বেদে সম্প্রদায়: নৌকাতে জীবন কাটায় যারা

আখতার হামিদ খান: সহজ ও কঠিন দুভাবেই বলতে পারি যে, যাযাবর বেদেদের নির্মম জীবনযাপন অতি কঠিনময়, যা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব এবং কারোরই অজানা নয়। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বেদেদের জীবন। মানুষের অধিকার, নারী অধিকার, শিশুর অধিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন চলছে, বিশ্ব আবহাওয়া ও পরিবেশ নিয়ে যে আন্দোলন চলছে, সেসব আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি লাভ করার জন্য জাত প্রথা বিলুপ্তি অপরিহার্য এবং অবশ্য করণীয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে অর্থাৎ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা- এসব অঞ্চলের ৩০০ মিলিয়ন বা ত্রিশ কোটি লোক আজও জাত প্রথার শিকার। ওদের জীবনে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত প্রথাগত বা সিস্টেমেটিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। বিশ্বে দাস প্রথা আজ বিলুপ্ত, বর্ণবাদ আজ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু বর্তমানে জাত প্রথা সমাজের মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সবচেয়ে বড় বিষয় হিসেবে বিরাজ করছে আমাদের বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকে অবশ্যই জাত প্রথার বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। আমাদের দেশের বেদেরা এই জাত প্রথার নির্মম শিকার। আজও এই বেদেদের দৈনন্দিন জীবনচিত্র পুরোটাই ভিন্ন। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন তা তাদের নেই। ওরা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। ওরা মানুষ হলেও যাযাবর বেদে বলে আখ্যায়িত। ওদের ছেলেমেয়েরা অবহেলায় বেড়ে উঠেছে। জাত প্রথার মাধ্যমে বেদেদের পরিবারে জন্মগ্রহণ করা, নারী ও পুরুষ সবাইকেই ন্যায় সাম্যের ভিত্তিতে মানুষ বলে বিবেচনা করা হয় না। তাদের জন্মগত বিবেচনা করে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাদের শিশুরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও স্কুলের ক্লাস রুমে আসন থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বেদেদের পরিবারে জন্ম, সে কারণে তাদের ক্লাস রুমে বসতে দেয়া হয় না। তাদের ক্লাসের বাইরে বারান্দায় চটের বস্তা পেতে বসতে হয়। স্কুল থেকে পানি পান করা নিষেধ। কোনো ধরনের পানির পাত্র ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। ভাবুন, কী নির্মম নির্দয় এই সমাজ। তারা বলল, ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা তাদের মাথায় নেই। ভবিষ্যতের চিন্তা মাথায় এলেও একটু ভেবে আর ভাবার সময় হয়ে ওঠে না। তারা বলল, দুবেলা দুমুঠো খাবার কীভাবে জোগাবে এই চিন্তায়ই তাদের ঘুম হয় না। খোলা আকাশের নিচে বিচিত্র রাত যাপন করে। কষ্ট ব্যথা হতাশা ওদের নিত্যসঙ্গী। সর্বগ্রাসী দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, পশ্চাৎপদতা ও দুঃখ-কষ্ট কতটা প্রকট তা তাদের জীবন কাহিনী দেখেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অল্পতেই ওরা খুশি হয়। বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাও যেন ওদের ভাগ্যে জুটছে না। তাদের ধর্মের মানুষের জন্য স্থানীয় নেতা সংস্থায় পৃথক আসন সংরক্ষণের দাবি জানান তারা। তাদের কথায়, বেদে মানুষের জন্য সম্পত্তি অর্জনের অধিকার, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার অধিকার, স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়ার অধিকার চাই। বেদেদের নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে খারাপ ব্যবহার যেন না করা হয়। আজ এখানে, কাল ওখানে জীবিকার কঠোর তাগিদে ওদের ছুটে বেড়াতে হচ্ছে। তারা বলল, সরকার আমাদের স্থায়ী আবাস ও বেঁচে থাকার জন্য আয়ের উৎস করলেই আমরা হব মহাসুখী। কিন্তু কে দেবে? রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে প্রতিনিয়ত তারা সংগ্রাম করছে। কিন্তু তাদের কেউ দেখছে না, এ অভিযোগ যাযাবর বেদেদের। আমাদের আরো কষ্ট হয়, চলন্ত বাস থেকে নামিয়ে দিছেলে বেদেদের ছেলেমেয়দেরকে, বেদে হওয়ার কারণে বসতে দেয় না পাশে, রুমাল চেপে ধরে নাকে। মানুষ এমন ভাব দেখায় যেন অন্য গ্রহরে কোনো প্রাণী দেখছে। এরূপ শত মানবাধিকার লঙ্ঘন করায় নির্যাতন সহ্য করেছি আমরা। আমাদেরকে কোনো হোটেলে থাকতে দেয়া হয় না, খেতে দেয় না, এমনকি পানি পান করতেও দেয়া হয় না। রাস্তার ধারে ও ফাঁকা মাঠে ঝুপড়ি তুলে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা নিয়ে রাত কাটাই।

