অপসংস্কৃতির লালন আভিজাত্যের পরিচায়ক হতে পারে না

Opoমুহাম্মদ আমিনুল হক
‘বৃক্ষ তোর নাম কী? ফলে পরিচয়’ এ ধরনের একটি প্রবাদ বাক্য আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। কারও কাছে কেউ আম নিয়ে হাজির হলে তার দৃষ্টিপটে আম গাছের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। কেউ আনারস নিয়ে আসলে আনারস গাছের কথা মনে উঠে। তেঁতুল দেখলে কেউ খেজুর গাছের কথা মনে করে না। ফল দিয়েই বিবেচনা করা হয় গাছটি কোন জাতের, কোন অঞ্চলের এবং কেমন তার গুণাগুণ। তেমনি একজন মানুষ দেখলে আঁচ করা যায় তিনি কোন দেশের, কোন ধর্মের, কোন গোষ্ঠীর। তিনি শিক্ষিত নাকি মূর্খ তা-ও আন্দাজ করা যায়। আমরা মানুষের এই গুণগুলো পরিমাপ করি সংস্কৃতি নামক দাড়িপাল্লা দিয়ে। মাথায় সিঁদুর, হাতে শাখার চুড়ি পরা কোনো মহিলাকে দেখলে বিনা দ্বিধায় বলা যায় তিনি হিন্দু। বোরখা পরিহিতা কোনো মহিলাকে দেখলে অনায়াসে বলা যায় তিনি মুসলিম। পথে-ঘাটে কেউ কাউকে যদি বলে আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ আবার কেউ যদি বলে আদাব তাহলেও আমরা ধরে নেই কে কোন ধর্মের।
কেউ অনর্গল আরবী বলে গেলে তাকে যেমন অ্যারাবিয়ান বলি আবার কেউ ইংরেজিতে কথা বললে তাকে ইংরেজ বলি। এমনিভাবে উঠা-বসা, কথা-বার্তা, কুশল বিনিময়, খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান, ধর্ম-কর্ম মোট কথা একজন ব্যক্তির সকল আচার-আচরণ প্রমাণ করে তিনি কোন দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন। এতে তার জাত যায় না, তার আভিজাত্য সম্পর্কেও জানা যায়। আর নিজের আচার-আচরণের মাধ্যমে নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরলে কারও মান-সম্মানও কমে না। বরং এর মাধ্যমে তিনি তার ব্যক্তিত্ব ও স্বজাতীয়তাকে টিকিয়ে রেখে নিজ ও জাতিকে সমুন্নত করেন। আর যে ব্যক্তি নিজ সংস্কৃতি ভুলে অন্যের সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে চায় তাকে আমরা সেই কাকের সাথে তুলনা করতে পারি, যেকিনা ময়ূর সাজতে চেষ্টা করে। কেননা, কাক কোনদিন ময়ূর হতে পারে না কিংবা ময়ূরও কাকের মতো হতে পারে না।
আমরা বাংলাদেশী। বাংলা আমাদের ভাষা। ইসলাম এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম। আমাদের আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি-কালচার। জারি, সারি, বাউল, ভাওয়াইয়া, পুঁথি, নজরুল গীতি, আধুনিক গান, গজলসহ অনেক কিছুতেই আমাদের নিজস্বতা আছে। যার মাধ্যমে ফুটে উঠে আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা, আমাদের প্রেম-প্রীতি ও একে অপরের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধ।
এদেশের অধিকাংশ মানুষের ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আজানের সুর ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ শুনতে শুনতে। এদেশে হিন্দু-মুসলিম, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের লোকজন একসাথে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। এদেশে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। পালিত হয় মাতৃভাষা দিবস। স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস তো আছেই। এসবই পালিত হয় সম্মিলিতভাবে। ধর্মীয়ভাবে মুসলিমগণ দুই ঈদ এবং হিন্দুরা দুর্গা পূজা উদযাপন করেন মহাসমারোহে। একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আছে কি নেই এটি অনুমান করা যায় তার সংস্কৃতির অস্তিত্ব দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, সৌদি আরবে বিশ্বের যে কোনো নারী সে যে ধর্মেরই হোক না কেন জনসম্মুখে বোরখা ছাড়া চলাচল করতে পারবেন না। এটি সৌদি আরবের আইন, এটিই তাদের সংস্কৃতি। এখানে বহু হিন্দু, খ্রিস্টান ও ইহুদী দেখা যায় যে, তারা বোরখা পরে বাজার-ঘাট ও পর্যটন এলাকায় ঘোরাফেরা করছেন। আবার পশ্চিমা বিশ্বে গেলে ঠিক এর বিপরীত দৃশ্য চোখে পড়বে। ওইসব দেশে কোনো নারী অর্ধ-উলঙ্গ হয়ে হাঁটা-চলা করলে কেউ কোনো মাইন্ড করবে না। এটাও এক ধরনের সংস্কৃতি; হোক তা মন্দ ও দৃষ্টিকটু।
