মজলুম দেশগুলোর একটি মানচিত্র আঁকা প্রয়োজন

বর্তমান বিশ্বেতো বহু দেশ। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো যুদ্ধ ও সংঘাত যেন শুধু মুসলিম দেশগুলোতেই অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এমন চিত্রে প্রশ্ন  জাগে, তাহলে এর পেছনে কি কোনো পরিকল্পনা সক্রিয় রয়েছে? সাম্প্রতিককালে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সংঘাত বিপর্যস্ত বিশ্বের একটি মানচিত্র যদি আঁকা হয়, তাহলে সেখানে দেখা যাবে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, মিসর ও সিরিয়ার নাম। কিন্তু বর্তমান সভ্য দুনিয়ায় জাতিসংঘসহ ইনসাফ ও মানবাধিকার রক্ষার নানা প্রতিষ্ঠান থাকার পরও আমাদের এমন চিত্র দেখতে হবে কেন? এরপরও কি আমাদের বলতে হবে যে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আলো ঝলমলে ও গতিময় পরিবেশে মানবজাতি প্রকৃতই উদারতায়পুষ্ট এক সভ্য পৃথিবীতে বসবাস করছে?
গত শতাব্দীতে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের এক দীর্ঘ পরিক্রমা লক্ষ্য করেছি। পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের দ্বন্দ্বে পৃথিবী তখন প্রায় দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের বিনম্র বার্তাও আমরা লক্ষ্য করেছি। তবে বাস্তব সত্য হলো এই যে, স্নায়ুযুদ্ধে বিজয়ী হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।এরপর দাপুটে পরাশক্তি হিসেবে একচ্ছত্রভাবে পৃথিবীতে ছড়ি ঘুরাতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আমরা একে একে লক্ষ্য করলাম ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় আগ্রাসী যুদ্ধের নানা ছলাকলা। মার্কিন প্রশ্রয়ে ফিলিস্তিনবাসীদের উপর ইসরাইলের জুলুম-নিপীড়ন-হামলা তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম আমেরিকা ও ইসরাইলের সমর্থনে মিসরে গণতান্ত্রিক মুরসি সরকারকে হটিয়ে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের ভয়াবহ চিত্র। সিরিয়ায় চলছে গৃহযুদ্ধ। সিরিয়ার সঙ্কটকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালাতে চেয়েছিল দেশটির উপর। এ নিয়ে আবার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে। উভয় পক্ষের মিত্র রাষ্ট্রগুলোও এতে  জড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পিছনের দিকে তাকাতে গিয়ে অনেকেই বলছেন, এখনকার চাইতে গত শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধের সময়টাই ভালো ছিল। তখন শক্তিশালী দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটা ভীতির ভারসাম্য কার্যকর ছিল। নানা হুমকি-ধমকির পরেও কেউ কারো উপর হামলা চালাতে সাহস করতো না। উভয় পরাশক্তি তখন নিজেদের সমর্থনের বলয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতো। এখনকার মতো যখন-তখন  হামলা চালিয়ে ছোট রাষ্ট্রগুলোকে বিপর্যস্ত করে দিতো না। ইতিহাসের এইসব ঘটনা স্মরণ করে এখন অনেকেই বলছেন, একক পরাশক্তির বদলে বরং পৃথিবীতে দু’টি সমানে সমান পরাশক্তি থাকাই ভালো। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে যে বাক-বিতন্ডা শুরু হয়েছে তাতে কেউ কেউ মনে করছেন, পৃথিবী বোধহয় আবার স্নায়ুযুদ্ধের সেই পুরানো আমলের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তবে পর্যবেক্ষক মহল এমন ভাবনাকে এখনও প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করছেন।
সিরিয়া ইস্যুকে নিয়ে এখন মার্কিন ও রুশ বলয়ের মধ্যে বাক-বিতন্ডার নানারূপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যকে নিয়ে উপহাস করতে গিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমীর পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, যুক্তরাজ্য তো একটি ছোট দ্বীপ, তাদের কথা কেউ কানে তোলে না। আর বর্তমান সময়ে কূটনীতিক ক্ষেত্রে একে টেনে আনা অপ্রাসঙ্গিক। সিরিয়ায় হামলা চালানোর ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের উৎসাহকে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে পেসকভ এমন কথা বলেন। শুধু তাই নয়, তিনি রাশিয়ার আভিজাত্যের কথাও বৃটিশদের স্মরণ করিয়ে দেন। পেসকভের বক্তব্যে বেশ ক্ষেপে গেছেন ডেভিড ক্যামেরুন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে পেসকভের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, যুক্তরাজ্য এখনও বিশ্বে শক্তিশালী দেশ। সিরিয়ার জন্য শান্তি পরিকল্পনা তৈরিতে দায়িত্ব পালনকারী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যও অন্যতম। এদিকে আমেরিকার যুদ্ধংদেহী নীতির সমালোচনা করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমীর পুতিন বলেছেন, বিভিন্ন দেশে সামরিক হামলা চালানো মার্কিন সরকারের সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। ‘রাশিয়ার পক্ষ থেকে একটি সতর্ক আবেদন’ শীর্ষক নিবন্ধে পুতিন আরো বলেন, ‘তুমি হয় আমাদের সঙ্গে, নয় আমাদের বিরুদ্ধে’ নীতির আওতায় আমেরিকা বিভিন্ন দেশে জোটবদ্ধ যে বর্বর সামরিক হামলা চালাচ্ছে তা গণতন্ত্রের জন্য মোটেই আদর্শ হতে পারে না। তিনি আরো বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই শক্তির ভাষা বন্ধ করতে হবে এবং সত্য কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের পথে ফিরতে হবে। পুতিন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে আরো বলেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া সিরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালালে বিশ্ব সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কথা