তাদের দিন কাটে গাছগাছড়ার শিকড়সহ, তাবিজ, ওষুধ, দাঁতের মাজন, কপালে টিপ, চুড়ি, আলতা বিক্রি করে। সাপ খেলা ও বানর নাচ দেখিয়ে, বিনিময় কিছু পয়সা পায়। যা দিয়ে পরিবার নিয়ে কোনো রকমে সংসার চালায়। তারা বলল, যেখানে রাত সেখানেই কাত… এই অবস্থায় আমাদের জীবন কাটে। কোনো কোনো এলাকায় অবশ্য কিছু বেদে পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করে। কোনো কোনো বেদেরা নৌকায় বাস করে। আমাদের দুঃখ-কষ্টের সীমা নেই। আমরা বেদেরা আজ এখানে, কাল ওখানে অবস্থায় জীবন কাটাই। আমাদের পাহাড়সম সমস্যা। আমাদের ক্ষোভ ও দুঃখ- সরকার কেন আমাদেরকে দেখে না। আমাদের দেখার কি কেউ নেই? সমাজের লোকের জন্য তো অনেকেই কত কিছু করে। কিন্তু আমাদের বেলায় এমনটি হয় না কেন? তারা জানাল, আমরা আদিবাসী কোথা থেকে এসেছি তা আমরা জানি না। কারণ, আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা যে পথে তাদের জীবনের প্রথম যাত্রা শুরু করছিল এবং ওই সমাজে তারা যেমনভাবে স্থান করে নিছেলে- এই একই নিয়মে তাই আমরাও সে পথেই চলেছি অনাদিকাল থেকে। কিন্তু আমরা এটুকুই জানি যে, আমরা বাংলাদেশি। আমাদের বাবা, চাচারা অনেকেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশের নানান জায়গায় অবস্থানরত বেদের জীবন কষ্টের। চুলা আছে, হাঁড়ি আছে কিন্তু চাল নেই। নির্দিষ্ট কোনো ঘর নেই। এমন অবস্থায় মানুষগুলো বেঁচে আছে। স্বামী, স্ত্রী দিনভর জীবিকার সন্ধানে ছুটছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। আর তাদের ছেলেমেয়েরা চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে পথ পানে। কখন পিতা-মাতা আসবে। চাল আনবে রান্না হবে তারপর খাবে। এভাবে প্রতিটি দিনই পথ পানে চেয়ে কাটে ছেলেমেয়েদের। একটি বাচ্চা ছেলে এসে বলল, আমাদের ভাত কুকুর এসে খেয়ে ফেলেছে, আজ সারা দিন খাইনি…। তারা আজ এক জায়গায় কাল অন্য জায়গায়। লেখাপড়া নেই, খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। কাপড়-চোপড় নেই, অনাদরে অবহেলায় ধুঁকে অনেকে রোগ ব্যাধিতে নিঃশেষ হচ্ছে।
এতে কি বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে না। তবু এ সমাজের কেউ ফিরে তাকায় না তাদের প্রতি, এদের জন্য এতটুকু সময় নেই সমাজের, রাষ্ট্রের। তারা যে ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে রয়েই গেল। এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণের বা ইউনিসেফ ও এনজিও কর্মীরা পর্যন্ত তাদের খোঁজখবর রাখে না। আসে না তাদের কাছে। ফলে তাদের প্রত্যেকটি পরিবারে ৮-১০ জনেরও বেশি ছেলেমেয়ে জন্মায়। তাদের জন্য কর্মসংস্থান থাকা ভাল হতো। ওই ছেলেমেয়েদের একটাই প্রশ্ন, তাদের ভবিষ্যৎ কী? ওইটাই চাওয়া যে, তারা আরো অন্য ১০ জনের মতো লেখাপড়া শিখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়। সরকারি কোনো সাহায্যও পাচ্ছে না বেদেরা। বেদের ছেলে পলকু। সে জানায়, তার আক্ষেপের কথা এবং তার ইচ্ছা যে লেখাপড়া শিখে অন্য সবার মতো সমাজে চাকরি করবে। কিন্তু তার ভাগ্যে তা জোটেনি। কারণ, সাপ ধরার জন্য বাবার সাথে সে ছুটে বেড়ায় দূরে দূরে গ্রামাঞ্চলে। বেদের নারীরাও ঘরে বসে থাকে না। পেটের খাবার জোগাতে দূরে দূরে শহর থেকে গ্রামে ছুটে বেড়াতে হয়। এখন ওই কাজ তাদের আর ভালো লাগে না। তারা চায়- পোশাক শিল্প গার্মেন্টে কাজ করতে। তারা চায়- যেসব প্রকল্পে লাখো নারীকে তথ্য প্রযুক্তি সেবা প্রদান করা হচ্ছে, বেদে নারীরাও যেন তথ্য প্রযুক্তি অর্থাৎ কম্পিউটার বা আইসিটি শিক্ষা গ্রহণ করে নিজ উদ্যোগে আউটসোর্সিং, কম্পিউটার রিলেটেড ব্যবসার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে। তাদেরকে কৃষি, স্বাস্থ্য, আইন জেন্ডার ও ব্যবসা সম্পর্কে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে বেদে নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে বেদের নারীকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা। তথ্য প্রযুক্তি বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলে অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প যেন আসে।
ওদের চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেই। গাছ-গাছড়ার ওষুধ দিয়ে তারা রোগের চিকিৎসা করে। হাসপাতালে গেলে ছোট জাত বলে তাড়িয়ে দেয়। বেদেদের কথা ভাবা দরকার সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির, সংস্থার এবং সরকারি সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার। বয়োজেষ্ঠ্য মহিলাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার কথা বলতেই তাদের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা বললেন, হাসিনা-খালেদা চিনি না। ভোট দেয়ার কথা বলতে, ওরা বলল, আমরা তাদের ভোট দেই না। কেন? আইডি কার্ড নাই? মানে ভোটার কার্ড নাই? বলল, ভোটার লিস্টে নাম এলেও পায় না আইডি কার্ড। কারণ, আমরা অন্যত্র চলে যাওয়ার কারণে। তারা ভোটে অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। ওদের একটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই হলে কতই না খুশি হতো। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করানোর স্বপ্ন দেখত। আমরা বাংলাদেশের সব দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে এই আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য আহ্বান জানাই। সরকারের কাছে আমাদের এই দাবি, নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হিসেবে চিহ্নিত যেন না করে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button