কিন্তু আমাদের দেশে কী চলছে এসব? ইদানীং বাংলাদেশের গোটা জনপদে যে সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের আনাগোনা চলছে এবং তারা যা যেভাবে পরিবেশন করছেন তা কি আদৌ আমাদের সংস্কৃতি? বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে কি কিছুই নেই? আমাদের বাপ-দাদারা কি আমাদের জন্য কোনো কিছুই রেখে যাননি? এসব প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খায় হরহামেশা।
গত ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হলো টি-টুয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপের ‘সেলিব্রেশন কনসার্ট’। বৈশ্বিক পরিসরে নিজের দেশ এবং সংস্কৃতিকে পরিচিত করার সুযোগ কোনো দেশই হাতছাড়া করে না। এজন্যই আমরা সাধারণত দেখি যে, আন্তর্জাতিক যেকোনো আয়োজনে আয়োজক দেশ নিজ দেশের কৃষ্টি-কালচার বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ সমস্ত ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান উল্টো! বিশ্ব দরবারে নিজকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েও আমরা পার্শ্ববর্তী ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরছি বারবার।
আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসলেই এই ধরনের দৈন্য যেন আরও প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ এরাই আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খৈ ফুটায়। সেলিব্রেশন কনসার্টের আয়োজক বাংলাদেশ অথচ অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়নি এটি বাংলাদেশের কোনো স্টেজে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিখ্যাত শিল্পি এআর রহমান পুরো মঞ্চ মাতিয়েছেন তার ১৩০ সদস্য বিশিষ্ট সহশিল্পীদের নিয়ে। বাংলাদেশের দু-চারজন যা সুযোগ পেয়েছেন তা পেয়েছেন মূল অনুষ্ঠানের আগে ও পরে। কেউ কেউ দাওয়াত পেয়েও মঞ্চে উঠার সুযোগ পর্যন্ত পাননি। ‘তুম তাক’, ‘মিতওয়া রে’, ‘তেরে পেয়ার বিনা’, ‘সাস মে তেরি’, ‘জিয়া রে’, ‘কেয়া করোগা’, ‘হাস্তি রাব্বি জালল্লাহ’, ‘কুন ফায়াকুন’ এবং ‘ইয়া খাজা জী, ইয়া মঈনুদ্দীন’, ‘মাইয়া মাইয়া’, ‘মাহি ভে’, ‘রাধা কৃষ্ণা জলে’ এবং ‘হাম্মা হাম্মা’ ইত্যাদি গানগুলো যে এআর রহমান গাইলেন তা-কি ষোলকোটি বাংলাদেশী জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে? আমরা কি পারতাম না এআর রহমানকে আমাদের দেশের গানগুলো শুনিয়ে বিশ্বময় প্রচারের ব্যবস্থা করতে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই এদেশে ভারতীয় শিল্পীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ছোট-বড় সব পরিসরে ভারতীয় ছাড়া আমাদের কোনো প্রোগ্রাম যেন সফল হতে পারে না! এই সরকারের গত টার্মে শাহরুখ খান এসেছিলেন বিশাল বহর নিয়ে। অর্ধ উলঙ্গিনীদের নিয়ে মঞ্চ মাতিয়েছিলেন তিনি। সে মঞ্চে তো বাংলাদেশী কেউ গাইতেই পারেনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী শাহরুখের নাচ দেখার জন্য চেয়ার না পেয়ে খালি মাঠে বসে পড়েছিলেন। যে দেশের একজন প্রতিমন্ত্রী ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যদেশের একজন গায়কের গান শোনার জন্য এবং অশ্লীলনৃত্য দেখার জন্য ওরকম তন্ময় হয়ে পড়েন সে দেশের ভবিষ্যৎ প্রন্মের মগজে সুস্থ সংস্কৃতি লালনের সুযোগ কোথায়? অসুস্থ সংস্কৃতি, পরদেশী সংস্কৃতি লালন-পালন যেভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে পরিণত হয়েছে সেভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে আমাদের স্বকীয়তা বলতে আর কিছু থাকবে না।
