ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলায় ধর্ম নয় ব্যক্তি দায়ী : সৌদি রাষ্ট্রদূত

‘সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা’-এর প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সম্প্রীতি সম্মেলনে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ড. আবদুল্লাহ বিন নাসের আল বুসাইরি বলেছেন, বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি রয়েছে। ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের ওপর বিচ্ছিন্নভাবে যেসব হামলার ঘটনা ঘটে থাকে তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দায়ী হতে পারে, এ জন্য কোনো ধর্ম দায়ী নয়।
শনিবার মহাখালী ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ‘সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা’-এর আহ্বায়ক ও সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, যুগ্ম-আহবায়ক সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফাতিমা আনোয়ার।
সম্মেলনে সৌদি রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, কোনো ধর্মগ্রন্থে অন্য ধর্মকে হেয় করার কথা বলা নেই। এ জন্য অন্য ধর্মের অনুসারীর ওপর হামলার যে ঘটনা ঘটে তাতে ধর্মকে দোষারোপ করা যায় না, এ জন্য ওই ব্যক্তিই দায়ী হবে। তিনি বলেন, কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য হওয়া দূষণীয় নয়, কিন্তু তাকে পুঁজি করে বিশৃঙ্খলা করা অনুচিত।
ড. আবদুল্লাহ জানান, সৌদি আরবের বর্তমান বাদশাহ সারা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে একটি উদ্যোগ নেন। তার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১২ সালে জাতিসঙ্ঘে বিষয়টি উপস্থাপন করা হয়। পরে ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সবসময় সম্প্রীতি রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধারা অব্যাহত রাখলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে।
তিনি সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, তারা সঠিকভাবে কাজ করে গেলে আগামীতে এ কার্যক্রম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হলে ব্যক্তি নয়, আইনের শাসন শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরো বলেন, দেশের যেকোনো অর্জন সম্ভব হয়েছে সব ধর্মের লোকের যৌথ ভূমিকা থাকার কারণে। ’৫২ ও ’৭১ সালের আন্দোলনে সব ধর্মের মানুষের সম্পৃক্ততা থাকায় আমরা বিজয়ী হয়েছি।
বিচারপতি আবদুর রউফ বলেন, ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। কিন্তু মুসলমানেরা এটিকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, শত্রু সম্পত্তি নিয়ে নির্বাচনের আগে-পরে দেশে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ জন্য আইনের সংস্কার প্রয়োজন। তিনি ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় সমাজের সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব অধ্যাপক মাওলানা সালাহউদ্দিন বলেন, মানবধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। সবার পিতা এক আদম আ: এবং সবার মাতা এক মা হাওয়া আ:। এ জন্য সবাই আমরা ভাই। আমাদের মধ্যে বিরোধ থাকবে কেন। তিনি আরো বলেন, সত্যিকার ধার্মিক মুসলিমরা কখনো সন্ত্রাসী হতে পারে না।
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী অমেয়ানন্দের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম সম্প্রীতিকেই আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
আর্চ বিশপ পৌলিনুস কস্তা এসটিডি, ডিডি বলেন, এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল, থাকবে। তিনি আরো বলেন, দেশে যে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে তা ধর্ম নয়, ব্যক্তিগত বৈষয়িক কারণে ঘটে থাকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেন, ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে শান্তির জন্য। কিন্তু রাজনৈতিক স্বার্থে সম্প্রীতি নষ্ট করা হচ্ছে। দেশের আইনগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যে তা বাস্তবায়ন করতে গেলে সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী গৌতম চক্রবর্তী বলেন, কোনো ধর্মেই অন্য ধর্মের ওপর আঘাত করার কথা বলে না। দেশে এ পর্যন্ত যত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে তা রাজনৈতিক স্বার্থে স্বার্থান্বেষী মহল করেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
‘সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা’-এর যুগ্ম আহবায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়–য়া বলেন, মসজিদ, মন্দির শান্তির জায়গা। সেখানে দাঙ্গা হতে পারে না।
যুগ্ম-আহবায়ক সঞ্জীব চৌধুরী বলেন, দেশে সংখ্যালঘুরা ভারতে চলে যাচ্ছে যারা বলেন তারা ভুল বলেন। কারণ, ’৭১ সালে দেশে ৯৫ লাখ হিন্দু ছিল, বর্তমানে দুই কোটির বেশি হিন্দু আছে। দেশে খ্রিষ্টানের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে যাওয়ায় অন্যদের কম মনে হচ্ছে।
সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব শরীফ বায়জীদ মাহমুদ ও আহসান হাবীব খানের সঞ্চালনায় সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন, শিক্ষা অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোবারক আলী আকন্দ, এ আরকে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ কর্নেল (অব:) আশরাফ উদ্দিন, লে. কর্নেল (অব:) আলী আহমদ, রাবি অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন, অধ্যাপক তাহমিনা আক্তার, প্রকৌশলী দিবেন্দু বিকাশ বড়–য়া, মাইনোরিটি ওয়াচের সভাপতি অ্যাডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মাওলানা মোফাজ্জল হোসেন খান, বাংলাদেশ আন্তঃধর্মীয় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ব্রাদার জারলাথ ডি সুজা প্রমুখ। সম্মেলনে ‘সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভা’র স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন ও একটি ওয়েবসাইটের উদ্বোধন করা হয়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button