টেমস নদীর মোহনায় মুহাম্মদ (সা:)

শায়খ মাহমুদুল হাসান: ২০০৫ সনের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের শীত কনকনে একটি দিনে আমি ‘সি টু সি’ ট্রেন থেকে যখন প্রথম এ শহরে পা রাখি, শহরের নিস্তব্ধতা, পরিচ্ছন্নতা, নদী ঘেঁষে এগিয়ে চলা সবকিছু আমাকে কেমন যেন চম্বুকাকর্ষণ করেছিল। বিমোহিত করেছিল শহরে পৌঁছার পূর্বেই। কয়েক স্টেশন আগে থেকে ট্রেন ছুটছিল টেমস নদীর মোহনার সাথে সাথে। এক দিকে ছিল সবুজ শ্যামল টিলা, ক্ষেত খামার আর অন্য দিকে নদী ও সমুদ্রের মিলনের উত্তেজনা। আমি তখন তন্ময় হয়ে উপভোগ করেছি এ অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কখন যে ‘সাউথেন্ড’ এসে পৌঁছে গেলাম বুঝতে পারিনি। শহরের সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম আমি গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি। পুরো নাম Southend-On-Sea। আমার প্রবাস জীবনের এক যুগ পার হয়ে গেল এ শহরে। আমার তিন সন্তানের জন্মস্থান হয়ে গেল সেন্ট্রাল লন্ডন হতে ৪০ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত টেমস বিধৌত এ শহর। এখানের বীচ-সৈকত, বালু কণা, সাজানো উপত্যকা ও পৃথিবীর দীর্ঘ পিয়ার সবকিছুর সাথে সৃষ্টি হয়েছে অপরূপ এক বন্ধুত্ব। শহরের মেয়র, কাউন্সিলর, এমপি, পুলিশ প্রশাসন সবার সাথে তৈরী হয়েছে চমৎকার যোগাযোগ। কুকুর হাতে চলা বৃদ্ধ প্রতিবেশীও পথে দেখা হলে দাঁড়িয়ে যায় এবং হাত বাড়িয়ে দেয় আর হৃদয়ের উষ্ণতায় বলে ‘গুড মর্ণিং’। একবার আমাদের প্রতিষ্ঠানে বর্ণবাদী হামলা হয়েছে শুনে কয়েকজন কাউন্সিলর, সাংবাদিক ও সমাজসেবী মানুষ চলে এসেছিলেন বাসায়। বয়স্ক মেয়র সাহেবের হাতে ছিল শান্তনার প্রতীক ‘ফুলের টপ’। সম্প্রীতি ও শান্তির এ শহর ছেড়ে যাবো যাবো করেও যেতে পারিনি। মায়ার টান মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, বেঁধে রেখেছে নিবিঢ়ভাবে।

একদিন পোস্টবক্স খুলে চক্ষু চড়কগাছ। ছোট্ট খোকার নামে একটি প্যাকেট এসেছে পোস্টে। ভেতরে একটি বই, সাথে লাইব্রেরী কার্ড। যে বাচ্চাটি এসেছে পৃথিবীর আলোয় এই সেদিন, মিষ্টি করে অবুঝ হাসি আর হাত-পা ছুঁড়ে কান্না জুড়ে দেয়া ছাড়া তার অন্য কোন ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি নেই, তার জন্য লাইব্রেরী ব্যবহারের কার্ড! সাথে একটি বইও! ‘গাড়ি চলে বন্ বন্’ ইংরেজি ও বাংলা দু’ভাষায়। আসলে সাউথেন্ড কাউন্সিল চায় জন্মের পর পর প্রতিটি শিশুকে বইয়ের সাথে পরিচিত করতে। তারা মা-বাবাকে অনুপ্রাণিত করে প্রতিদিন শিশুদেরকে বইয়ের গল্প পড়ে শুনাতে, তারা বুঝবেনা মনে করে অবহেলা না করতে। মূলত: শিশুটি ছোট হলেও তার অনুধাবন প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে গঠিত হচ্ছে। বই পড়ে শুনানোর ভালো ভূমিকা থাকে এ ক্ষেত্রে। বাচ্চারা যখন বড় হতে থাকে তারা যেন লাইব্রেরীমুখী হয়, তাদের জন্য তাদের উপযোগী করে সাজানো অংশ রয়েছে। সেখানে অনেক আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে অনেক বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকে লাইব্রেরীতে। বাচ্চারা তখন মা-বাবাকে লাইব্রেরীতে নিয়ে যেতে চাপাচাপি করে। গ্রীষ্মের ছুটির এক দুপুরে আমি আমার বাচ্চাদের লাইব্রেরীতে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। তারা