বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত করছে ভারতের অসংখ্য বাঁধ

Dampসরদার আবদুর রহমান: চীন ব্রহ্মপুত্র নদের উপর একটি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করায় ভারত ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। তিব্বতে নির্মিত এই প্রকল্প নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে সম্প্রতি ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া মন্তব্য করেছে, ‘এই নদের পানি বণ্টন নিয়ে কোনো চুক্তি নেই। ব্রহ্মপুত্র নিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের মধ্যে জরুরি চুক্তি প্রয়োজন।’ বাংলাদেশেরও কোনো কোনো মহল এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হবার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ভারত যখন বাংলাদেশমুখি প্রায় সবগুলো অভিন্ন নদীতে অসংখ্য বাঁধ, ব্যারেজ ও প্রকল্প তৈরি করে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তির পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে, সেগুলো তারা কোন্ চুক্তির ভিত্তিতে করছে?
টাইমস অব ইন্ডিয়া’র বক্তব্য, ‘ব্রহ্মপুত্র নদে চীন নির্মাণ করেছে জ্যাম বা জাংমু পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ ছাড়া আরো ১০টি ড্যাম নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এর মধ্যে একটি ড্যামের পরিকল্পনা এমনভাবে নেয়া হয়েছে যে, তা হবে বিশালাকায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ করা হবে এখান থেকে। চীনের ভেতরেই অবস্থিত থ্রি জর্জেস ড্যামের দ্বিগুণ ক্ষমতা হবে একেকটি ড্যামের। এ জন্য খরচ ধরা হয়েছে কয়েক হাজার কোটি ডলার। এ বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশের সতর্কতা প্রয়োজন।’
ভারতীয় এই সংবাদপত্রের অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে হাহাকার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের আর্তচিৎকারের সময় তারা নীরব থাকে কোন্ যুক্তিতে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কোনো চুক্তি দূরে থাকুক, সামান্য আকার-ইঙ্গিত ছাড়াই ভারত তার অংশে বাংলাদেশগামি নদীগুলোতে অজস্র প্রকল্প নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। এ জন্য তারা কোনো আন্তর্জাতিক আইন কিংবা রীতি-নীতিরও তোয়াক্কা করে না।
গঙ্গা বেসিনে চুক্তি ছাড়াই অসংখ্য প্রকল্প: ভারত তার বহুসংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। শুধু ফারাক্কা নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করছে ভারত। এর সঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য ছোট-বড় কাঠামো। নতুন করে উত্তরখণ্ড রাজ্য সরকার ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার ৪টি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘নি¤œগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ এবং ‘পূর্বগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’। এ ধরনের প্রকল্পের হাজার হাজার কি.মি. খালের মাধ্যমে তারা গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ‘উপর গঙ্গা খাল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কি.মি. খাল, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ প্রায় ১৬শ’ কি.মি. এবং ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কি.মি. খাল খনন করা হয়েছে। এছাড়াও ভারত গঙ্গার ‘বাড়তি’ পানি কাজে লাগিয়ে ৩ লাখ ১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেবার জন্য ‘পূর্ব গঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ তৈরি করেছে। এর মোট দৈর্ঘ প্রায় ১৪০০ কি.মি। এসব ক্যানেল প্রকল্প চাঙা রাখতে নিয়মিতভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারতের ভেতরের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানির উৎস বৃদ্ধির সহায়ক উপনদীগুলোতেও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পানির জন্য হাহাকার করলেও ফারাক্কায় পানি না থাকার অজুহাতে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো ভারত অনেক ভেতরেই বাঁধ দিয়ে এসব নদীকে বন্ধ্যা করে রেখেছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রসহ প্রধান নদীগুলো এসব উপনদী থেকে বিপুল পানি প্রবাহ লাভ করে থাকে। গঙ্গা নদীতে পানির প্রবাহ বৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক নদী হলো ভাগিরথী, ঘাগরা, কোশি ও গণ্ডক। নেপাল থেকে উৎসারিত এসব নদীতেও ভারত নিজ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। গঙ্গার উজান থেকে ভাটির দিকে বাম পাশে অবস্থিত এসব নদী সারা বছর গঙ্গাকে নাব্য রাখতে অনেক সহায়ক হয়। গঙ্গার অন্যতম উপনদী গোমতি, রামগঙ্গা, কর্ণালী, ঘাগরা, ধাউলিগঙ্গা প্রভৃতিতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মূল গঙ্গার প্রবাহ।