ভিতরের ঈদটাই আসল

রমযান শেষের দিকে, সামনেই পবিত্র ঈদ। সবার মনে একটি প্রশ্ন, এবারের ঈদ কেমন হবে? একদিকে করোনার হামলা, অপর দিকে ঘূর্ণিঝড় আম্পান-এর আঘাত। সাথে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। এত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মানুষ ঈদ করবে কেমন করে? এমন প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক। তবে ঈদের মর্মবাণী যারা উপলব্ধি করেন, সিয়ামের চেতনার সাথে যারা পরিচিত, তাঁরা ঠিকই জানেন যে, চ্যালেঞ্জ যত তীব্র হবে ঈদের তাৎপর্য ততই হবে মহিমান্বিত। ঈদের আনন্দ-উৎসবতো বাইরের দিক, ভেতরের ঈদটাই আসল। সিয়ামের সেই ঈদ মানুষকে যে কোনো পরিস্থিতিতে উদ্বুদ্ধ করে স্রষ্টার বান্দা হিসেবে সংযমী হতে, কর্তব্য-কর্মে নিষ্ঠাবান হতে। করোনা ও আম্পানের এই সময়ে ‘খেদমতে খালক’ তথা সৃষ্টির সেবার চাইতে বড় ঈদ আর কী হতে পারে?

ঈদের বার্তা আমাদের সক্রিয় করবে করোনা ও আম্পান বিপর্যস্তদের পক্ষে দাঁড়াতে। ঘূর্ণিঝড়তো চলে যায় সহসাই, কিন্তু করোনা সেরকম নয়। নতুন বছরের শুরুতেই করোনা ভাইরাস আঘাত হানলো বিশ্বে, কিন্তু যাওয়ার নাম নেই। দ্রুতগতিতে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক। এখনও এ রোগের ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। ফলে অসহায় মানুষের মধ্যে বাড়ছে হতাশার মাত্রা । এর মধ্যেই কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সাবেক শীর্ষ চিকিৎসক ক্যারোল সিকোরা। টুইটারে তিনি লেখেন, বিশ্বে যে কোনো একটি ভ্যাকসিন আসার আগেই প্রাকৃতিকভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে করোনা ভাইরাস। তিনি বলেন, আমরা প্রায় সর্বত্রই ভাইরাসটির একই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখছি, আর আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ধারণার চেয়েও বেশি বলে আমার মনে হয়। তবে আমাদের ভাইরাসটির বিস্তার ধীরগতিতে রাখা দরকার।
এদিকে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কোনো চিকিৎসা না থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শতাধিক ভ্যাকসিন ও প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছে বিজ্ঞানীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বর্তমানে করোনা ভাইরাসের অন্তত ৮টি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে। এছাড়া আরও ১১০টি ভ্যাকসিন প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে বৃটেন এবং চীন তাদের তৈরি ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে। তবে এতসব তৎপরতার পরও গবেষকদের অনেকে বলছেন, করোনার ভ্যাকসিন পেতে আরও এক বছর সময় লেগে যেতে পারে। ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত সবাইকে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। কথাতো ঠিকই, কিন্তু সমস্যাও বাস্তব। এদিকে জীবন, অপরদিকে জীবিকা। জীবন বাঁচাতে হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, আর জীবিকা অর্জন করতে গেলে কতজন মানুষ এই দূরত্ব বজায় রাখতে পারবে? ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে প্রায় পাঁচ মাস, আরো এক বছর মানুষ অপেক্ষা করবে কেমন করে? এই চ্যালেঞ্জটাই এখন মানব জাতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখন মহান প্রভু যদি সদয় হন। যদি প্রাকৃতিকভাবেই ধ্বংস হয়ে যায় করোনা ভাইরাস। আসলে স্রষ্টাতো এই পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে মানববান্ধব করেই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অপরিণামদর্শী মানবের কর্মকাণ্ডেই জলে-স্থলে দেখা দেয় বিপর্যয়। এমন অবস্থায় শুধু সাধারণ মানুষ নয়, রাষ্ট্রপ্রধানরাও নানা কথা বলছেন। