যাকাত: অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধিতার অনন্য সমাধান
মাইমুনা সুলতানা: একটিবার ভাবুন তো, ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে দরজার বাইরে করুন চাহনিতে হাত পেতে থাকা ছোট্ট শিশুটি যদি আপনার বা আমার হতো? অবশ্য এমনটি ভাববার সাহস আমাদের নেই, ভাবতে গেলেই ভেতরটা আন্দোলিত হয়ে উঠে। অথচ এই দৃশ্যটাই নির্ভাবনায় আমরা প্রতিনিয়ত অবলোকন করছি। আমাদের চোখ ভিজে উঠে না, হৃদয় সিক্ত হয় না। কারণ, সে তো অন্যের সন্তান! আচ্ছা, স্রষ্টা যদি সবাইকে ক্ষুৎ-পিপাসার তাড়না দেবেন, তবে তা মেটানোর অধিকার কি তিনি দেন নি? হ্যাঁ, অবশ্যই দিয়েছেন। কিন্তু আমরাই তাদেরকে বঞ্চিত করছি। তাদের প্রাপ্যটাই তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে আমরা বড্ড অবহেলা করছি। তাদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে নিজেদের সম্পদকে পরিশুদ্ধ করার কথা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। ফলাফল, ক্ষুধিতের আর্তনাদ আর আর্তের রোনাজারি আমাদের চারপাশ ভারি করে তুলছে। এ সমস্যার যৌক্তিক ও কার্যকরী সমাধান পেশ করেই আল্লাহ রাহমানুর রাহীম তার প্রেরিত ধর্মে যাকাতের বিধান দিয়েছেন। এ বিধানের সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমেই ইসলামী শাসনব্যবস্থা এমন এক বিস্ময়কর বিপ্লব ঘটিয়েছিল যে, ইসলামী খিলাফতের যুগে একসময় যাকাত দেয়ার মতো কোন দরিদ্র লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। আজও দারিদ্রমুক্ত এক সমৃদ্ধ দেশ গঠনে যাকাত ব্যবস্থা হবে একটি মোক্ষম হাতিয়ার। এতে একদিকে ধনী-দরিদ্রের মাঝে বৈষম্যের দেয়াল চূর্ণ হয়ে মানবিকতা ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে ধনীদের আর্থিক পরিশুদ্ধতার পাশাপাশি আত্মিক পরিশুদ্ধতার পথ সুগম হবে।
যাকাত স্রষ্টা প্রেরিত সকল ধর্মে আরোপিত একটি শাশ্বত বিধান। সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রয়োজন পূরণে পারস্পরিক সহযোগিতার আবশ্যকতা সবসময়ই অনুভূত হয়েছে। তাই তো পূর্বেকার নবী-রাসূলদের সময়েও যাকাত ব্যবস্থার উপস্থিতির কথা আমরা কুরআন থেকে জানতে পারি। আমরা এ বিষয়ে কুরআনের কিছু আয়াতের রেফারেন্স সামনে রাখতে পারি- হযরত ইব্রাহীম আ. এর উপর যাকাতের বিধান, সূরা আল আম্বিয়া:৭৩। হযরত ইসমাঈল আ. এর উপর যাকাতের হুকুম, সূরা মারিয়াম: ৫৫। হযরত মুসা আ. এর প্রতি আল্লাহর নির্দেশ, সূরা আল আরাফ: ১৫৬। হযরত ঈসা আ. এর প্রতি আল্লাহর ফরমান, সূরা মারিয়াম: ৩১।
এরই ধারাবাহিকতায় শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর উপরও একই বিধান অবতীর্ণ হয়। কুরআনের শুরুর দিকেই সূরা বাকারায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, “নামাজ কায়েম করো, যাকাত আদায় করো এবং রুকুকারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রুকু করো।”- (সূরা আল বাকারা: ৪৩) এখানে একটা বিষয় অনুধাবনযোগ্য যে, অত্র আয়াতে নামাজের পরপরই যাকাতের উল্লেখ করা হয়েছে। এমনিভাবে কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২ বার, সরাসরি ৩২ বার এবং নামাজ ও যাকাতের কথা একত্রে ২৮ বার উল্লেখ করা হয়েছে। নামাজের পর যাকাতের ব্যাপারেই কুরআনে সর্বাধিক তাগিদ দেয়া হয়েছে। এমনকি নামাজের পর পরই সর্বপ্রথম যাকাত ফরজ করা হয়েছে। এ থেকেই ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। কারণ, এটি মানব সমাজের স্থিতিশীলতা ও অস্তিত্বের প্রশ্নের সাথে জড়িত।
যাকাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি ফোকাস পয়েন্ট হলো- ইসলামের ৫টি মূল স্তম্ভের মধ্যে যাকাত ব্যতীত কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ এগুলো হচ্ছে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক ও বুঝাপড়ার বিষয়। কিন্তু যাকাত এমন একটি স্তম্ভ যার সম্পর্ক আল্লাহর সাথে তো বটেই, মানুষের প্রতি মানুষের অধিকারকেও এর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এই ইবাদাতটির সুফল ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে মানবজাতির সার্বিক কল্যাণকামীতায় রূপ নিয়েছে। ইসলাম যে একটি কল্যাণকর জীবনবিধান তার একটি স্বার্থক দৃষ্টান্ত হলো এই যাকাত বিধান।