তাদের মত বই নিচ্ছে। খেলছে। কম্পিউটার লগিং করছে। সে ফাঁকে আমি ভাবলাম, আমি কিছু পড়াশুনা করি। আমার চিন্তায় এলো টেমসের মোহনায় অবস্থিত এ শহরের মানুষ কি আমার নবীকে চিনে? চিনলেও কতটুকু? এ পাবলিক লাইব্রেরীতে কি আমার নবীর ব্যাপারে কোন বই আছে? আমি উপরের ফ্লোরে গিয়ে লাইব্রেরী ক্যাটালগ নাড়াচাড়া শুরু করলাম। হ্যাঁ, অমুসলিম অধ্যুষিত এ ছোট্ট শহরেও আমার প্রিয় নবী মোহাম্মদ (স:) এসেছেন তাঁর জীবনী আলোচনা নিয়ে। বইগুলো অমুসলিম লেখকদের হলেও মনে হলো ভাষা শৈলী ও উপস্থাপনায় বেশ আকর্ষণীয় ও ইতিবাচক। ক্লিন্টন বেনেট লিখেছেন In Search of Muhammad ‘মোহাম্মদের খোঁজে’। জর্জ জর্ডেক অনুবাদ করেছেন The Voice of Human Justice ‘মানবিক সু-বিচারের কণ্ঠ’। অক্সফোর্ড প্রেস থেকে প্রকাশিত ছোট্ট বইটির ভূমিকা আমাকে বড়ই বিমুগ্ধ করেছে। জনাথন এ সি ব্র্যাউন তার Muhammad : A Very Short Introduction বইয়ের ভূমিকায় কয়েকটি দৃশ্যের শাব্দিক অঙ্কন করে বলেন, এ দৃশ্যগুলো আমি যা এ বইয়ে লিখব তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী, অনেক অর্থসমৃদ্ধ। ড্যানিশ পত্রিকায় নবী মোহাম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপা হয়েছে, সে জন্য পৃথিবীজুড়ে শহরে শহরে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে। অথচ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে কটুক্তি, কার্টুন বেরুচ্ছে, সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। কোন হৈ চৈ নেই। এ থেকে বুঝা যায় মোহাম্মদ কত অজস্র মানুষের অন্তরে ভালোবাসার রাজত্ব করছে। তাঁর তিরোধানের দেড় হাজার বছর পরেও কত অগণিত হৃদয় ভালোবাসায় তাকে সিক্ত করে রেখেছে। প্রতিদিন মদীনায় গ্রিল দিয়ে বেস্টন করা তাঁর সমাধির পাশে যেতে কত লক্ষ মানুষ উদগ্রীব হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে! সকাতর কন্ঠে বলছে ‘শান্তি ও সম্মান নিবেদিত হোক তোমার প্রতি হে রাসূল’। এক ইন্ডিয়ান বৃদ্ধ হুইল চেয়ারে বসে আত্মীয় ও গার্ডের সহযোগিতায় সেখানে গিয়ে টপ টপ করে চোখের অশ্রু ঝরিয়ে বলছে, ‘হে প্রভু, আমাকে মদীনায় মৃত্যু দাও। তোমার নবীর কাছাকাছি কবরে সমাহিত করো।’ এসব অভিব্যক্তি প্রমাণ করে মোহাম্মদ বর্তমান পৃথিবীতে এখানো কত প্রাসঙ্গিক এবং প্রভাবশালী। জনাথন আরো লিখেন, আমি এক ইন্দোনেশিয়ান মুসলিমকে জিজ্ঞাসা করলাম, মোহাম্মদ সম্পর্কে তোমাদের অনুভূতি কি? তিনি উত্তরে বললেন- He is our dear Prophet তিনি আমাদের প্রিয় নবী।” এ উত্তরে ‘আমাদের’ শব্দটি খুব সহজে বলে দেয় মুসলিমদের অন্তরে তাঁর সংযোগ কত ঘনিষ্ট ও নিবিঢ়। তার ভাষায় “He is a light kindled in a Muslim’s heart from a young age —-”. “মোহাম্মদ হলেন মুসলিমদের অন্তরের আলো যা প্রজ্বলিত করা হয় শৈশব হতে।”