প্রতিটি দেশ যখন তার নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপরে তোলার চেষ্টায় করছে, তখন আমাদের দেখতে হয় বিপরীত দৃশ্য। আমরা যেন নিজস্বতা বাদ দিয়ে এখন গোলামিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। ইন্টারনেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লিখে সার্চ দিলে মাকসুদা নামের এক বাংলাদেশী নারীর উন্মুক্ত বক্ষ ভেসে উঠে, যেখানে লেখা রয়েছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’! আমেরিকান অ্যাপারলেস কোম্পানির এই বিজ্ঞাপন নিয়ে সারাবিশ্বে সমালোচনার ঝড় বইছে অথচ বাংলাদেশ সরকারের এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি ন্যূনতম দরদ থাকলে বিষয়টি নিয়ে সরকার অনেক কিছুই করতে পারত।
বাংলাদেশী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রতিনিয়ত যে বিজ্ঞাপনগুলো প্রচারিত হয় তা দেখলে বুঝা যায়, এদেশের সংস্কৃতি লালনে সরকারের কতটা অনীহা। অধিকাংশ টিভি বিজ্ঞাপন এখন অশ্লীলতায় ভরে গেছে। ভারতীয় অপসংস্কৃতির বিষ ঢুকে পড়েছে এদেশে নির্মিত নাটক-সিনেমাগুলোতেও। টিভি নাটকের অধিকাংশগুলোতে থাকে প্রকাশ্য চুমুর মহড়া, পরকীয়া প্রেম, সংসার ভাঙা আর নেশার রাজ্যে বুঁদ হওয়ার গল্প। এ কারণেই এদেশে এখন ঐশীদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ওরা এখন ১৮ পেরুনোর আগেই শত পুরুষের সংস্পর্শে যাওয়ার জন্য ছটফট করে। রাত-বিরাতে মদ-গাঁজার আসরে বুঁদ হয়ে থাকে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে খুন করেত দ্বিধা করে না। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে কত মাতামাতি দেখলাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে তারা কত দাবি, কত আস্ফালন করল। কিন্তু এসব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান কই? এগুলো কি স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা নয়? আসলে জাগরণ মঞ্চের লোকজনও তো জানে না তাদের সংস্কৃতি কী? তা না-হলে তারা কি মঙ্গল প্রদীপ, মোমবাতি জ্বালিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়তে পারতেন?
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে ইসলামী কৃষ্টি-কালচারসহ আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশের জনগণ যে কালচার লালন করে আসছিল সেটাকে প্রমোট করাটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু না, এদেশে এখন কোরআন পোড়ানো হয়। কোরআন পুড়িয়ে উল্টো দোষ চাপানো হয় হুজুরদের ওপর! রাসূল (সা.) কে ব্যঙ্গ করা হয়। ব্যঙ্গ করা হয় তাঁর সুন্নাতকে। যারা রাসূলকে ব্যঙ্গ করে তাদেরকে বানানো হয় বীর। রাষ্ট্রীয়ভাবে গালি-গালাজ করা হয় সকলের কাছে অতি সম্মানিত আলেমকুলকে। টুপি-দাড়িওয়ালাদের অপমান করা হয়। হিজাব পরিহিতা নারীদের করা হয় হয়রানি।
যে দেশে যাত্রা-পালা, উলঙ্গ নাচ-গান বন্ধ হয়ে কোরআন তেলাওয়াত, ওয়াজ-মাহফিল, ইসলামী সঙ্গীতসহ ইসলামী কৃষ্টি-কালচার পালিত হওয়ার কথা, সেদেশে এখন অশ্লীলতা আর বেলেল্লাপনার মহা-আয়োজন চলছে। তাও আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়! ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মতো পবিত্র অঙ্গনে ইমাম মুসল্লিদের সামনে মার্কিন যুবক-যুবতীর ব্যালে ড্যান্সও আমাদের দেখতে হয়। মোটকথা এদেশের সংস্কৃতিকে পুঁতে ফেলার সব আয়োজন এখন চূড়ান্ত। কারণও আমাদের জানা আছে। তা হলো, জনগণের চোখে রঙিন চশমা পরিয়ে দিয়ে ভিন্নদিকে ডাইভার্ট করা। আর এই সুযোগে নিজেদের ক্ষমতার মসনদে বেশিদিন টিকে থাকা। কিন্তু নিজের সর্বনাশ করে, জাতিকে বিনাশ করে ক্ষমতায় থাকায় লাভ আছে কি? গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি দিলে যেমন লাভ হয় না, তেমনি নিজের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে সম্মানিত জাতি হিসেবে টিকে থাকাও যায় না।
লেখক : গবেষক, কিং আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটি, জেদ্দা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button