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ধারা: তথ্যে প্রকাশ, ভারত তার পরিকল্পনা মোতাবেক গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র দু’টি অববাহিকায় পানির ৩৩টি সঞ্চয়াগার নির্মাণ করবে। প্রতিটি সঞ্চয়াগারের ধারণ ক্ষমতা হবে ১ লাখ ৫০ হাজার কিউসেক। অর্থাৎ ৩৩টি সঞ্চয়াগারের সর্বমোট ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ৫০ লাখ কিউসেক পানি। এই পানি ভারতের পূর্ব, মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। এর আওতায় থাকবে ৩ কোটি ৫০ লাখ হেক্টর জমি। পাশাপাশি উৎপাদন করা হবে ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ। ইতোমধ্যে স্থাপিত বাঁধের মাধ্যমে ভারত ৩৫ লাখ কিউসেক পানি ধরে রেখেছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত এসব সঞ্চয়াগারের মাধ্যমে ধরে রাখতে সক্ষম হবে ৫০ লাখ কিউসেক পানি। বাড়তি ১৫ লাখ কিউসেক পানির ঘাটতি বাংলাদেশকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে। গঙ্গার পর ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহার করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাবে দক্ষিণ ভারতের কাবেরী নদীতে। এ জন্য ১ হাজার ৪৬৬ কিলোমিটার খাল খনন করা হবে। ফারাক্কা থেকে কাবেরী নদী পর্যন্ত মূল সংযোগ খাল ছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট খাল কাটা হবে। এর সঙ্গে তিস্তার পানি খাল কেটে মহানন্দায় শুধু গাজলডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোই শেষ নয়, উজানে ‘তিস্তা-মহানন্দা ক্যানেল’ নামের প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ কি.মি খাল কেটে তিস্তার পানি মহানন্দায় সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। আর মহানন্দায় একটি ব্যারাজ প্রকল্পের সাহায্যে এই বাড়তি পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশকে কতটুকু পানি দেয়া হবে না হবে তা নিয়ে এক কৃত্রিম দরকষাকষি চালানো হচ্ছে। এছাড়াও ভারত তিস্তার উপরে বহু সংখ্যক পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের জন্য বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে তিস্তার পানি ভারতের অভ্যন্তরেই থেকে যাবে।
মহানন্দাকেন্দ্রিক প্রকল্প: বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া সীমান্তের বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের পশ্চিম-উত্তর কোণে মহানন্দা নদীর ওপর বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ১৯৭৯-৮০ সালে ‘ফুলবাড়ি ব্যারেজ’ নামে খ্যাত এই বাঁধটি তৈরি করে তারা। এই ব্যারেজের মাধ্যমে তিনটি ইউনিটে সাড়ে ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৬৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই সঙ্গে প্রতিবছর শুষ্ক মওসুমে ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের সেচ কাজ করছে। বিপরীতে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার ভুগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সেচ কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। বাঁধের মাধ্যমে পানি আটকে রাখায় শুষ্ক মওসুমে জেলার নদ-নদীগুলোকে মরা নদীতে পরিণত করছে। এই সঙ্গে প্রতিবছর শুষ্ক মওসুমে ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের সেচ কাজ করছে।
বরাক ভ্যালিতে ৩০ প্রকল্প: ভারত আন্তর্জাতিক নদী বরাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ছোট-বড় এসব প্রকল্প-বাঁধের মাধ্যমে ভারত প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেচ ব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। এসব বাঁধের কারণে বরাক নদীতে কার্যত ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ হবে বরাকের পানি থেকে বঞ্চিত। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা নদী পানিশুন্য হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। আন্তর্জাতিক নদী বারাক একাধারে ভারত, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে এটি ত্রিদেশীয় তথা আন্তর্জাতিক নদীর মর্যাদা লাভ করেছে। পাহাড়ি নদী হবার কারণে বিপুল খরস্রোতা বারাক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে অবদান রেখে চলেছে। ভারতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভারত প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১শ’ কিলোমিটার উজানে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণে ভারতের মনিপুরের নাগরিকরাও প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বরাক ও তার শাখা ও উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই কাজ চলছে।
এর আগে এক রিপোর্টে দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্রে চীনের বাঁধ-প্রকল্প নির্মাণে বাধা দিতে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়। দাবি উঠেছে, ভারত এসব বাঁধ ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নিক। তবেই চীনের বিরুদ্ধে ভারতের পাশে থাকা বাংলাদেশের জন্য যৌক্তিক হতে পারে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button