এ পর্যায়ে আমরা ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার মূলে নিহিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও এর কল্যাণকারীতা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করবো। কার্ল মার্কস বা এঙ্গেলস এর একপেশে দর্শনকে বাদ দিলেও আমরা আমাদের স্বাভাবিক পর্যবেক্ষন থেকেই এটা বুঝতে পারি যে, মানুষের জীবন-যাত্রার একটি বৃহৎ ও উল্লেখযোগ্য অংশ হলো অর্থনৈতিক জীবন। অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ছাড়া মানুষ সমাজের কল্যাণ তো দূরে থাক, ব্যক্তিগত কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগেও অক্ষম হয়ে পড়ে। তাই ইসলামে সমাজের সকল স্তরের মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আর এ ব্যাপারে কাঙ্খিত সমাধানের লক্ষ্যে ইসলামের শাশ্বত ‘ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা’র নীতিকে মূলনীতি হিসেবে পেশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলাম মূলত যে বিশেষ লক্ষ্যটি হাসিল করতে চায় তা হলো- “মানবসমাজে সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিশুদ্ধতা আনয়ন এবং এর মাধ্যমে মানুষের নৈতিক পরিশুদ্ধতাকে স্থায়িত্বে রূপদান করা।” এই মূল লক্ষ্যটিকে সামনে রেখে ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ও রূপরেখার সমন্বয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করার চেষ্টা করবো।
প্রথমত, আর্থিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিতা অর্জন। এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হলো- “তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত উসুল করে তাদেরকে পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন করে দাও।” (সূরা আত তাওবা: ১০৩) কুরআনের অন্যত্র এসেছে- “খালেছভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তারা ইয়াতিম, মিসকীন এবং বন্দীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় এবং তারা বলে যে, আমরা তোমাদেরকে কেবল আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্যই খাওয়াচ্ছি। তোমাদের কাছে আমরা কোনরূপ বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ চাই না।” (সূরা দাহর: ৮-৯) এখানে প্রথম আয়াতটি আর্থিক পরিশুদ্ধিতা ও দ্বিতীয় আয়াতটি আত্মিক পরিশুদ্ধিতার অনন্য দলিল। এই আয়াতগুলোর সঠিক মর্ম উপলব্ধির জন্য ইসলামের ভ্রাতৃত্ব নীতির সাথে মিলিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। সূরা হুজরাতের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে- “মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই।” এর ভিত্তিতেই হাদীসে এসেছে মুমিনরা সবাই মিলে একটি দেহের মতো, এর কোন একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে সর্বাঙ্গে তার প্রভাব পড়ে । এজন্য এক দারিদ্রপীড়িত ভাইয়ের অভাবের কষ্টগুলো তার একার থাকে না, বরং অন্যরাও তার দুঃখ-কষ্টের ভাগীদার হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এক স্বচ্ছল ভাইয়ের সম্পদে আরেক অভাবী ভাইয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম এটাকে তাদের প্রতি করুনা নয় বরং তাদের প্রাপ্য হিসেবেই পেশ করেছে। এ ব্যাপারে কুরআনের ভাষ্য হলো- “গরীব নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকীন ও গরীব মুসাফিরকেও।” (বনী ইসরাঈল: ২৬) এ জন্যেই কুরআনে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদকে পবিত্র করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