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এমনই। যেটা বলতে ইচ্ছে হয়, বলে ফেলেন। অত চিন্তা-ভাবনা বা গবেষণার ধার ধারেন না। তাইতো বলে ফেললেন, প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে। হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে করোনা নিয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১৫ মে এমন ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আরো বলেন, ‘আরো অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি এবং ভাইরাস কিংবা ফ্লু আসবেই, আপনাকে এর বিরুদ্ধে লড়াই করেই চলতে হবে।’ এদিকে বিশেষজ্ঞরা এখনই সবকিছু সচল করার বিরোধিতা করছেন। তাদের দাবি, এটা হলে ভাইরাসটি আরো ব্যাপক হারে কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়বে। আর সমালোচকরা বলছেন, নবেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, তাই ঝুঁকি নিয়ে হলেও সব সচল করতে চাচ্ছেন ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট, বিশেষজ্ঞ ও সমালোচকদের বক্তব্যে আমরা ভাবনার তিনটি ধারা লক্ষ্য করলাম। একটু চিন্তামগ্ন হলে তিনটি ধারাতেই কিছু বার্তা পাওয়া যাবে, যা ফেলে দেয়ার মতো নয়। এসব বার্তার সমন্বয়ে আমরা জীবনযাপনের একটা পথ খুঁজে পেতে পারি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পরস্পরকে সোনার ও বোঝার মতো ধৈর্য আমাদের আছে কী? আর যদি দম্ভ ও অহঙ্কারের কথা বলি, তাহলে বলতে হয়- এসব ভাইরাসও ইতোমধ্যে মানুষের, সভ্যতার অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে।
করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও আশাবাদী হওয়ার মতো খবর পাওয়া যাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের টিকা ছয়টি বানরের দেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করে দেখা গেছে, এটি কোভিড-১৯ রোগের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। করোনার টিকা প্রয়োগের এই ফলাফল আশা জুগিয়েছে। এখন মানুষের দেহেও এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ চলছে। এ গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। এ টিকা প্রাণীগুলোর নিউমোনিয়া হওয়া থেকে সুরক্ষা দিয়েছে। কয়েকশ’ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলেই প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিন তৈরি করা হবে। আর বাজারে এর দাম বেশি হবে না বলে জানানো হয়েছে। দাম কমানোর লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করা হবে এই টিকা। এদিকে করোনা প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি বা প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সোরেন্টো থেরাপিউটিকস নামে একটি বায়ো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। শুক্রবার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. হেনরি জি জানান, ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি আবিষ্কার করেছেন তারা। এটি করোনা রোগীদের চিকিৎসায় শতভাগ কার্যকর। এমনকি অ্যান্টিবডিটি দেহে প্রয়োগ করা মাত্র চারদিনের মধ্যেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবেন। আর আপনার শরীরে যদি আমাদের নিরপেক্ষ অ্যান্টিবডি থাকে তবে আপনার সামাজিক দূরত্বের দরকার নেই, আপনি নির্ভয়ে সমাজে চলতে পারবেন।’
টিকা এবং অ্যান্টিবডি আবিষ্কারের উদ্যোগ আমাদের জন্য খুবই ভালো খবর। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, এগুলো যেন পৃথিবীর সব দেশের মানুষের জন্য সহজলভ্য হয়। দাম যেন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। করোনা চিকিৎসার মধ্যে যেন জাতিগত বিদ্বেষ কিংবা রাজনীতির হলাহল প্রবেশ না করে। এগুলোও করোনার মতো বিপদজনক। সেই অভিজ্ঞতা বিশ্ববাসীর হয়েছে। মানুষের সামনে এখন জীবনরক্ষা ও জীবিকা অর্জনের চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে জিততে হলে বিশ্বনেতাদের অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে এবং উদার মনে পরস্পরের প্রতি বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button