জনাথনের ভূমিকাটি বিমোহিত হয়ে পড়ে অন্য বইয়ের দিকে হাত বাড়ালাম। লেখকের নাম কারেন আর্মস্ট্রং। “Muhammad : A Biography of the Prophet”. একই লেখকের আরেকটি বই “Muhammad : A Prophet for Our Time”. কারেন আর্মস্ট্রং নামটি আমার কাছে আগেই পরিচিত ছিল। একবার দুবাইর বিশাল এয়ারপোর্টে ট্রানজিটে এদিক ওদিক পায়চারি করার সময় ‘ডাব্লিও এইচ স্মিথ’ বুকশপে ঢুকেছিলাম। সেল্ফে সাজানো বইগুলোর শিরোনামে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলাম। একটি বইয়ের নাম আমাকে থামিয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে তাক থেকে নামালাম। ‘History of God’ ছিল বইয়ের নাম। ঈশ্বরের ইতিহাস আবার কি? ভাবলাম বইটি কিনে ফেলি পরবর্তী ফ্লাইটে বসে পড়ে নিব। বইটির লেখক ছিলেন ‘কারেন আর্মস্ট্রং’। তিনি মূলত খৃষ্টান মহিলা দল (Conent)-র সদস্য ছিলেন। সাত বছর যাবৎ সেখানে যুক্ত ছিলেন। সেখানে তাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে দাবি করে গার্ডিয়ানে একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। সে সম্পৃক্ততা ছেড়ে পরে তিনি অক্সফোর্ডে ‘ইংরেজি’ সাহিত্যে পড়াশুনা করেছেন। পরবর্তীতে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং বই প্রকাশ করেছেন। তার বইগুলো খুবই জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত। তিনি মিডিয়াতেও বেশ সক্রিয়।

হযরত মোহাম্মদ (স:) নিয়ে বই রচনা করেছেন দুটি। বইয়ের ভূমিকায় তিনি পাশ্চাত্যের মানুষের হীনমন্যতার চিত্র এঁকেছেন। তিনি বলেছেন- ছোট কালে না ঘুমালে বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য বলা হত ‘মোহাম্মদ’ আসছে। একটি ভয়ঙ্কর কিছুর নাম ছিল ‘মোহাম্মদ’। শৈশব মানসে এমনই চিত্র আঁকা হত। দীর্ঘদিনের ক্রুসেড যুদ্ধের ফলে তাদের মনে বংশ পরম্পরায় এ ভীতি সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি তাই মোহাম্মদের জীবনীকে পুন: পাঠ করে পাশ্চাত্যের মানুষের কাছে তার সঠিক শান্তিময় অবয়ব বিমূর্ত করতে চেয়েছেন এ বইয়ে। আমি দীর্ঘ সময় বইগুলোতে এমন ডুবেছিলাম ভুলেই গিয়েছিলাম নীচে বাচ্চারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তবে কিছু সময় এখানের পাবলিক লাইব্রেরীতে এসে বুঝতে পেলাম দেড় হাজার বছর পূর্বে আভির্ভূত মরুভূমির নবীটি টেমসের মোহনায় অবস্থিত এ শহরেও পদার্পন করেছেন। তিনি যেমন ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন কাঁচা-পাকা সকল ঘরেই তার মিশন পৌঁছে যাবে কেউ চাক বা না চাক। তা-ই সত্য। আমি এ শহরে প্রবেশের কয়েক ঘন্টা আগে স্বপ্নে দেখেছিলাম মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স:) একটি গাড়িতে করে দু’জনের মাঝে বসে যাচ্ছেন আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। এ স্বপ্নে হয়ত এমন নির্দেশনা ছিল যেন তার মিশনকে এ শহরে ছড়িয়ে দেই। আলহামদুলিল্লাহ, এখানে বড় একটি চার্চ মসজিদ ও ইসলামী একাডেমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতি রবিউল আউয়ালে মহানবীর (স:) জীবনী অমুসলিমদের মাঝে বিতরণ করা হয়। ড. মোহাম্মদ লাইছ সঙ্কলিত ‘Muhammad (Saw) : 1001 Universal Appreciation’ শীর্ষক বইটির শত শত কপি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। উচ্চ পদস্থ বহু কর্মকর্তারাও বইটি হাতে পেয়েছেন। এ শহরের প্রতিটি ঘরে ঘরে মুহাম্মদ (স:) কে পৌঁছে দেয়া আমাদের লক্ষ্য। প্রতিটি ব্যক্তির চেতনায় তিনি হবেন সম্মানের পাত্র, শান্তির দূত ও মর্যাদার প্রতিমূর্তি এবং তাঁর ধর্ম একমাত্র প্রশান্তির ঠিকানা। মহান প্রভু আমাদের কাজকে মসৃণ করে দেন, করে দেন গতিশীল ও প্রাণবন্ত। ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button