তো ভালোই বলেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো বিশ্ব সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস হওয়ার কিছু বাকি আছে কি? জাতিসংঘসহ বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো ন্যূনতম মানবিক নীতি অনুসরণ করলেও ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান বহু আগেই হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার একটি কলঙ্কজনক দিক হলো, মুসলিম দেশ ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-নির্যাতন হোক না কেন তা দূর করতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে চায় না। কেউ কেউ শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করেন এবং কেউ বা কূটনৈতিক চাতুর্যে মূল বিষয়টি এড়িয়ে যান। এই তো হলো বর্তমান বিশ্বের আলো ঝলমলে জাহেলিয়াতের এক চিত্র। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ‘ইসলাম ভীতি’ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ঐ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় মুসলিম অধ্যাপক জন. এল এসপোসিতো বলেন, ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার ১২ বছর কেটে গেলেও বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের কলঙ্কিত ও হেয় করতে ইসলামভীতি সৃষ্টির উপায়-উপকরণগুলো এখনো সচল রাখা হয়েছে। তাছাড়া পশ্চিমারা তাদের যেকোনো বিরোধী পক্ষকে প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে যেতে সন্ত্রাসবাদের লেবেল ব্যবহার করছে। অধ্যাপক এসপোসিতো আরো বলেন, আপনারা যা দেখছেন এগুলো যুক্তিহীন ভয়। আজকে মূল ধারার সমাজে প্রতিদিনকার আলোচনায় ইসলামের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। তাদের ঐসব আলোচনা ও বক্তব্যই সবখানে গৃহীত হচ্ছে এবং এগুলো তাদের গতানুগতিক উক্তি যার কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ বা সারাংশ নেই। এমনকি জনসম্মুখেও তাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় না। ইসলামভীতি ও গণমাধ্যম প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, নব্বই এর দশকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামভীতির আধুনিক প্রোপাগান্ডার যে সূচনা হয়েছিল তার উত্থান ও ব্যাপকতা এখন আমরা লক্ষ্য করছি। ইসলামভীতির এই প্রচারণা মূলত ৭টি মার্কিন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতো। গত এক দশকে ইসলামবিরোধী প্রচারণা ও তাদের ওয়েব সাইটগুলো পরিচালনার জন্য ৪ কোটি ২৫ লাখ ডলার সরবরাহ করেছে। প্রফেসর এসপোসিতো বলেন, আমি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারি যে, ইসলামভীতি প্রবণতা বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো দ্বারাই বেশি বিকশিত হচ্ছে। এই মাধ্যমগুলো গতানুগতিক গণমাধ্যম থেকে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। অবাক ব্যাপার হলো, কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই কেবল যুক্তিহীন ভীতির উপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১টি রাজ্য শরিয়াবিরোধী আইন পাস করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শরিয়াবিরোধী আইন করার জন্য তাদেরকে কে অনুরোধ করেছে? ঐসব রাজ্যের জনগণ তো জানেই না শরিয়া কি জিনিস। অথচ তাদের শরিয়াবিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রসঙ্গত এসপোসিতো ঐসব ব্যক্তির সমালোচনা করেন, যারা ইসলামপন্থী একটি সরকারের ব্যাপারে ভীত হয়ে মিসরের সামরিক অভ্যুত্থানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এটাকে তিনি যুক্তিহীন ইসলামভীতির একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেন। তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর মিসরের ভেতরে ও বাইরে ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে একই ধরনের অযৌক্তিক ভীতি ছড়ানো হয়েছিল। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নরম্যান গেরি কিনকেল স্টেইনও প্রফেসর এসপোসিতোর বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করেন।
আগেই বলেছিলাম, বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধবিধ্বস্ত ও মজলুম দেশগুলোর একটি মানচিত্র আঁকা হলে মুসলিম দেশগুলোকেই বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যাবে। আর এর পেছনে কাদের পরিকল্পনা ও তৎপরতা সক্রিয় রয়েছে তাও বিশ্ববাসীর অজানা নয়। এরপরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং আমেরিকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ইসলাম। মার্কিন নওমুসলিম মিসেস গ্ল্যান্ডা ওরবিন সম্প্রতি বলেন, মার্কিন সমাজে নৈতিক অধঃপতন বাড়তে থাকায় সেখানে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ বেড়েই চলেছে। ফলে অনেক মার্কিন নাগরিক এখন গ্রহণ করছে ইসলাম ধর্ম। এমন প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, মুসলমানদের হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। মুসলমানরা বর্তমান সময়ে যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারে, তাহলে শুধু মুসলমানরাই যে কাক্সিক্ষত মর্যাদা ফিরে পাবে তা নয়, পৃথিবীর মানুষও পেয়ে যাবে কাক্সিক্ষত শান্তিময় সমাজ। কারণ, ইসলামের লক্ষ্য আমেরিকা, রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রকে পরাজিত করা নয়, বরং প্রকৃত লক্ষ্য হলো, অন্যায়-অবিচার ও নীতিহীনতাকে পরাস্ত করে মানুষকে মানবিক মর্যাদায় উন্নীত করা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button