কেননা তার সম্পদের এই নির্ধারিত অংশটিতে তার নিজের কোন অধিকার নেই। এটা যার প্রাপ্য তাকেই বুঝিয়ে দিতে কবে। যদি সে এটা দিতে অস্বীকার করে তবে সে অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ এর দায়ে অভিযুক্ত হবে। আর এই বিধানের আলোকে যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিজের উপার্জিত সম্পদে অন্যের অধিকার স্বীকার করে নেয় সে অত্যন্ত মহৎ ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রদান করে। এটা তাকে স্বার্থপুজা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা করে। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ পালনে এতবড় আর্থিক কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, জীবনের আর সকল দিকে সে আল্লাহর অবাধ্য হতে পারে না। অপরদিকে মানুষের হক আদায়ে যে সদা সচেতন, তার দ্বারা কখনো অন্যের ক্ষতি হতে পারে না। কারো সম্পদ বা সম্ভ্রমে সে কখনো অন্যায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায়কারী ব্যক্তি আর্থিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিতার একটি কার্যকরী প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান। অর্থনৈতিক জীবনে অনিশ্চয়তা মানুষকে সবচেয়ে বেশি অপরাধ প্রবণ করে তুলে। যে সমাজে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যত বেশি থাকে, সেখানে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ, হত্যা, লুণ্ঠনের মতো ভয়াবহ অপরাধগুলো ততবেশি প্রভাব বিস্তার করে। তাই ইসলাম মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি প্রদান করে একজন সৎ মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের পথ প্রশস্ত করতেই যাকাতের মতো একটি কল্যাণকর সামাজিক বিধান দিয়েছে।
তৃতীয়ত, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। ইসলামে কখনো বাহ্যিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য করা হয় না। এ ব্যাপারে ইসলামের নীতি হলো- “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী তাকওয়াবান, সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত।” (সূরা হুজরাত:১৩) তাই সমাজে অর্থের ভিত্তিতে মর্যাদার মাপকাঠি নির্ধারণের প্রথাকে ইসলাম চূর্ণ করে দিতে চায়।
সেই সাথে বিত্তবানদের সম্পদে অভাবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষবৃক্ষটিকেই সমূলে উপড়ে ফেলাই হলো ইসলামের লক্ষ্য। এভাবে সমাজতন্ত্রের ন্যায় অযৌক্তিক সমতা প্রতিষ্ঠা বা পুঁজিবাদের ন্যায় সম্পদের একচেটিয়া ভোগাধিকার এর পরিবর্তে ইসলাম ইনসাফের ভিত্তিতে একের সম্পদে অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক শাশ্বত ও কার্যকর মানদন্ড পেশ করেছে। এভাবে শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, সাথে সামাজিক মর্যাদার বৈষম্য দূর করার ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে।
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই, ইসলামের যাকাত বিধান হলো মানব সমাজকে অর্থনৈতিক শোষণ, অবিচার ও দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার এক চমকপ্রদ ব্যবস্থা। তবে এক্ষেত্রে কেউ যেন ভেবে না বসে যে, এতে শুধু একপক্ষের লাভবান হবার অসম ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ তো সর্বোত্তম ইনসাফকারী। এ ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা প্রণিধানযোগ্য- “মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে তোমরা যে সুদ দাও, মূলত আল্লাহর কাছে তাতে সম্পদ মোটেই বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তোমরা যে যাকাত আদায় করো একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ লাভ করার উদ্দেশ্যে তা অবশ্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।” (সূরা আর রূম: ৩৯) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদানের এই প্রতিশ্রুতি শুধু আখিরাতের জন্য নয়, দুনিয়ার জীবনের জন্যও। তাই প্রকৃতপক্ষে যাকাত দানকারীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট মুনাফার অধিকারী হচ্ছে। আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই যাকাত ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখতে চাই। অভাব, দারিদ্র্য, কষ্ট শব্দগুলোকে আমরা আমাদের অভিধান থেকে মুছে ফেলতে চাই।
আল্লাহ আমাদেরকে এই কল্যাণকর যাকাত বিধানের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে আর্থিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিতা অর্জন এবং একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গঠনের তাওফীক দান করুন। আমীন।