বাধীন তদন্তের প্রস্তাবগুলো যুক্তরাষ্ট্র বারবার ভেটো করেছে। এতে ইসরায়েল দায়মুক্তি পেলেও যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ বিশ্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বৈশ্বিক শান্তি ও গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করলেও, গাজার বাস্তবতায় আমেরিকা অনেক দেশের চোখে একঘরে হয়ে গেছে। বিশেষত গ্লোবাল সাউথের অধিকাংশ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, অথচ আমেরিকা এখনো পুরনো নীতি আঁকড়ে ধরে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করছে।
আমেরিকার ভেতরেও জনমত পাল্টাচ্ছে। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর জরিপ দেখিয়েছে, ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আমেরিকান ইসরায়েলের প্রতি অন্ধ সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এমনকি সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে “গণহত্যা” বলেছেন—যা দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় ঐকমত্য থেকে স্পষ্ট বিচ্যুতি। এটা প্রমাণ করে, আমেরিকান জনগণের কাছে পুরনো মিথগুলোর প্রভাব কমে আসছে।
তবুও আমেরিকা এখনো নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করে, যদিও বাস্তবতা উল্টো। তারা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি করে চলেছে, অথচ কথার সঙ্গে কাজের ফারাক ক্রমেই বাড়ছে। গাজার দুর্দশা যত বাড়ছে, এই ভ্রান্ত ধারণাগুলো ততই আমেরিকার নৈতিক কর্তৃত্বকে ক্ষয় করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন এই মিথগুলো সরাসরি মোকাবিলা করা। যেমন-স্বীকার করা যে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। স্বীকার করা যে তাদের নিরপেক্ষতার দাবি ভুয়া এবং ইসরায়েলপন্থী অবস্থান সংঘাতকে বাড়িয়েছে। মেনে নেওয়া যে শান্তি অবধারিত নয়, শুধু সামরিক শক্তি বা কূটনৈতিক ভঙ্গিতে তা আনা সম্ভব নয়। প্রকৃত মনোযোগ দেওয়া উচিত মানবিক উদ্যোগ, যুদ্ধবিরতি এবং উভয় পক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দিকে।
চূড়ান্ত উপসংহার:
একটি জাতিসংঘ কমিশন ইতোমধ্যেই জানিয়েছে—গাজায় গণহত্যার দায় ইসরায়েলের। আমেরিকার জন্য এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে না, বিশেষ করে ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের গভীর সম্পর্কের কারণে। কিন্তু ভবিষ্যতের পররাষ্ট্রনীতি ও মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি। যতদিন আমেরিকা এই মিথ আঁকড়ে ধরবে, ততদিন তারা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং সংঘাতের মূল কারণগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হবে।
শেষ পর্যন্ত, আমেরিকা যে ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের ভূমিকা তৈরি করেছে, তা টেকসই নয়। এই ধারণাগুলো অস্বীকার ও আত্মপ্রবঞ্চনার উপর দাঁড়িয়ে আছে, যা গাজার চলমান বাস্তবতায় অবশ্যম্ভাবীভাবে ভেঙে পড়বে । যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ভূমিকার কঠিন সত্য স্বীকার করতে হবে—শুধু তখনই তারা প্রকৃত ও স্থায়ী শান্তিতে অবদান রাখতে পারবে। -একো এরনাদা, লেখক ইন্দোনেশিয়ার ইউনিভার্সিটাস জেম্বার (ইউএনইজে)-এর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক এবং নাহদাতুল উলামা ইন্দোনেশিয়ার আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক উন্নয়নের বিশেষ কমিটির সদস্য।
[এই প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব এবং দা সানরাইজ টুডে‘র সম্পাদকীয় নীতির সাথে তা প্রতিফলিত হয় না।]



